সাক্ষাৎকার
‘বিশাল জনগোষ্ঠী জানে না ডাউন সিনড্রম কী’
‘বর্তমানে বিশ্বে প্রতি ৮০০ শিশুর মধ্যে একজন শিশু ডাউন সিনড্রম নিয়ে জন্ম নেয়। বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রম নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এই ধরনের শিশুর সংখ্যা প্রচুর। তবে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এখনও জানে না ডাউন সিনড্রম কী?’ ডাউন সিনড্রম সোসাইটি অব বাংলাদেশের বর্তমান চেয়ারম্যান সরদার এ রাজ্জাক এমনটাই মন্তব্য করেন।
সরদার এ রাজ্জাক বলেন, ‘ডাউন সিনড্রম কোনো রোগ নয়। এটি আমাদের দেহের ক্রোমোজোমের একটি বিশেষ অবস্থা। ডাউন সিনড্রম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুরা আমাদের দেশে খুব অবহেলিত। এসব শিশুর সঠিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য বিষয়টি সম্পর্কে আরো সচেতনতা প্রয়োজন’।
সরদার এ রাজ্জাক ডাউন সিনড্রম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৮ সালে ‘ বিশ্ব ডাউন সিনড্রম দিবস অ্যাওয়ার্ড’ পান। তিনি গত ২১ মার্চ বিশ্বে নবম এবং বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিশ্ব ডাউন সিনড্রম দিবস উদযাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া তিনি ডাউন সিনড্রম শিশু ও তাদের অভিভাবকদের নিয়ে একটি ‘প্যারেন্ট সাপোর্ট গ্রুপ’ তৈরি করেছেন।
ডাউন সিনড্রম কী, বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রমের বর্তমান অবস্থা, ডাউন সিনড্রম সোসাইটির কাজ ইত্যাদি বিষয়ে এনটিভি অনলাইনের মুখোমুখি হন সরদার এ রাজ্জাক।
এনটিভি অনলাইন : ডাউন সিনড্রম বিষয়টি কী?
সরদার রাজ্জাক : ডাউন সিনড্রম কোনো রোগ নয়। এটি আমাদের শরীরের একটি জেনেটিক পার্থক্য বা ভিন্নতার মাত্রা, ক্রোমোজমের একটি বিশেষ অবস্থা। আসলে ডাউন সিনড্রম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তির শরীরে কোষ সমূহে একটি অতিরিক্ত ক্রোমোজম থাকে। আমাদের শরীরে প্রত্যেকটি কোষে ক্রোমোজমের সংখ্যা ৪৬টি।এই ৪৬টির মধ্যে ২৩টি ক্রোমোজম বাবা এবং অন্য ২৩টি ক্রোমোজম মায়ের কাছ থেকে আসে। এটি জোড়ায় জোড়ায় দেহ কোষ তৈরি করে। ডাউন সিনড্রম ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি দেহ কোষের ২১তম জোড়ায় দুটির বদলে তিনটি ক্রোমোজম থাকে। একে ট্রাইসোমি ২১ বলা হয়। এ রকম করে ডাউন সিনড্রম ব্যক্তির শরীরে প্রত্যেকটি কোষে মোট ক্রোমোজমের সংখ্যা থাকে ৪৭টি।
এসব শিশুর আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন : এই শিশুগুলো খুব নরম তুলতুলে হয়। এদের মাইলস্টোন অ্যাচিভমেন্টগুলো দেরি করে হয়। অনেকের মধ্যে জিহ্বাটা একটু বের করে রাখার প্রবণতা থাকে। লো মাসেল টোনের কারণে শরীরটা একটু ফোলা হয়। এদের জন্মগতভাবে কিছু রোগ থাকতে পারে। এদের অ্যানেটশন ডিফিক্ট হাইপার অ্যাকটিভিটি (এডিএইচডি) হওয়ার আশঙ্কা থাকে। জন্মগত হৃদরোগ হতে পারে। অনেকটা মঙ্গলিয়ানদের মতো চেহারা হয়।
এনটিভি অনলাইন : ডাউন সিনড্রম নিয়ে কাজ করার আগ্রহ কেন হলো?
সরদার রাজ্জাক : ২০০৮ সাল আমার জীবনে সাংঘাতিক কঠিনতম সময় ছিল। আমার তৃতীয় সন্তান রাফানের জন্ম হয় সেই সালে। তার ডাউন সিনড্রম। চিকিৎসক দেখে বললেন, ‘বাচ্চাটাকে একটু আলাদা ধরনের লাগে’। তখন শিশুটির ক্যারিওটাইপিং টেস্ট বা ক্রোমোজম বিভাজনের পরীক্ষা দিলেন। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমার। সারারাত জেগে ছিলাম। এর পর যখন রিপোর্ট এলো তখন দেখা গেল তার ডাউন সিনড্রম।
তখন চিকিৎসক আমাকে বললেন, এই বিষয়টি নিয়ে আরো পড়াশোনা করতে, ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখতে। এরপর আমি বিষয়টি নিয়ে প্রচুর পড়া শুরু করলাম। তখন ডাউন সিনড্রমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তেমন কোনো তথ্য ছিল না।
এরপর ধীরে ধীরে আমরা ডাউন সিনড্রম পেরেন্ট সাপোর্ট গ্রুপ বাংলাদেশ করার চিন্তা করি। আন্তর্জাতিকভাবে কাজটি করি। ফেসবুকে পেজ করলাম। বর্তমানে সারা বিশ্বে একশরও বেশি প্যারেন্ট সাপোর্ট গ্রুপ রয়েছে। এখানে ডাউন সিনড্রম বৈশিষ্ট্য সংবলিত শিশুর মা-বাবারা তাদের অনুভূতি, সমস্যা ইত্যাদি শেয়ার করেন।
এনটিভি অনলাইন : ডাউন সিনড্রমের চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?
