মহৎ পেশার মানুষ
প্রতিনিয়ত আত্মোন্নয়নের চেষ্টা করি : ডা. তাওহীদা
একদিন ক্লিনিকে একজন নারী রোগী এলো, মুখ ঢাকা। সঙ্গে তার বাবা। মুখ খোলার পর দেখা গেল রোগীটির সারা মুখে অবাঞ্ছিত লোম। রোগীটি কাঁদছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে মুখের এসব লোমের জন্য বের করে দিয়েছে তাকে। সে সমাজে ধিক্কৃত।
রোগীটিকে ছয় মাস চিকিৎসা করলেন চিকিৎসক। ভীষণ দামি এই চিকিৎসা বিনামূল্যে করে দিলেন তিনি। রোগীটি এখন সুস্থ, সেলাই মেশিন কিনে, রোজগার করে স্বাবলম্বী।
আরেকটি ঘটনা। একজন রোগী এলো চিকিৎসকের কাছে। সারা মুখে ব্রণ আর ব্রণের দাগ। রোগীটির আত্মবিশ্বাস এত কমে গেছে যে সে মুখ ঢেকে রাখে সব সময়। তার চিকিৎসা শুরু করলেন চিকিৎসক। আজ রোগীটি সুস্থ। এখন আর তাকে কাপড়ের আড়ালে মুখ ঢেকে রাখতে হয় না।
সেই চিকিৎসক হলেন ত্বক বিশেষজ্ঞ ডা. তাওহীদা রহমান ইরিন। তিনি ত্বকের পুনরুজ্জীবন, লেজার, ডার্মাটোলজি এবং খাদ্যপুষ্টির সঙ্গে ত্বকের যত্নের সম্পর্ক নিয়ে বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশে তিনি প্রথম মলিকুলার অ্যান্টি অ্যাজিং বা বার্ধক্য দূরীকরণ পদ্ধতি চালু করেন। এনটিভি অনলাইনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন নিজের জীবনের গল্প।
নানাই আমার প্রেরণা
আমার নানা ডা. মর্তুজা আলী খন্দকার ডাক্তার ছিলেন। তাঁকে দেখতাম বিনামূল্যে চিকিৎসা করতেন। আমাদের বাসায় নানার যে প্রাইভেট চেম্বার ছিল, সেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা করতেন তিনি। তিনি আমাকে বলতেন, আগে একজন ভালো মানুষ হও। এরপর চিকিৎসক।
যৌথ পরিবার ছিল বলে শেয়ার করতে করতে বড় হয়েছি। বাসায় অনেক বই ছিল। অনেক পড়তাম। বাসায় গ্রামোফোন ছিল। সেখানে অনেক গান শুনতাম। গান শেখার ইচ্ছে ছিল, তবে পরে আর হয়ে ওঠেনি। আমার চিকিৎসাজীবনে আসার অনুপ্রেরণা আমার নানা।
আমার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন চাকরিজীবী। নানা-নানির প্রতিচ্ছবি আমি তাঁদের মধ্যে দেখতাম। আমরা তিন বোন। বাবা আতাওয়ার রহমান মণ্ডল, চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতেন। মা মাহমুদা রহমান, শিক্ষক ছিলেন। তিন মেয়ে নিয়ে গাইবান্ধায় থাকতেন। আমরা নানার বাড়িতে বড় হয়েছি।
নানাকে দেখতাম প্রচুর দান করতেন। তাঁকে দেখে দেখে আমারও চ্যারিটি ওয়ার্কের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।
দেশে কাজের জায়গা অতটা সহজ ছিল না
গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে আমি এসএসসি পাস করি। এরপর ঢাকায় এসে ভিকারুননিসা নূন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। ২০০৩ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ হয়। এরপর আফ্রিকা চলে যাই। সম্পূর্ণ নতুন দেশ। মানুষগুলোকে আপন করে নিতে চাইতাম। প্রথমে একটি এতিমখানায় কাজ করি। সেখানে গিয়ে ওদের ভাষা শিখতে হয়েছে।
আফ্রিকায় গিয়ে দেখলাম, তাদের ত্বকের অনেক সমস্যা। তখন ত্বকের বিষয়ে আগ্রহ হলো। চিন্তা করলাম ত্বক নিয়ে কাজ করব। এরপর বাংলাদেশে এসে ত্বকের বিষয়ে এক বছরের প্রশিক্ষণ নিই। পরে নাইজেরিয়ায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এরপর সন্তান হলো। আট বছর বিরতি দেওয়া হয় তখন। এরপর ব্যাংককে গিয়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউশন অব ডার্মাটোলজি থেকে ডার্মাটোলজি ও ডার্মাটোসার্জারি বিষয়ে ডিপ্লোমা করি। আবার নাইজেরিয়াতে চলে যাই। সেখানে গিয়ে তাদের সরকারি চাকরির জন্য অ্যাটাচমেন্ট ট্রেইনিং করি। তাদের সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা দিই এবং পাস করি। কাজ শুরু করি।
এরপর ব্যাংককে গিয়ে এসথেটিক বিষয়ে পড়াশোনা করি। আমার চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনায় নতুন মোড় আসে; চিকিৎসাজীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
