বাংলাদেশে ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যবস্থা
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/02/25/photo-1456398701.jpg)
ক্যানসারকে আগে একটি ভয়াবহ রোগ হিসেবে দেখা হতো। তবে প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা নিলে ক্যানসার অনেক ক্ষেত্রেই নিরাময় করা যায়।
এনটিভির স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৩০৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন। বর্তমানে তিনি নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ ক্যানসার সেন্টারের বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : ক্যানসার হলেই আমরা কম বেশি সবাই আতঙ্কিত হই। একটি সময় বলা হতো, ক্যানসারের কোনো আনসার নেই। মানে এর কোনো চিকিৎসা আসলে নেই। কিন্তু এখন ক্যানসারের অত্যন্ত ভালো ভালো চিকিৎসা আছে। কিছু ক্যানসার চিকিৎসা করে বেশ ভালোভাবে নিরাময় করা সম্ভব। শুরুতে জানতে চাইছি, বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে ক্যানসার চিকিৎসার অবস্থা এখন কেমন?
উত্তর : আমি যখন স্কুলে পড়তার তখন কবিতা লিখতাম। ক্যানসারের উত্তর নেই এরকম একটি বিষয় কিন্তু সেই সময় ছিল। আমাদের পরিচিত একটি শিশু ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার কারণে, আমার মধ্যে একটি গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল। চিকিৎসক হওয়ার পর যখন এই লাইনে আসি, ১৯৯৩/৯৪ সালে কাজ করা শুরু করি, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আমাকে বলা হয়েছিল, ‘এই বিষয়টি নিয়ে আমরা কোনো কাজ করছি না। আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।’
তবে আজকের বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক যিনি ছিলেন মার্গারেট চেন তিনি ১০ বছর আগে বলেছিলেন, ‘আগামী দিন এমন আসছে যখন প্রতিটি দেশের প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত থাকবে।’ এই ভয়াবহ দৃশ্যের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি। সত্যি সত্যি তার ভবিষদ্বাণী ফলে গেছে।
বাংলাদেশে আজ অনেক সংখ্যক ক্যানসারের রোগী। আমাদের হাতে এর সুনির্দিষ্ট কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। এই সংখ্যাটি দিন দিন বাড়ছে। আমরা যদি চারপাশের গণ্ডিতে দেখি কারো না কারো ক্যানসার দেখতে পাচ্ছি। এই পরিস্থিতি আগে ছিল না। ভবিষ্যতে আরো কঠিন সময় আমাদের জন্য আসছে। পরিস্থিতির দিক থেকে বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসায় আমরা এগিয়েছি। তবে যে পরিমাণ এগোনো দরকার সেই পরিমাণ এগোতে পারিনি। আমাদের দেশে ক্যানসারের শল্য চিকিৎসা হচ্ছে। কারণ, সার্জনরা এটা আগে থেকেই করতেন। তবে নিবেদিত ক্যানসার সার্জন তেমন তৈরি হয়নি বাংলাদেশে। ক্যামোথেরাপির যে ওষুধগুলো দেই ক্যানসার চিকিৎসার জন্য, বাংলাদেশেও কিছু ওষুধ তৈরি হচ্ছে, বিদেশ থেকেও কিছু আসছে। তবে এসব ওষুধের দাম অনেক। সরকারি উদ্যোগে যদি প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রতিষ্ঠান তৈরি করত, গরিব মানুষের জন্য এটি পাওয়া সহজলভ্য হতে পারত। সেটা বাংলাদেশে এখনো হয়নি। তবে হতে পারে।
রেডিয়েশন থেরাপির ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রেডিওথেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সব জায়গায় নেই। কিছু কিছু জায়গায় আছে। আবার অনেক জায়গায় মেশিনগুলো নষ্ট আছে। তবে আশার কথা হলো সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত খুব দ্রুত এগিয়ে এসেছে। যেমন : ঢাকার বাইরে খাজা ইউনুস মেডিকেল কলেজ রয়েছে যেটি ভালো প্রতিষ্ঠান। গত ৪ ফেব্রুয়ারি নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজে রেডিয়েশন চালু হয়েছে। আরো অনেক জায়গায় আছে। আহসানিয়া মিশনে আছে। স্কয়ার হাসপাতালে আছে। আমি শুনেছি, অ্যাপোলো হাসপাতালও এই চিকিৎসার জন্য এগিয়ে এসেছে। এটি বাংলাদেশের রোগীদের জন্য একটি বিশাল আশাপ্রদ বিষয়। আগে কিন্তু সব রোগী বাইরে চলে যেত।
প্রশ্ন : দেশে সিংহভাগ মানুষ বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিতে পারে না। এই জন্য আপনি শুরুতে বলছিলেন সরকারি পর্যায়ে এটি আরো বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে বলুন।
উত্তর : সরকারের দায়িত্ব হলো প্রতিটি মেডিকেল কলেজে এই ব্যবস্থাটা চালু করা।
প্রশ্ন : ক্যানসার চিকিৎসায় আমরা কতটা এগিয়েছি?
