নাকবা
৭৫ বছর আগে ফিলিস্তিনের যে পাঁচ জায়গায় গণহত্যা চালায় ইসরায়েল
প্রতি বছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা বিষাদপূর্ণ উপলক্ষ ‘নাকবা’ (আরবি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ দুর্যোগ) পালন করে আসছে। ৭৫ বছর আগে ১৯৪৮ সালের ইহুদি মিলিশিয়া পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানের পর থেকে এই দিনটি পালন করে তারা। সেই সময়ে ইসরায়েলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিনিরা তাদের পূর্বপুরুষের এই ঐতিহাসিক ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়।
নাকবা’র সময় গণহারে কয়েকশ’ গ্রাম থেকে অধিবাসীদের বের করে দেওয়া হয়, বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়া হয়, হত্যা করা হয় কয়েক হাজার ফিলিস্তিনিকে। ইহুদি মিলিশিয়া বাহিনী ইরগুন, হাগানাহ ও স্টার্ন গ্যাং এই গণনৃশংসতা চালায় আর এর মধ্যে রয়েছে কয়েক ডজন গণহত্যার ঘটনা। এর মধ্যে পাঁচটি গণহত্যার ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো :
বালাদ আল-শেখ
১৯৪৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর বন্দরনগরী হাইফার পূর্ব দিকে বালাদ আল-শেখ গ্রামে ইহুদি হাগানাহ মিলিশিয়া বাহিনী প্রথম আক্রমণ চালায়। এই হামলায় ৬০ থেকে ৭০ জন ফিলিস্তিনি নাগরিককে হত্যা করা হয়। ওয়ালিদ খালিদির বই ‘অল দেট রিমেইনস’ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়।
হামলায় অংশ নেওয়া মিলিশিয়াদের প্রতি নির্দেশ ছিল যতো বেশি সম্ভব ফিলিস্তিনি পুরুষকে হত্যা করতে হবে। এ সময় হাগানাহর এলিট ফোর্স পালমাচের ১৭০ জন সদস্য বন্দুকের গুলি ছুড়তে ছুড়তে গ্রামে প্রবেশ করে, বাড়িঘর থেকে ফিলিস্তিনি পুরুষদের টেনে বের করে বাইরে নিয়ে আসে ও গুলি করে হত্যা করে। এরপর ধ্বংস করে দেওয়া হয় তাদের বাসস্থান। হাগানাহর জেনারেল স্টাফের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ওই হামলার সময় দুজন নারী ও পাঁচ শিশুকেও মেরে ফেলা হয় আর আহত হয় আরও ৪০ জন।
১৯৪৮ সালের ৭ জানুয়ারি গণহত্যার পর অধিকাংশ পরিবারই গ্রামটি ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং ইহুদি বাহিনীরা সেটি দখল করে নেয়।
সাসা
১৯৪৮ সালে এখানে হাগানাহ দুটি গণহত্যা চালায়; একটি মধ্য ফেব্রুয়ারিতে, অপরটি অক্টোবরের শেষ দিকে। খালিদির বইয়ের তথ্য অনুসারে ১৫ ফেব্রুয়ারি পালমাচ বাহিনী সাসা গ্রামে অভিযান চালায় ও একের পর এক বাড়িতে বিস্ফোরক বসিয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। কমপক্ষে ১০টি বাড়ি এ সময় উড়িয়ে দেওয়া হয় ও ১০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে মেরে ফেলা হয়। এরমধ্যে পাঁচ শিশু ছিল।
দ্বিতীয় গণহত্যাটি চালানো হয় ৩০ অক্টোবর। হাগানাহ বাহিনীর প্রধান ইসরায়েল গালিলির তথ্যমতে এক সময় ‘গণ খুন’ চালানো হয় সাসা গ্রামে যার প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। ‘অল দ্যাট রিমেইনস’ বইয়ের তথ্য থেকেও এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা য়ায়নি। এ সময় গ্রামটি জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে।
দেইর ইয়াসিন
১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল ইহুদি বাহিনীর হাতে সবচেয়ে নৃশংস ঘটনাটি ঘটে। ১১০ জন ফিলিস্তিনি পুরুষ, নারী ও শিশুকে এই হামলায় জবাই করা হয়। জেরুজালেমের পশ্চিম প্রান্তে দেইর ইয়াসিন গ্রামটি ছিল সম্পদে পূর্ণ। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে হত্যাকাণ্ডের শিকার মোট লোকজনের অর্ধেকই ছিল নারী ও শিশু। হামলায় যাদের বন্দি করা হয়েছিল তাদের প্রাচীন শহর জেরুজালেমে হাঁটিয়ে নেওয়া হয় এবং পার্শ্ববর্তী একটি খাদে নিয়ে মেরে ফেলা হয়।
এ ছাড়া আরও কিছু লোককে সেই গ্রামে ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং পরে মেরে ফেলা হয়। ইনস্টিটিউট অব প্যালেস্টাইনের তথ্যমতে, ওই গ্রামে ৭৫০ জনের মতো অধিবাসী ১৪৪টি বাড়িতে থাকত। এই ঘটনার পর গ্রামটি ছেড়ে পালায় বাকি অধিবাসীরা। ইসরায়েলি এনজিও জকরোচের দেওয়া তথ্যে জানান যায়, ৫৫ জন শিশু এ সময় এতিম হয়ে পড়েছিল।
সালিহা
১৯৪৮ সালের ৩০ অক্টোবর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর শেভা ব্রিগেড সালিহা গ্রামে গণহত্যা চালায়। ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ বেনি মরিস ও হাগানাহর ইসরায়েল গালিলির দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ওই সময় সৈন্যরা গ্রামটিতে প্রবেশ করে এবং একটি অবকাঠামো উড়িয়ে দেয়, যা কিনা একটি বাড়ি বা মসজিদ ছিল বলে মনে করা হয়। এই নৃশংসতায় সেখানে আশ্রয় নেওয়া ৬০ থেকে ৯৪ জন লোকজন প্রাণ হারায়। এরপর গ্রামটি জনমানবহীন হয়ে পড়ে।
লিদ্দা
১৯৪৮ সালের ৯ জুলাই ইহুদি বাহিনী অপারেশন দানি নামে একটি বড় আকারের সামরিক অভিযান চালায় লিদ্দা ও রামলা শহর দখলের উদ্দেশ নিয়ে। জুলাই মাসের ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। সালমান আবু সিত্তার এটলাস অব প্যালেস্টাইন থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। এর পরপরই ‘মৃতের শহরে’ পরিণত হয় লিদ্দা আর সব বাসিন্দা পালায় সেখান থেকে। এ সময় ইহুদি বাহিনী এক হাজার ৮০০টি ট্রাকে করে শহরটি থেকে লুটতরাজের মালামাল নিয়ে যায়।