স্থানীয় কৃষির প্রচারে ফুটবলকে বেছে নিয়েছে ক্লাবটি

ম্যাচসেরার পুরস্কার হিসেবে ছোট কোনো ট্রফি, স্মারক কিংবা আর্থিক পুরস্কার দিতে দেখে অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন ম্যাচ শেষে কোনো ক্লাব তাদের সেরা খেলোয়াড়ের হাতে উঠিয়ে দিচ্ছে ডিম, দুধ, গাজর, ওটস। আবার কখনও একটি ভেড়া বা জ্বালানি কাঠ। ব্রাইন এফকে তা-ই করছে!
প্রচার কিংবা প্রসারে ইউরোপিয়ান ফুটবলে এগিয়ে আছে ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, জার্মানির লিগগুলো। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের ঘরোয়া ফুটবল নিয়েও আছে দর্শকের আগ্রহ। রোনালদো-মেসির কল্যাণে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্রে চোখ রাখছে ফুটবলভক্তরা। প্রতিটি দেশের লিগই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হচ্ছে। চাকচিক্য আর অর্থের ঝনঝনানিতে এসব লিগের প্রতি মানুষের আকর্ষণ না বেড়ে উপায় নেই। ইউরোপের হেভিওয়েট ফুটবলের ভিড়ে নরওয়ের ক্লাব ব্রাইন এফকে ফুটবল বিশ্বে হয় সেভাবে পরিচিত নয়।
ব্রাইনকে পরিচিত করানো যাক। ম্যানচেস্টার সিটির গোলমেশিন আর্লিং হালান্ডকে কে না চেনে? নিজের প্রথম মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এক মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েছেন হালান্ড। এত গতিশীল শুরু অনেকদিন মনে রাখবে ফুটবল। সেই হালান্ডের শুরুটা কিন্তু নরওয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমের শহরের ক্লাব ব্রাইন থেকে।
ব্রাইন এফকে সম্প্রতি বেশ আলোচনায় এসেছে। ঘরের ছেলের হালান্ডের বিশ্ব মাতানো ফুটবল খেলার জন্য নয়। আলোচনায় এসেছে তাদের পুরস্কারের রীতি নিয়ে। কোনো ম্যাচে নিজেদের ক্লাবের সেরা খেলোয়াড়কে তারা কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে পুরস্কৃত করতে চান। যে কারণে তাদের নামটি বিশ্বজুড়ে খবরের শিরোনামে উঠে আসছে ধারাবাহিকভাবে।

পুরস্কারগুলো দেওয়া হয় স্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে। পুরস্কার দেওয়ার সময় স্থানীয় কৃষির সঙ্গে জড়িত সেই প্রতিষ্ঠানকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। গত ২৫ আগস্ট লার্স এরিক ম্যাচসেরা হয়ে পেয়েছেন স্থানীয় মধু, যেটি দেওয়া হয়েছে প্ল্যানবিআই এর পক্ষ থেকে।
এর আগে লাসে কভিগস্তাদ ভাইকিংয়ের বিপক্ষে ম্যাচসেরা হলে তাকে বোর্ডব্রোড্রেনের পক্ষ থেকে একটি রান্না ঘরের টেবিল দেওয়া হয় এবং সাথে লাইন গার্ডের পক্ষ থেকে ৪০ প্যাকেট ওটস, ১০০ ডিম ও ২০ লিটার দুধ দেওয়া হয়।
সানেল বোজাডজিক পরপর দুই ম্যাচে ম্যাচসেরা হন। সান্ডেফজর্ডের বিপক্ষে ম্যাচেসেরা হলে জোন উইগের পক্ষ থেকে তাকে বিপুল পরিমাণ ফুলকপি দেওয়া হয়। পরের ম্যাচে হ্যামকামের বিপক্ষে ম্যাচসেরা হয়ে পেয়েছেন ম্যাচসেরা ৫০০ কিলোগ্রাম গাজর, যা তাকে দেওয়া হয়েছে জায়েরেন গালরটের পক্ষ থেকে।
শুধু খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি ক্লাবটি। ফ্রেডরিকস্টেডের বিপক্ষে সেরা খেলোয়াড় হয়ে দুয়ার্তে মোরেইরা পেয়েছেন বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কাঠ।

