সোলেইমানি : নির্মাণ শ্রমিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানি আধিপত্যের কারিগর

মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। অপেক্ষা ছিল শুধু বারুদে আগুন ধরার। ইরানি সেনাবাহিনীর অন্যতম জেনারেল এবং দেশটির অভিজাত কুদস ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলেইমানির নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলে উঠেছে ইরান। ইরাকের রাজধানী বাগদাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শুক্রবার ভোরে মার্কিন বিমান হামলায় জেনারেল সোলেইমানি ও হাশদ আশ-শাবির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আবু মাহদি আল-মুহাদিস নিহত হন। কে ছিলেন এই জেনারেল কাসেম সোলেইমানি?
ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারে ও ভারে সোলেইমানি ছিলেন ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামরিক ব্যক্তিত্ব। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পরেই ছিল তাঁর স্থান। দীর্ঘদিন ধরে গোটা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর ছিলেন এই কাসেম সোলেইমানি। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে যুদ্ধ থেকে শুরু করে লেবানন ও ইরাকে সরকারবিরোধী শক্তিকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা—সব কিছুর পেছনেই ছিলেন কাসেম সোলেইমানি। এবং একইসঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিরোধী জোরালো কণ্ঠস্বর হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি। সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে এ খবর জানিয়েছে।

তবে কাসেম সোলেইমানির উত্থানটা অবশ্য রাতারাতি হয়নি। সোলেইমানির জন্ম হয়েছিল ১৯৫৭ সালে এক গরিব কৃষক পরিবারে। আত্মজীবনীতে সোলেইমানি লিখেছেন, মাত্র ১৩ বছর বয়সে পরিবারের ঋণ শোধ করার জন্য রোজগারে নামতে হয় তাঁকে। ইরানের তৎকালীন রাজ পরিবারে কর্মী হিসেবে যোগ দেন। দিন আনি, দিন খাই পরিস্থিতির মধ্যে কাটিয়েছেন বহু বছর। ইরানে রাজ পরিবারের পতন হয় ১৯৭৯ সালে। ক্ষমতায় আসেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। খামেনির রেভল্যুশনারি গার্ড বা বিপ্লবী সেনাবাহিনীতে যোগ দেন কাসেম সোলেইমানি। এর দুই বছরের মধ্যে ইরাকের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ বাধে।
ইরান-ইরাক যুদ্ধে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন সোলেইমানি। এবং রাতারাতি একটি ব্রিগেডের দায়িত্ব পান তিনি। সেখান থেকেই শুরু সোলেমানির উত্থানের। ইরাকে ঢুকে যুদ্ধ করতে গিয়ে সোলেইমানির নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বলে কথিত আছে। তিনি নিজেও আহত হয়েছিলেন। কিন্তু কখনো যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাননি। বলা হয়, ওই সময়েই ইরাকের সরকার বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন কাসেম সোলেইমানি।
এরপর ২০০৩ সালে সাদ্দামবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকেও মদদ দিয়েছিলেন সোলেইমানি। সাদ্দাম সরকারের পতনের পর এক দিকে যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে নতুন সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন সেখানে ইরানের প্রভাব সৃষ্টির মূল কারিগর ছিলেন কাসেম সোলেইমানি। এবং সে কাজে সফলও হয়েছিলেন তিনি। এতটাই সফল হয়েছিলেন সোলেইমানি যে, ইরাকের ভূখণ্ডে কোনো মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। গত সপ্তাহেই যেমন বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের সঙ্গে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের। বলা যায়, যার জেরে নিহত হন কাসেম সোলেইমানি।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, মধ্যপ্রাচ্যে আজ ইরানের যতটুকু দাপট, তার পুরোধা কাসেম সোলেইমানি। ২০০৭-২০০৮ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরে চিঠি লিখে সোলেইমানি বলেছিলেন, ‘ভুলে যাবেন না, এই ভূখণ্ডে এখনো কাসেম সোলেইমানি আছে। যে শুধু ইরান নয়, ইরাক, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়ার পররাষ্ট্র নীতিও দেখভাল করে। গাজা, প্যালেস্টাইন পর্যন্ত তার যাতায়াত আছে।’ এরপর ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র কাসেম সোলেইমানিকে ‘সবচেয়ে বড় শয়তান’ বলে চিহ্নিত করে।
এক নজরে কাসেম সোলেইমানি
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী বলা হয় কুদস ফোর্সকে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই তকমা ধরে রেখেছে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের এই অভিজাত বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কুদস ফোর্সের পরিচয় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। জেনারেল কাসেম সোলেইমানি ছিলেন এই বাহিনীর সর্বেসবা।