২০১৪ সালে দেশে ফিরে আসি, ১০ বছর পর। শুরুতে পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। দেশে কাজের জায়গাটা অত সহজ ছিল না আমার জন্য। তবে হাল ছাড়িনি। প্রতিনিয়ত আত্মোন্নয়নে চেষ্টা করেছি, করছি। শুরু করেছি ছোট একটি ক্লিনিকে কাজের মাধ্যমে। ক্লিনিকের সহকর্মী ও রোগীদের ভালোবাসা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন মানসিক সহযোগিতা জুগিয়েছে। আর তখন অনুপ্রেরণা দিয়েছে আমার মেয়ে নাশিতা।
এর মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে লেখালিখি শুরু করলাম। চ্যানেল আই ও রেকিট বেনকিজারের জন্য ভিটের বিউটি ক্যাম্পেইনের কাজ শুরু করলাম। একই সঙ্গে এনটিভিতে আমন্ত্রণ এলো টিভি টক শোর জন্য। এনটিভিতে স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’-এ অতিথি হলাম। এর পর থেকে বিভিন্ন টক শোতে ডাক আসতে থাকল। আমি এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা ও পরামর্শমূলক অনুষ্ঠানগুলোতে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হই।
বর্তমানে কাজ করছি শিওরসেল মেডিকেল (বাংলাদেশ) লিমিটেডে। এখানে ডার্মাটোলজিস্ট ও কসমেটোলজিস্ট হিসেবে কাজ করছি। শিওরসেলের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়াতে রিজেনারেটিভ মেডিসিন বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিই।
আমাদের দেশের চিকিৎসা নিয়ে অনেকের মনেই ভীতি রয়েছে। চিকিৎসার জন্য বাইরে চলে যায়। এটি যেন কমে, সেই উদ্দেশ্যে শিওরসেলের যাত্রা। এটি রিজেনারেটিভ ওয়েলনেস মেডিকেল সেন্টার। এখানে পিআরপি, স্টিমসেল ট্রিটমেন্ট, নিউট্রিশন অত্যাধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে চিকিৎসা করা হয়।
প্রতিমুহূর্তে আত্মোন্নয়নের চেষ্টা করি
প্রতিমুহূর্তে আত্মোন্নয়নের চেষ্টা করি আমি। চিকিৎসা পড়াশোনায় আপডেট থাকার চেষ্টা করি। নতুন কোনো বিষয় হলে সেটি আরো জানার চেষ্টা করি। কখনো কোনো কিছুকে ব্যর্থতা মনে করি না। যখন খারাপ সময় আসে, মনোবল দৃঢ় রাখার চেষ্টা করি। আর ভালো সময়ে মনে করি, যে কোনো সময়ে খারাপ সময় আসতে পারে। সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি রাখি।
আমার স্বামী শিওরসেলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডা. বোরহানুদ্দিন আহমেদ সাদিক। তিনি আমাকে বেশ সহযোগিতা করেন। আমার সহকর্মীরা আমার প্রাণ। আমার কর্মক্ষেত্র শিওরসেল আমার কাছে পারিবারের মতো। আমরা যেকোনো কাজ ভাগাভাগি করে করি।
মাদার তেরেসাকে ভীষণ পছন্দ করি
সাধারণত ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা হলে মানুষের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। বিশেষ করে মেয়েদের বেলায়। অবাঞ্ছিত লোম, শ্বেতী এগুলো বেশ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। চিকিৎসা ঠিকঠাকমতো হলে এবং ফলাফল ভালো হলে তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। আমি এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসায় কাজ করতে চাই।
ভবিষ্যতে প্রবীণদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে আমার। বিশেষ করে তাদের জন্য, যাদের সন্তানরা দূরে থাকেন বা নিঃসন্তান। একটি এমন প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই, যেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে।
মাদার তেরেসাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। তাঁর মতো হয়তো হতে পারব না। তবে তাঁকে পছন্দ করি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাঁরা লেখাপড়া করছেন, তাঁদের অনুরোধ করব প্রতিমুহূর্তে যেন তাঁরা নিজেদের আপডেট করার চেষ্টা করেন।