দুই মিনিটের সর্বনাশ
মাত্র দুই মিনিটে ঝটপট মজাদার রান্না। একটু এদিক ওদিক করে গত ২৫ বছর ধরে এই মন্ত্রে শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বের ৩৭টি দেশের বাজার জয় করেছে নেসলের ম্যাগি নুডলস। স্বাদের ভিন্নতার জন্য এই নুডলসে পাগল অনেক শিশু এমনকি পূর্ণ বয়সীরাও। কিন্তু এই দুই মিনিটে তৈরি নুডলসে সময় কমিয়ে স্বাদ বাড়াতে গিয়েই ফেঁসে গেছে ভারতে ম্যাগি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নেসলে ভারত।
ভারত ও নেপালে এরই মধ্যেই নিষিদ্ধ হয়েছে ম্যাগির উৎপাদন ও বিক্রয়। প্রস্তুতকারী সংস্থা নেসলেও বাজার থেকে সব ম্যাগি তুলে নেওয়ার কথা জানিয়েছে।
কীভাবে ক্ষতি করে এমএসজি ও সিসা
‘অপরাধী ম্যাগি নুডলস’ পরীক্ষায় মিলেছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক স্বাদবর্ধক উপাদান মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (এমএসজি) এবং সিসা। সর্বশেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (এইচডব্লিউও) পরীক্ষায় থেকে বলা হয়েছে, যেকোনো খাবারে প্রতি মিলি লিটারে ০.০১ শতাংশ সিসা থাকতে পারে, সেখানে ম্যাগিতে প্রতি মিলিলিটারে ১৭ শতাংশ সিসা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ এমএসজিও পাওয়া গেছে ম্যাগিতে।
বিশেষজ্ঞের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, এমএসজি হচ্ছে এক ধরনের অ্যামিনো এসিড যা খাদ্যদ্রব্যে প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে। যেমন মাশরুম, টমেটো, ভাতের মাড় ও ভিনেগারে অ্যামিনো এসিড থাকে। এর স্বাদ একেবারেই অন্যরকম। এটি টক, ঝাল, মিষ্টি বা নোনতা নয়। প্যাকেটবন্দি খাবার স্বাদু করতে এমএসজি ব্যবহার করা হয়।
গ্লুটামেট এসিড থেকে কৃত্রিম উপায়ে এমএসজি বানানো হয়। আমাদের শরীরের স্নায়ুতন্ত্র ব্যবহার করে গ্লুটামেট। যেমন চোখ থেকে মস্তিষ্কে বার্তা পৌঁছানোর মতো কাজ করে গ্লুটামেট। এই কাজ হয় নিউরনের মাধ্যমে। আর এই নিউরন তৈরিতে গ্লুটামেটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গ্লুটামেটের পরিমাণ বেড়ে গেলে নিউরন কোষ ধ্বংস হতে শুরু করে। ফলে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট মূলত কোনো খাবারে মেশানো হয় স্বাদ বাড়ানোর জন্য। স্বল্প পরিমাণে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট খাবার এবং মানুষের শরীরের পক্ষে নিরাপদ হলেও এর অতিরিক্ত পরিমাণ ব্যবহার ও দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর।
এমএসজির পর দ্বিতীয় ক্ষতিকারক উপাদান হিসেবে ম্যাগিতে সিসা পাওয়া গিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সিসা খাবার দ্রুত রান্না হতে ভূমিকা রাখে। চিকিৎসকদের মতে, সিসা খুবই ভারী ধাতু। বলা হয়, পাঁচ মাইক্রোগ্রাম সিসাও শিশুদের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতিতে শরীরে রক্তস্বল্পতা, হাঁটু, কনুইয়ের মতো শরীরে হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা, স্মৃতিশক্তির অভাব, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, লিভারের সমস্যা এবং মস্তিষ্ক সংক্রান্ত সমস্যার তৈরি করে।
আবার ফিরবে ‘প্রিয় ম্যাগি’
সিসা ও এমএসজি বিতর্কে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ম্যাগি নিষিদ্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতে ম্যাগি বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুইস প্রতিষ্ঠানটির ভারতীয় শাখা। তবে নেসলে বলেছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও বাজারে ফিরবে পণ্যটি।
নেসলে ইন্ডিয়ার তরফ থেকে বলা হয়েছে, ‘আমরা জানি, সবার প্রিয় ম্যাগি কোনোভাবেই ক্ষতিকারক নয়। ভোক্তাদের আস্থা অর্জন এবং পণ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। দুর্ভাগ্যবশত পণ্যটি নিয়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এবং অজানা উদ্বেগ ভোক্তাদের জন্য সিদ্ধান্তহীনতায় ফেলেছে। জনমতকে ও সরকারের সিদ্ধান্তকেও আমরা সম্মান করি। এমন বাস্তবতায় নিরাপদ হওয়া সত্ত্বেও আমরা পণ্যটি বাজার থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
নেসলের বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সবার প্রিয় ম্যাগি নুডলস বাজারে আসবে। ম্যাগি নুডলস সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং ভারতে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এটি বিশ্বস্ত।’
এ ছাড়া নেসলে কোম্পানি ওয়েবসাইটে ম্যাগি নিয়ে প্রায় ১৫টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। তাদের দাবি, হাজার খানেক নমুনা পরীক্ষা করেও তারা মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক উপাদান পায়নি। ম্যাগি সম্পূর্ণ নিরাপদ বলেও তাদের দাবি।
এদিকে যে সিসা ও এমএসজি নিয়ে এত বিতর্ক, বহুজাতিক নেসলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পল বালকে আজ শুক্রবার ভারতে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করলেন, স্বাদ বাড়ানোর জন্য ম্যাগিতে এমএসজি অর্থাৎ মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা আজিনামোটো সামান্য পরিমাণ হলেও থাকে। তা সত্ত্বেও ‘দুই মিনিটের’ এই নুডলস সম্পূর্ণ নিরাপদ, দাবি করেছেন বালকে। ক্রেতাদের বিভ্রান্তি দূর করতে তাঁর পরামর্শ, এবার থেকে ম্যাগির প্যাকেটে ‘নো এমএসজি’ লেখা মুছে ফেলা হবে! তা হলেই নাকি সাহস ফিরবে বাজারে।
ভারতে ম্যাগি নিয়ে এই বিতর্ক উসকে দিচ্ছে অতীতে ক্যাডবেরির মধ্যে পোকা এবং পেপসি-কোকাকোলার মতো ঠান্ডা পানীয়ে কীটনাশকের উপস্থিতির স্মৃতি। বিপণন বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ক্যাডবেরি ডেইরি মিল্ক চকলেটে পোকা রয়েছে, এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ২০০৩ সালে ভারতে ৩০ শতাংশ বিক্রি কমে গিয়েছিল ক্যাডবেরির। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে সংস্থা ফের ১৫০ কোটি রুপি বিনিয়োগ করে অমিতাভ বচ্চনকে দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে নতুনভাবে ফিরে আসে বাজারে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের।
কোমল পানীয় পেপসির ক্ষেত্রে ২০০৫ সালে একই ঘটনা ঘটে। লাতুরে ‘বিষাক্ত পেপসি’ খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কয়েকজন। এদের মধ্যে একজন মারাও গিয়েছিলেন। এই ঘটনার তিন মাস পর মামলা সামলে পেপসি কর্তৃপক্ষ নিজেদের পণ্য সুরক্ষিত বলে দ্রুতগতিতে প্রচার শুরু করে। হৃত্বিক রোশন, আমির খান, কারিনা কাপুরের মতো বলিউড তারকারা পানীয় সংস্থাটির পাশে দাঁড়ান।
সেই ধারা বজায় রেখেই কি সব বিতর্ক পেছনে ফেলে রান্নাঘরে ফিরবে দুই মিনিটের জাদু? সময়ই বলে দেবে সবকিছু।