জানলে আরও আবাক হবেন, হাউগেসুন্ডের বিপক্ষে জয়ের পর ম্যাচসেরা আক্সেল কাইজারকে দেওয়া হয় আস্ত একটি ভেড়ার বাচ্চা। এরপর জানানো হয়, তাদের স্টেডিয়ামে মাঠের ঘাস খাওয়ানোর পর সেটিকে চাষির সঙ্গে ফেরত পাঠানো হবে। চূড়ান্ত পুরস্কার দেওয়া হবে শরতে, যখন কসাই হোলান্ড কিয়োট এটিকে প্রক্রিয়াজাত করবেন। এর আগে ভেড়াটি পাঠানো হবে রাইফিলকের পাহাড়ের ঘাসের চারণভূমিতে। পাশাপাশি ব্রাইন স্টেডিয়ামে একটি ম্যাচের সময়ও রাখা হবে ভেড়াটি।
কেইউএফএমের বিপক্ষে হারের পর ব্রাইনের সেরা খেলোয়াড় আলফ্রেড স্ক্রিভেনকে দেওয়া হয় রুটি ও মাছ। ভাবছেন হারলেও পুরস্কার? কেবল জয় পেলেই যে ক্লাবটি পুরস্কৃত করছে, বিষয়টি এমন নয়। এখানেও তাদের ভিন্নতা রয়েছে। ম্যাচে জয়-পরাজয় ছাপিয়ে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় নিজেদের দলের সবচেয়ে ভালো খেলা ফুটবলারের হাতেই এবং সেটি তাদের স্থানীয় কোনো কৃষিপণ্য। যেটি এই অঞ্চলের ধারক-বাহক, তাদের পরিচয়।
নরওয়ের ক্লাবটির এই পুরস্কারের রীতির পেছনে আছে ভিন্ন এক গল্প। দক্ষিণ-পশ্চিম নরওয়ের এই অঞ্চলে মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন বেশি হয়। কৃষি প্রধান এই অঞ্চলের ক্লাবটির সঙ্গে স্থানীয় কৃষির সম্পৃক্ততাকে সম্মান জানিয়ে ভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সেখানের মানুষ।
কৃষির সঙ্গে ক্লাবটির সম্পর্ক অনেক গভীর। সেখানে কখনও খেলা দেখতে গেলে হয়তো আপনি তা আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারবেন। মাঝে মাঝেই সমর্থকদের মুখ থেকে ভেসে আসা স্লোগানে শোনা যায় ‘আমরা কৃষক এবং আমরা এতে গর্বিত’।
ব্রাইনের ভিআইপি টিকিটের ব্যবস্থা শুনলেও অবাক হতে পারেন। মাঠের পাশে রাখা হয় ট্রাক্টর। সেখানে বসে খেলার দেখার সুযোগ পেতে ভিআইপি টিকিট পাওয়া যায়। দর্শকরাও সেখানে বসে আমোদ-ফূর্তির সঙ্গে প্রিয় ক্লাবের খেলা উপভোগ করেন।
ম্যাচের আগেরদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা আসে কৃষির সঙ্গে মিল রেখে। কখনো ট্রাক্টরে বসে আবার কখনো ফসলের ক্ষেতে তারা খেলোয়াড়দের ফটোশুট করে। এরপর ছবির সাথে ক্যাপশনে সূচি জানিয়ে সমর্থকদের সমর্থন দিতে ডাকা হয় স্টেডিয়ামে।

আগামী বছর শত বছরে পা দিতে চলেছে ব্রাইন এফকে। ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৬ সালের ১০ এপ্রিল। শুরুতে ব্রাইন ফুটবল-লাগ (Bryne Fotball-lag) নামে পরিচিত ছিল তারা। ক্লাবটির প্রথম গঠনতন্ত্র ছিল হাতে লিখিত, যেটি তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক দলিল। এখনো সংরক্ষিত আছে ঐতিহাসিক সেই দলিলটি। ক্লাবের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওলা এম. ভোলান্দের স্বাক্ষরিত গঠনতন্ত্র ও একটি নিবন্ধন ফর্ম ১৯২৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নরওয়ে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে জমা দেয় তারা।
ব্রাইন এফকে প্রথম আনুষ্ঠানিক ম্যাচ খেলে ১৯২৯ সালের ১২ এপ্রিল। ক্লেপের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি ৪-৪ গোলে ড্র হয়। ফুটবল ক্লাব হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৩৭ সালে আরো বেশ কয়েকটি খেলা যুক্ত করে তারা। সেসময় নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ব্রাইন ইদ্রেত্সলাগ (Bryne Idrettslag)। ফুটবলের পাশাপাশি বক্সিং, হ্যান্ডবল, ওরিয়েন্টিয়ারিং ও ভলিবল যুক্ত করা হয়। যেটি টিকে ছিল ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। এরপর ক্লাবটি আবার তাদের শিকড়ে ফিরে আসে। অন্যান্য বিভাগগুলো আলাদা হয়ে গেলে শুধু ফুটবলকে নিয়ে যাত্রা করে ‘ব্রাইন এফকে’ নামে। যে নামটি এখন বেশ পরিচিত তাদের পুরস্কার রীতির কারণে।
সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ব্রাইন সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয় পায় ২০২৪ সালে। এনএম টুর্নামেন্টে ফরুস ও গাউসেলকে ১০-০ গোলে হারায় তারা। ব্রায়ানের স্টেডিয়ামে সর্বোচ্চ দর্শক উপস্থিতির রেকর্ড হয় ১৯৮০ সালে। ভাইকিং এফকের বিপক্ষে ম্যাচে ১৩,৬২১ জন দর্শক মাঠে বসে খেলা দেখেন সেদিন।
তাদের ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন গ্যাব্রিয়েল হয়লান্ড। শীর্ষ লিগে সর্বাধিক ২২৭টি ম্যাচ খেলার পাশাপশি সব মিলিয়ে ৫৯৬টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। গোলদাতাদের মধ্যে শীর্ষে আছেন জোহানেস ভল্ড, যিনি সব মিলিয়ে ২৭৪ গোল করেছেন। শীর্ষ লিগে সবচেয়ে বেশি গোল করা খেলোয়াড় হচ্ছেন আরনে লারসেন একল্যান্ড, যার গোলসংখ্যা ৫৯।
ক্লাবটি ২০০৩ সালের পর গত মৌসুমে প্রথমবারের মতো ফিরেছে নরওয়ের শীর্ষ লিগে। যারা নিজেদের পরিচয়কে তুলে ধরেন ম্যচসেরার পুরস্কার কিংবা মাঠের গ্যালারি থেকে ভেসে আসা ধ্বনিতে। খেলাটিকে ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে যারা বেশ উপভোগ করেন।