চলচ্চিত্র ‘মুহাম্মদ’ (স.) নিষিদ্ধের আহ্বান
ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি এখন ইরানের বক্স অফিসের সব রেকর্ড ভাঙার পথে। সেই মুহূর্তেই চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে তেহরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কিছু সুন্নি আলেম।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত ‘মুহাম্মদ (স.), মেসেঞ্জার অব গড’ নামের চলচ্চিত্রটির পরিচালনা করেছেন অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত ইরানি পরিচালক মাজিদ মাজিদী। প্রায় চার কোটি মার্কিন ডলার (৩১১ কোটি টাকা) ব্যয়ে নির্মিত ছবিটি ইরানের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ছবি।
ছবি সম্পর্কে রক্ষণশীল ইরানি পত্রিকা হেজবুল্লাহ লাইনকে মাজিদী বলেন, ‘পশ্চিমে ইসলামফোবিয়া নামে যে ঢেউ উঠেছে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এই ছবিটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিই আমি। পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামকে পুরোপুরি সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদে পরিপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়।’
১৭১ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই ছবিতে মুহাম্মদ (স.)-এর জীবনের প্রথম ভাগকে চিত্রায়ণ করা হয়েছে। তবে ইসলামের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী পুরো ছবিতে কোথাও তাঁর মুখ বা চেহারা দেখানো হয়নি। ছবিতে মহানবী (স.)-এর চরিত্র রূপায়নকারী কিশোরের শুধুমাত্র শরীরের পেছনের অংশ বা ছায়া দেখানো হয়েছে।
অস্কারজয়ী ইতালীয় সিনেমাটোগ্রাফার ভিট্টোরিও এই ছবিতে মুহাম্মদ (স.)-এর চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য বিশেষ ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন। এমনকি যে কিশোরটি এই চরিত্র রূপায়ন করেছে তার পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়নি।
তবে সুন্নি মুসলমানদের মর্যাদাপূর্ণ সংস্থা মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এই চলচ্চিত্র নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তারা এই ছবিটি নিষিদ্ধ করতে ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ইসলামিক ধর্মতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদেল ফাত্তাহ আলাওয়ারি রয়টার্সকে বলেছেন, এই বিষয়ে অনেক আগেই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। ইসলামী শরিয়া মোতাবেক মহানবী (স.)-এর চরিত্র রূপায়ন করা নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, ‘একজন মানুষের বা অভিনেতার দ্বন্দ্বপূর্ণ ও পরস্পরবিরোধী চরিত্র ইসলামে অনুমোদিত নয়। একজন অভিনেতা কখনো পাঁড় মাতালের চরিত্র করবেন আবার কখনো দুশ্চরিত্র ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করবেন। সেই অভিনেতাই আবার মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর চরিত্রে অভিনয় করবেন এটা কখনোই ইসলাম অনুমোদন দেয় না।’
গত কয়েক দশকে সুন্নি মতাদর্শের সৌদি আরব ও শিয়া মতাদর্শের ইরানের অনুসারীদের মধ্যে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব ক্রমশ বেড়েছে। তবে ১৪০০ বছর আগে ইসলামের জন্ম যে দেশে, সেই সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি।
চলচ্চিত্র সম্পর্কে যেসব মন্তব্য আসছে সেগুলোকে রাজনৈতিক বলে মন্তব্য করেছেন এই ছবির সংগীতশিল্পী সামি ইউসুফ। বিখ্যাত এই মুসলমান শিল্পী বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা ছবিটি সম্পর্কে মতামত দিচ্ছেন, তাঁরা কেউই ছবিটি দেখেননি। শুধুমাত্র ইরানের সংস্কৃতির অংশ বলে তারা এই ছবিটির বিরোধিতা করছেন।’
যিশুখ্রিস্ট ও অন্যান্য ধর্ম প্রচারকদের ওপরে যেখানে অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে মহানবী (স.)-এর জীবনের ওপরে মাত্র দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়াকে লজ্জাজনক বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
‘মুহাম্মদ (স.) : দ্য মেসেঞ্জার অব গড’ নামের ছবিটি মহানবী (স.)-কে নিয়ে নির্মিত দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এর আগে ১৯৭৬ সালে সিরীয় পরিচালক মুস্তাফা আল আক্কাদ ‘দ্য মেসেজ’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সেই ছবিতেও মুহাম্মদ (স.)-এর চরিত্র রূপায়নকারীর চেহারা দেখানো হয়নি। তবে ২০০৫ সালে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন আক্কাদ। তবে চলচ্চিত্রটি সম্পর্কিত বিষয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে কি না তা আজও জানা যায়নি।
মহানবী (স.)-কে চিত্রায়ণের কারণে বেশ কয়েকবার দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৫ সালে ডেনমার্কের একটি পত্রিকায় মুহাম্মদ (স.)-কে নিয়ে কার্টুন প্রকাশের প্রতিবাদে দাঙ্গা, খুন, দূতাবাসে হামলা ও পণ্য বর্জনের মতো ঘটনা ঘটেছে। একই কারণে এ বছরের জানুয়ারি মাসে ফ্রান্সের শার্লি এবদো পত্রিকা কার্যালয়ে ইসলাসপন্থী জঙ্গিদের হামলায় ১২ জন নিহত হয়।
এ ছাড়া ইসলাম ও মহানবীকে অবমাননা করে ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ উপন্যাস লেখার কারণে সালমান রুশদিকে হত্যা করতে মুসলমানদের উদ্দেশে ফতোয়া জারি করেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা।