অন্য তারা
কম্পিউটার প্রকৌশলী থেকে বিউটিশিয়ান কাজী কামরুল
চুল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে নেহাত কম নেই। আর যাঁরা এ বিষয়ে একটু বেশি সচেতন তাঁরা খুঁজে খুঁজে ভালো সেলুনেই চুল কাটাতে বা সাজাতে যান। এমনই এক অভিজাত সেলুনের নাম ‘বানথাই বারবার অ্যান্ড বিউটি সেলুন’। বাংলাদেশে চুল ও মেকআপ স্পেশালিস্ট হিসেবেই ধরা হয় এই সেলুনকে। নামকরা এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের নাম কাজী কামরুল ইসলাম। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজ তিনি দেশের একজন স্বনামখ্যাত বিউটি এক্সপার্ট। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে কাজী কামরুল ইসলাম জানালেন দুটি চেয়ার নিয়ে শুরু হওয়া ছোট বানথাইয়ের বড় হয়ে ওঠার গল্প।
ফিরে দেখা
পড়াশোনার কারণে সিঙ্গাপুর পাড়ি দিয়েছিলেন সেই ’৯০-এর দশকে। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। ইঞ্জিনিয়ার কীভাবে বিউটি এক্সপার্ট হলেন জানতে চাইলে এনটিভি অনলাইনকে কাজী কামরুল বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে যে জায়গায় আমি থাকতাম, সেখানকার ওপরের তলায় ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ক্লাস করানো হতো। তাদের কাজ দেখতাম, মেকআপ করা শিখতাম। ট্রেনিংও নিয়েছিলাম। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের কাজ করেছি। এরপর ২০০০ সালে দেশে ফিরে একজন থাই নারীর সঙ্গে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর শুরু করি। কিন্তু আমাদের দেশের এয়ারপোর্ট থেকে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমদানীকৃত কাঁচামাল ছাড়িয়ে আনতে বেশ সময় লাগত। তাই ব্যাংকক থেকে আনা কাঁচামাল বেশির ভাগই দেরি হওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে যেত। ধীরে ধীরে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বন্ধ করে বানথাই বিউটি সেলুন শুরু করি। ব্যাংকক থেকে হেয়ার স্টাইলিস্ট এনে কাজ শুরু করি। প্রথমে দুটি চেয়ার দিয়ে বানথাইয়ের পথচলা শুরু হয়। আজ এত দূর আসার পেছনে নিজের মনোবল, ইচ্ছাশক্তি আর ভালো লাগাই ছিল প্রধান কারণ।’
ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, হংকং থেকে তিনি এই বিষয়ে নানা ধরনের ডিগ্রি নিয়েছেন। ২০১৩ সালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বিউটি সেগমেন্ট নিয়ে কাজ করা এক্সপার্টদের জন্য ফিলিপাইনে অনুষ্ঠিত ‘পিকা’ (ফিলিপাইন ইন্টারন্যাশনাল কসমোটোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন্স) প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এ বছরের আগস্ট মাসে আবারও এই প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে থাকছেন বিউটি অ্যান্ড হেয়ার এক্সপার্ট কাজী কামরুল ইসলাম।
অনুপ্রেরণায়
আমার জীবনের সব সাফল্যের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে আমার মা ছিলেন। তাঁর কারণেই আজ আমি এত দূর আসতে পেরেছি। এ ছাড়া যখন পিভোট পয়েন্ট স্কুলে পড়তাম, তখন অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। আর অনেকের কাজই আমাকে বেশ অনুপ্রাণিত করেছে। এঁদের মধ্যে ফিলিপাইনের ফ্যানি স্যারানো এবং ব্যাংককের টমির কাজ বেশ পছন্দ। তাঁদের কাজ দেখে অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করেছি।
বিশেষ কাজ