সোলেইমানি ছিলেন ২০১৭ সালে মার্কিন-মদদপুষ্ট কুর্দিশ বাহিনীর কাছ থেকে ইরাকের তেল-সমৃদ্ধ শহর কিরকুকের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়ার পেছনে মূল কারিগর। তিনি ইরাক সরকার ও শিয়া মিলিশিয়ার মধ্যে সমঝোতা করিয়ে বলতে গেলে কোনো রকম বাধা ছাড়াই কুর্দিশ বাহিনীর কাছ থেকে কিরকুক শহর দখল করান। বিষয়টিকে সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের কৌশলগত ধাক্কা হিসেবে দেখা হয়েছিল।
এ ছাড়া সোলেইমানি ইরাকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যও পরিচিত। ২০১৭ সালে এক খোলা চিঠিতে আইএসের সমালোচনা করে সোলেইমানি বলেন, আইএস ‘শয়তানি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার হাজার মুসলিম তরুণকে ধোঁকা দিচ্ছে।’ একইসঙ্গে আইএসের উত্থান ও বিস্তারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও এর জোটসঙ্গী দেশগুলোর মতো ইরানও ২০১৪ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের বাইরে আইএস জঙ্গিদের ওপর হামলা চালায়।
কট্টর সুন্নি মুসলিমদের নিয়ে গঠিত জঙ্গি সংগঠন আইএসের সঙ্গে সোলেইমানি ও তাঁর মাতৃভূমি শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র ইরানের আদর্শিক দ্বন্দ্ব ছিল। সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ এ খবর জানিয়েছে।
সোলেইমানির নেতৃত্বে ইরাকে কুদস ফোর্স আইএসের বিরুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য পায়। এর মধ্যে ২০১৪ সাল থেকে আইএসের দখলকৃত ইরাকের তিকরিত শহরে আইএসবিরোধী হামলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সোলেইমানি।
গতকাল শুক্রবার ভোরে মার্কিন রকেট হামলায় সোলেইমানি নিহত হওয়ার পর আইএসের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইকে সামনে তুলে ধরে ইরান। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেন, জেনারেল সোলেইমানি ‘দুঃশাসন, শোষণ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
বলা হয়ে থাকে, ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য এলাকায় দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠেন সোলেইমানি। এরপর ইরানে ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব পরবর্তী সময়ে একজন নির্মাণ শ্রমিক থেকে সেনাবাহিনীর তরুণ সেনাসদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সোলেইমানি।
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট ফর পাবলিক পলিসি রিসার্চের ২০১২ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে নিজ বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা কমানোর জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতেও পরোয়া করেননি সোলেইমানি। এ কারণে নিজ দেশে দেশপ্রেমিক ও বীর যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন সোলেইমানি।
লেবাননভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সমর্থন দিয়ে গেছেন সোলেইমানি। জাতিসংঘ ২০০৭ সালে সোলেইমানির সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আর ২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধে সোলেইমানির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে তাঁর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে, সোলেইমানিকে সচরাচর খুব একটা জনসমক্ষে দেখা যেত না বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর কাছে দীর্ঘদিন তাঁর তকমা ছিল ‘ছায়া কমান্ডার’। এরপর ২০১৫ সালে ইরান সোলেইমানিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ছেন সোলেইমানি, এমন ছবি প্রকাশ ও প্রচার করে ইরান। এরপর টি-শার্টে সোলেইমানির সেঁটে যেতে দেরি হয়নি। শিয়া মিউজিক ভিডিওগুলোতে উচ্চারিত হতে থাকে তাঁর নাম। ইরানে সোলেইমানি ছিলেন একজন ভাইস প্রেসিডেন্টের সমতুল্য।
জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িক জয় হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। দীর্ঘদিন ধরেই সোলেইমানি মার্কিন লক্ষ্য ছিলেন। কিন্তু সোলেইমানির মৃত্যু মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কতটা বাড়াতে পারবে? বিশেষজ্ঞদের মতামত, অদূর ভবিষ্যতে কী হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে সোলেইমানির হত্যা সহজে ভুলবে না ইরান এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ইরান প্রভাবিত গোষ্ঠীগুলো। ইরানের শীর্ষ জেনারেলদের একজনকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের দূত মজিদ তাখত রাভানচি। ইরান এই হত্যাকাণ্ডের ‘নিষ্ঠুর বদলা’ নেবে বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।