রাজিয়া মুরাদি : ভারতে স্বর্ণজয়ী এক আফগান নারী

লেখাপড়ায় অসামান্য সাফল্যের পুরস্কার নেওয়ার জন্য রাজিয়া মুরাদি যখন মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন একই সঙ্গে সুখ আর দুঃখের অনুভূতি কাজ করছিল তার মনে।
আফগানিস্তান থেকে আসা রাজিয়া মুরাদি (২৭) দুবছর ধরে ভারতে লেখাপড়া করছেন। ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের মাস্টার্স পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক জয়ী রাজিয়া সম্প্রতি গণমাধ্যমগুলোর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে তার পরিবারের সদস্যরা এই সাফল্য উদযাপনে সঙ্গে ছিলেন না।
রাজিয়া বলেন, ‘এটা অম্ল-মধুর মুহূর্ত। আমি সুখি যে আমার কঠোর পরিশ্রমের প্রতিদান আমি পেয়েছি, আমি আমার পরিবারকে খুব মিস করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আফগানিস্তানের সব মেয়ে এবং নারীর কথা চিন্তা করছি যারা তাদের শিক্ষা ও কাজ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’
২০২১ সালের আগস্ট মাসে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। নারী শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষায় বাধা দেওয়া হচ্ছে।
তবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজিয়া মুরাদি যখন ভারতে আসেন তখন দেশের পরিস্থিতি একটু অন্যরকম ছিল; তালেবানরা ক্ষমতায় আসেনি আর তার শিক্ষা গ্রহণে বাধাও ছিল না।
পরে ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিষয়ক কাউন্সিলের দেওয়া বৃত্তি নিয়ে গুজরাটের বীর নর্মদ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে মাস্টার্স কোর্সে যোগ দেন রাজিয়া মুরাদি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেওয়ার কারণ অনেক আফগান শিক্ষার্থী এখানে পড়ালেখা করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তাদের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে।’
লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে রাজিয়া বলেন যে, প্রশাসন ও নীতি নির্ধারণী বিষয়ে তার আগ্রহ রয়েছে আর তিনি আফগানিস্তানের সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তনের আশা করেন।
আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকা রাজিয়া বলেন, ‘আফগানিস্তানে ফিরে দেশের উন্নয়নে কাজ করাটা হবে আমার জন্য সম্মানের।’
গত সোমবার (৬ মার্চ) গুজরাটের গভর্নর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শ্রেণির লোকপ্রশাসন বিভাগে সর্বোচ্চ গ্রেড পয়েন্ট ৮.৬০ অর্জন করায় রাজিয়া মুরাদিকে স্বর্ণপদক প্রদান করেন।
তবে এই পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়াটা তার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। রাজিয়া জানান, তিনি দেশে থাকা তার পরিবার নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ২০২১ সালে যখন তালেবানরা ক্ষমতা দখলের জন্য এগিয়ে আসতে থাকে তখন তিনি যুদ্ধে তার পরিবারের কেউ মারা যায় কিনা তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় পরিবারের খোঁজ রাখতে আমার দেশের দুর্বল ইন্টারনেট ব্যবস্থা অনেক সমস্যায় ফেলেছিল আমাকে।’
কিন্তু এতো কিছুতেও ভেঙে পড়েননি তিনি। রাজিয়া ভাবতেন তিনি তার পরিবারের জন্য একজন যোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার আমার লেখাপড়া চালাতে গিয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে।’
তবে এতো পিছুটানের পরও দেশের অবস্থা এই মুহূর্তে ভালো না থাকায় ফিরতেও পারছেন না তিনি। দুবছর যাবৎ তিনি রয়েছেন ভারতে।
এ প্রসঙ্গে রাজিয়া বলেন, ‘দেশে লোকজনের চাকরি চলে যাচ্ছে আর উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের কাজগুলো থেমে গেছে। এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে আমার জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে না।’

সবটা না বললেও নিজের দেশের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তার নিজের কথাকে ‘সত্য বলার দায়িত্ব’ হিসেবে মনে করেন রাজিয়া মুরাদি। তার ভাষায়, ‘আমরা যদি নীরব থাকি তবে শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে না। তালেবান চায় জনতা নীরব থাকুক। তবে একজন আফগান নারী হিসেবে শাসন ব্যবস্থার কারণে সমাজে কী প্রভাব পড়ছে তা জানানো আমার দায়িত্ব।’
রাজিয়া মুরাদি এখন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোকপ্রশাসনে পিএইচডি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্নের প্রতি আমার পরিবার ও সম্প্রদায়ের লোকজন সবসময় সমর্থন দিয়েছে। তাদের কারণেই সমাজে একজন কর্মক্ষম নারী হতে পেরেছি আমি।’