মেকআপ ও চুল নিয়ে এত কাজ করা হয়েছে, এর মধ্যে আপনার পছন্দ কোনটি-এই প্রশ্নের জবাবে কাজী কামরুল বলেন, প্রতিবছর একটি অব দ্য ট্রাক কাজ করে থাকি। একটি ফটোশুট করেছিলাম- যেখানে পাঁচটি ফুল, পাঁচটি মডেল ও পাঁচজন ফটোগ্রাফার ছিলেন। কাজটি আমার বেশ পছন্দের ছিল। এ ছাড়া থিমবেইজ মেকআপের কাজগুলো খুবই ভালো লাগে। আমি কখনো একই মেকআপে কয়েকটি ফটোশুট করাই না। কারণ আমি যদি একটি গাঢ় মেকআপ করি- এরপর সেই একই মুখের ওপর আবার হালকা মেকআপ করলে মূল বিষয়টি আর ফুটবে না। তাই এক-একটা ফটোশুটে আমি অনেক সময় নেই, যাতে প্রতিটি ফটোশুট বিশেষ হয়।
স্পেশাল কাজ
এত দিনের কাজের মাঝে কোন কাজটি আপনার কাছে স্পেশাল, এই প্রশ্নের উত্তরে কাজী কামরুল বলেন, ‘প্রতিটি কাজই আমার কাছে স্পেশাল। তবে আমিই প্রথম বাংলাদেশে মিল্ক রিবন্ডিং, আইস রিবন্ডিং, হেয়ার লেমিনেশন, বিভিন্ন ডিজাইনের নেইলপেইন্ট, এয়ার ব্রাশ মেকআপসহ নতুন ধারার কয়েকটি মেকআপের প্রচলন শুরু করেছি, যা আমার কাছে সারা জীবনই স্পেশাল থাকবে।’
অবসর এবং ভালোলাগা
অবসর খুব একটা পান না কাজী কামরুল। তবু যতটুকু সময় অবসরে থাকেন, নিজের পাখিদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। তাঁর অনেক বিদেশি পাখি আছে। তাদের সঙ্গে সময়টা বেশ ভালোই কাটে তাঁর। কুম্ভ রাশির এই জাতকের প্রিয় রং নীল, কালো ও সাদা। পাহাড় ভীষণ পছন্দ তাঁর আর খেতে ভালোবাসেন খিচুড়ি ও গরুর মাংস।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বানথাই নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে কাজী কামরুল বলেন, বানথাই খুব বেশি পরিসরে বড় করব না। আর অবশ্যই বানথাইয়ের কোনো শাখা করব না। কারণ আমি নিজেই ক্লায়েন্টদের হেয়ার-মেকআপ করার চেষ্টা করি। তাই অনেক শাখা হলে আমি সব জায়গায় সমানভাবে সময় দিতে পারব না। এখন যাঁরা আমার ক্লায়েন্ট আছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কটা অনেক গভীর। তাঁরা আমার ওপর ভরসা করে বারবার ফিরে আসেন। তাই কোনোভাবেই তাঁদের হতাশ করতে চাই না। যতটুকু পারি, নিজের হাতেই সব করার চেষ্টা করব।
যাঁরা এই পেশায় আসতে চান
কেউ এই পেশায় আসতে চাইলে তাঁদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন, এর উত্তরে কাজী কামরুল বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেকেই আছেন যাঁরা একটু সুযোগ পেলেই বিদেশে চলে যান। সেখানে গিয়ে অনেক নিম্নমানের কাজ করতেও তাঁরা রাজি। আর আমরা যাঁরা নিজের দেশকে ভালোবেসে কিছু করার চেষ্টা করছি, তাদের বাহ্বা দেওয়া তো দূরের কথা, তাঁদের কাজকে এতটুকু সম্মান দেয় না। আমাকে এখনো অনেকে নাপিত বলে হেয় করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি বলব, আমি যে পেশায় আছি তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছি। তাই এই পেশাকে ছোট করে দেখার কিছু নেই।
বিদেশে গিয়ে নিম্নমানের চাকরি করার থেকে দেশের কাজগুলোকে সম্মান করতে শিখলে নিজেও বড় কিছু হতে পারবেন। কাউকে তো জোর করে কিছু শেখানো যায় না। এই ইচ্ছাটা নিজের ভেতর থেকে আসতে হবে এবং শেখার আগ্রহ থাকতে হবে। তাই এই পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে এ বিষয়ে ভালো করে ট্রেনিং নিতে হবে। বলছি না যে দেশের বাইরে অনেক বেশি টাকা খরচ করে শিখতে হবে। কিন্তু একটু ভালোভাবে শিখতে চাইলে আমাদের পাশের দেশ ভারতে গিয়েও শিখে আসতে পারেন। এতে অন্তত নিজের কাজের ওপর আস্থা রাখতে পারবেন।’