সরদার রাজ্জাক : ডাউন সিনড্রম যেহেতু কোনো রোগ নয়, ক্রোমোজমের একটি অবস্থা, তাই এটি নিরাময় হয় না। সাধারণ মানুষ যেভাবে চিকিৎসা নেয়,সেভাবেই এদের চিকিৎসা করা হয়। তবে যেহেতু তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, রোগব্যাধি একটু বেশি হয়, তাই এদের যত্নটা একটু আলাদাভাবে নিতে হয়। সঠিক ডায়েট ও যত্নের মাধ্যমে তাদের সমস্যা কমানো যায়। ওরা খুব নরম প্রকৃতির হয়।
এনটিভি অনলাইন : ডাউন সিনড্রম সোসাইটি অব বাংলাদেশ কখন শুরু করেন?
সরদার রাজ্জাক : ২০১০ সাল থেকে ডাউন সিনড্রম সোসাইটি অব বাংলাদেশ করার উদ্যোগ নিই। অফিশিয়ালি শুরু করি ২০১৬ সালে। মানুষকে ডাউন সিনড্রম সম্পর্কে সচেতন করার জন্য এই সোসাইটি। ডাউন সিনড্রম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুব্যবস্থা, চাকরির নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী সংস্থা হিসেবে অ্যাসোসিয়েশন অব মেডিকেল ডক্টরস অব এশিয়া (আমদা) বাংলাদেশ ও জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল একযোগে কাজ করছে।
ঢাকার বনশ্রীতে সোসাইটির পক্ষ থেকে ডাউন সিনড্রম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুদের বিকাশে পড়াশোনা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের বিভিন্ন ব্যবস্থা করা হয়। সম্প্রতি আমাদের সঙ্গে ডিপার্টমেন্ট অব কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হয়েছে। আমি সেখানে গেস্ট লেকচারার হিসেবে কাজ করছি।
এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রমের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
সরদার রাজ্জাক : সারা বিশ্বে ৮০০ জনের মধ্যে একজন লোক ডাউন সিনড্রম নিয়ে জন্ম নেয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০ লাখ শিশু জন্ম নিচ্ছে। সেই অনুযায়ী পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার শিশু ডাউন সিনড্রম নিয়ে জন্ম নিচ্ছে।
বর্তমানে ডাউন সিনড্রমের পরিস্থিতির খুব যে পরিবর্তন হচ্ছে বিষয়টি তা নয়। সরকার যে প্রচেষ্টা করছে, সেখানে অনেক পদক্ষেপ রয়েছে। তবে পদক্ষেপগুলো কতটুকু অর্জন করেছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
আমাদের দেশে এ বিশাল জনগোষ্ঠী জানে না ডাউন সিনড্রম কী। তাই এই বিষয়ে আরো জানাতে হবে। আরো সচেতন করতে হবে লোকদের। এ ধরনের শিশুদের নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, তাদের লেখাপড়া একেবারেই হয় না, তারা হাবাগোবা বা বোকা প্রকৃতির হয়। তাদের একটি অবহেলার চোখে দেখা হয়, বোঝা মনে করা হয়। তবে ঠিকমতো যত্ন নিলে তারাও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমার একটি আক্ষেপ রয়েছে। সেটি হলো, ডাউন সিনড্রমকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা হচ্ছে। যারা এটি নিয়ে কাজ করছে, তাদের বোঝা উচিত বিষয়টি।
এনটিভি অনলাইন : আপনার বেড়ে ওঠা, জন্মস্থান, কাজ নিয়ে বলুন
সরদার রাজ্জাক : আমার জন্ম ঢাকাতে। মুন্সীগঞ্জের দেওভোগে বেড়ে ওঠা। সাঁতারে খুব ভালো ছিলাম। ফুটবল টিম করতাম। কিশোর বয়স কেটেছে আরামবাগে। চট্টগ্রামে ফাইন আর্টস থেকে পড়াশোনা। নটরডেম কলেজে পড়েছি। আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছি। বর্তমানে সমাজ উন্নয়ন কর্মী হিসেবে কাজ করছি। আমি জাপানিস এনজিও আমদা বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছি।
এনটিভি অনলাইন : ডাউন সিনড্রম সোসাইটি অব বাংলাদেশ নিয়ে আপনার ভবিষৎ পরিকল্পনা কী?
সরদার রাজ্জাক : প্রতিষ্ঠানটিকে আরো বড় করতে চাই আমি। কেবল শহরকেন্দ্রিক না থেকে গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে দিতে চাই। ডাউন সিনড্রম সম্পর্কে মানুষের মাঝে সচেতনা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে কাজ করে যেতে চাই। আমি চাই, কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডাউন সিনড্রম নিয়ে পড়ানো হোক। এসব শিশুরাও যেন সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে এটিই চাই।