উত্তর : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু আছে, আমাদের দেশেও সেই চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকখানি চালু রয়েছে। আমাদের দেশে অনেক সার্জন রয়েছেন, যাঁরা খুব দক্ষতার সাথে আন্তর্জাতিক মানের অস্ত্রোপচার করছেন। মানে ক্যানসার সার্জারি করতে পারেন। পাশাপাশি ক্যমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বমানের, একেবারে অত্যন্ত আধুনিক মানের রেডিওথেরাপির চিকিৎসা বাংলাদেশে দিতে পারছি। এই কারণে কোনো রোগীর দেশের বাইরে যাওয়ার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন : কোন ক্যানসারে চিকিৎসা আশাপ্রদ?
উত্তর : অনেক ক্যানসারেই চিকিৎসা এখন আশাপ্রদ। যেমন : আমরা স্তন ক্যানসারের কথা চিন্তা করতে পারি। এটি অত্যন্ত আশাপ্রদ। প্রথম যেটা হলো, ক্যানসারটা যদি প্রথম দিকে নির্ণয় করতে পারি। যেকোনো ধরনের ক্যানসারই হোক, যত খারাপ ক্যানসারই হোক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি নিরাময়যোগ্য। তবে এরপরও যেগুলো বেড়ে যাচ্ছে, যদি স্তন ক্যানসার হয়, যদি জরায়ুমুখের ক্যানসার হয়, এগুলোকে কিন্তু আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরাময় করতে পারি। এই সুযোগ আছে আমাদের। খাদ্যনালির ক্যানসারে প্রথম দিকে এলে কিন্তু আমরা রোগীকে অনেকটা রক্ষা করতে পারি। ফুসফুসের ক্যানসারে খুব ছোট অবস্থায় এলে কিন্তু চিকিৎসা করে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব। অনেক ক্যানসারে কিন্তু বাঁচতে হলে প্রথম দিকে আসতে হবে। যেমন : হেডনেক ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থায় রোগীর চিকিৎসা করলে কিন্তু একশ ভাগ ভালো করা যায়।
প্রশ্ন : ভালো হওয়ার সম্ভাবনা এত থাকার পরও রোগীদের নিয়ে আমরা কেন সমস্যায় পড়ি? আপনার মত কী?
উত্তর : এর প্রধান কারণ হলো রোগীরা আমাদের কাছে যে পর্যায়ে আসে, সেটা শেষ পর্যায়ে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ রোগী শেষ অবস্থায় আসে। ওই সময় রোগীদের পুরোপুরি সুস্থ করার মতো অবস্থা আমাদের আর থাকে না। বেশির ভাগ রোগীর অস্ত্রোপচার করার সুযোগ থাকে না। এটি একটি বড় সমস্যা। আমরা ব্যথা বা অন্যান্য সমস্যা উপশমের জন্য চিকিৎসা করতে পারি। তবে রোগ নিরাময় করতে পারি না। আমাদের দেশে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ রোগী এই রকম। তারা অনেক দেরি করে আমাদের কাছে আসে যেহেতু সারা দেশে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই। এতে আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা করতে পারছি না।
প্রশ্ন : দেরি করে রোগী আসা- এ থেকে উত্তরণের জন্য আপনাদের পরামর্শ কী?
উত্তর : আসলে রোগীরাও এই বিষয়ে সচেতন নয়। ক্যানসার চিকিৎসার জন্য রোগী এবং তার আত্মীয়স্বজন উভয়েরই সচেতন হতে হবে। শুধু রোগীকে এককভাবে সচেতন হলে হবে না। আর সামাজিকভাবে যদি সচেতন না হয়, তবে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা উচিত হবে না। আরেকটি বড় সমস্যা হলো ক্যানসার চিকিৎসাটা সারা দেশে ব্যয়বহুল। সরকার যদি না এগিয়ে আসে এবং স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা না করে তবে এই ধরনের রোগের চিকিৎসা অনেক সময় করা সম্ভব নয়। অনেকে মনে করে ক্যানসারের চিকিৎসা করে লাভ কী। রোগী বাঁচবে না। তবে আমাদের হাতে অসংখ্য প্রমাণ আছে চিকিৎসা ঠিকমতো করলে রোগী ভালো হয়।
প্রশ্ন : সরকারের তরফ থেকে বা হাসপাতালগুলোর স্ক্রিনিংয়ে কী ভূমিকা রয়েছে?
উত্তর : বাংলাদেশে কয়েকটি স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে। যেমন : স্তন ক্যানসার, জরায়ু মুখের ক্যানসারের স্ক্রিনিং চালু রয়েছে। ভায়া প্রোগ্রাম বাংলাদেশে চালু আছে। এগুলো আমাদের ক্ষেত্রে আশাপ্রদ। জাতীয় পর্যায়ে যদি বড় বড় স্ক্রিনিং সরকার থেকে গ্রহণ করা হয় তাহলে বেসরকারি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসতে পারে।
আরেকটি হলো, টিকাগুলো আছে, সেগুলো দেওয়া। যেমন : জরায়ুমুখের ক্যানসারের টিকা। টিকাগুলো যদি ব্যবহার করতে পারি তাহলে ক্যানসার প্রতিরোধ করা সম্ভব। লিভার ক্যানসারের ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনেশন যদি দিয়ে দিতে পারি তাহলে লিভার ক্যানসারের ঝুঁকি আর থাকে না।