রমজানে কলকাতায় কোথায় করবেন রাজকীয় ইফতার?
চলছে পবিত্র মাহে রমজান। আর রোজার প্রধান উপলক্ষ হচ্ছে ইফতার। নাখোদা মসজিদের ছত্রছায়ায় থাকা জাকারিয়া স্ট্রিটের দু’ধারে সাজানো সারি সারি খাবারের দোকানগুলোতে ভিড় জমতে শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। যার কৃতিত্ব অবশ্য সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দিলে ভুল হবে না। ফুড ব্লগারদের ভিডিওর দৌলতে এখন জাকারিয়াকে এক ডাকে প্রায় সকলেই চেনেন।
ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কলকাতার শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত্য নাখোদা মসজিদ। এক সময়কার বহু সম্প্রদায়ের ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প জড়িয়ে রয়েছে এই মসজিদের লাগোয়া রাস্তা জুড়ে। আদি মসজিদটির সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন প্রধানত পাকিস্তান থেকে কলকাতায় আগত কচ্ছের মেমন সম্প্রদায়ের মুসলিমরা। এই সম্প্রদায়েরই এক জনপ্রিয় ব্যবসায়ী হাজি নুর মহম্মদ জাকারিয়ার নামে এই রাস্তার নামকরণ। রমজানের জাকারিয়া মানে প্রায় বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট। ঠিক ততটাই ঝলমলে। বিরিয়ানি, কবাব, ফালুদা, শরবত, হালুয়া, শিরমলের টানে কেউ গুগল ম্যাপ চালু করে, আবার কেউ স্রেফ লোকের মুখে শুনেই অলিগলি চিনে পৌঁছে যাচ্ছেন জাকারিয়ায়! এককালে এটি ছিল রোজাদারদের রোজা ভাঙার ঠিকানা। এখন গোটা কলকাতার খাইয়েরাই আসছেন এখানে। ভিড় ঠেলে যদি ঝলমলে আলোর রোশনাইয়ে মোড়া দোকানগুলোতে একবার পৌঁছাতে পারেন, তা হলে কিন্তু মনে হবে, মোগলাই খাবারের স্বর্গে পৌঁছে গিয়েছেন।
মেট্রো কিংবা বাসে চেপে মহাত্মা গান্ধী রোডে পৌঁছে নাখোদা মসজিদের গলি ধরে খানিকটা হাঁটলেই চোখে পড়তে শুরু করবে একের পরে এক খাবারের দোকান। দুপুর থেকেই শুরু হয়ে যায় খাবার বানানোর তোড়জোড়। যদিও রমজান মাসে সার্বক্ষণিক দোকানগুলোতে চোখে পড়ে উপচে পড়া ভিড়। তবে বিকেল ৩-৪টা নাগাদ গেলে ভিড়ের আঁচ খানিক কম হলেও হতে পারে। প্রথমবার যাঁরা জাকারিয়া স্ট্রিটে যাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থা কী ছেড়ে কী খাবেন ধাঁচের হতেই পারে। ‘ফুড ওয়াক’ শুরু করতে পারেন মহব্বত কা শরবত দিয়ে।
জাকারিয়ায় ঢুকেই আপনার চোখে পড়বে কাচের গ্লাসে সাজানো গোলাপি রঙের শরবতে। গরমের দিনে এই শরবতে চুমুক দিলেই প্রেমে পড়া নিশ্চিত। তার পরেই চোখে দেখতে পারেন রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া ২০ টাকার হালুয়া-পরোটা!
জাকারিয়ায় গেলে একবার যেতেই হবে ১০৫ বছরের পুরনো ‘আদাম’স কবাব শপ’-এ। সেখানকার সুতলি কাবাব খাওয়ার জন্য কিন্তু দূরদূরান্ত থেকে লোকে এসে ভিড় করেন এই ঠিকানায়। দাম ৬০ টাকা। এরপর ভিড় ঠেলে এগিয়ে ঢুঁ মারতে পারেন ‘আল বাইক’-এ। সেখানকার আফগানি কাবাব আর পেয়ারে কাবাবের স্বাদ অতুলনীয়। পিস অনুযায়ী দাম ৩০ টাকা থেকে শুরু। তবে এই দোকানের ভেটকি ফ্রাইটা চেখে না দেখলে কিন্তু পরে আফসোস হতে পারে। প্রতি কেজি ভেটকি ফ্রাইয়ের দাম ৬২০ টাকা আর স্বাদ ভোলার নয়। রমজান মাসে থকথকে মাংসভরা হালিমের চাহিদা কিন্তু সবচেয়ে বেশি। জাকারিয়া স্ট্রিটে যাবেন আর হালিম খাবেন না, তা আবার হয় নাকি? ‘সুফিয়া’-র বিফ হালিম কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। ২০০ টাকা দিয়ে এক প্লেট কিনে চেখে দেখতেই পারেন। সেই হালিমের স্বাদ মুখে লেগে থাকবে বহু দিন। সুফিয়া থেকে বেরিয়ে চলে যান তাসকিনে। এই দোকানে গিয়ে মুর্গ চাঙ্গেজি, মাহি আকবরি অর্ডার করতে পারেন। ফুল প্লেটের দাম পড়বে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। রুমালি রুটির সঙ্গে এখানকার চাঙ্গেজি গ্রেভি আর ফালুদাও কিন্তু চেখে দেখা মাস্ট! ‘তাসকিন’-এর পাশেই ‘দিল্লি সিক্স’। এখানকার চিকেন মালাই শিক কাবাব, মটন নেহারির সঙ্গে নান কিংবা শিরমলের স্বাদ কিন্তু লা-জবাব। সবশেষে ৩২ রকম উপকরণ দিয়ে তৈরি ‘হাজি আলাউদ্দিন’-এর বত্তিসি হালুয়া না খেলে জাকারিয়া স্ট্রিটের ‘ফুড ওয়াক’ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। হালকা মিষ্টি পছন্দ হলে খেতে পারেন এখানকার আফলাতুন।
১৮৫৬ সালে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় আসার পরেই এই শহরে বিরিয়ানির পথচলা শুরু হয়। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে মোগলাই খানাপিনাকে আপন করতে শুরু করে শহরবাসী। নবাবের রাঁধুনিরাই বানাতে শুরু করেন নানা রকমের কাবাব। তখন অবশ্য গরু কিংবা পাঁঠার মাংস দিয়েই কাবাব বানানোর চল ছিল। পোলট্রির মুরগি কলকাতার বাজারে আসার বেশ কিছুকাল পর থেকেই শুরু হল মুরগি দিয়ে কাবাব তৈরির চল। সস্তায় সুস্বাদু কাবাবের স্বাদ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে শুরু করল কলকাতাবাসী। গরুর মাংসপ্রেমী হোন কিংবা মুরগিপ্রেমী— জাকারিয়া স্ট্রিট কিন্তু কাবাবপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় প্রথম দিকেই জায়গা করে নিয়েছে। আগেও ভিড় হত, কিন্তু এখন ব্লগ ও ব্লগ দেখে ভিড় আরও বেড়েছে। রমজানের সময়ে বেশির ভাগ দোকানেই অনলাইনে টাকা নেওয়ার ব্যবস্থা বন্ধ থাকে, তাই ভূরিভোজের আগে পকেট টাকা নিতে ভুলবেন না যেন।
হালিম হোক বা সুতলি কাবাব, মুর্গ আফগানি হোক বা মাছ ভাজা— যা-ই খান, সঙ্গে একগাল হাসি কিন্তু আপনি বিনামূল্যে পাবেন। মার্চ মাসের গরমে হাজার হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে, দীর্ঘ ক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার খেয়েও আপনার মনে কিন্তু এতটুকুও বিরক্তি আসবে না। রমজান মাসে কলকাতার বুকে এক ভিন্ন দুনিয়া থেকে ফিরে আপনার মনে রেশ থাকবে এক সুখকর অভিজ্ঞতার। এত ভিড় সামলেও কিন্তু রমজানে খাবারের মানের সঙ্গে কোনো রকম আপস করতে নারাজ জাকারিয়া স্ট্রিটের বিক্রেতারা। মিক্সিতে নয়, মাছ-মাংসে মাখানোর জন্য প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ রকমের মসলা এখনও হামানদিস্তায় গুঁড়ো করেন সেখানকার অধিকাংশ বিক্রেতা। মাছ, মাংস তাঁরা কিনে আনেন নিউ মার্কেট কিংবা মানিকতলা বাজার থেকে। ঘি, সর্ষের তেল কিংবা ডালডার মানও হয় এক নম্বর। এ পাড়ার বাতাসে সারা বছরই ছড়িয়ে থাকে সু-খাদ্যের সুবাস, তবে কেবল রমজান মাসেই মিলবে খাদ্য উৎসবের মেজাজ।