বিয়ের চাইতে ডেটিং আর একা থাকতেই পছন্দ করছে চীনারা
চীনের সংস্কৃতিতে ভ্যালেন্টাইনস ডে’র সমতুল্য হলো ‘কিশি উৎসব’। ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে এই সময়টাকে চীনের যুগলরা তাদের বিয়ের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করে। চীনের চন্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিনে এই কিশি উৎসব পালন করা হয় দেশটির রোমান্টিক ভালোবাসার মিথ ঝিনু ও নিউলাংকে স্মরণ করে।
এই রোমান্টিক দিনটিকে তুলে ধরতে গত ২২ আগস্ট সিচুয়ান প্রদেশের মিয়ানইয়াং শহরের বিয়ে রেজিস্ট্রেশন অফিস উদ্যোগ নেয় যে তারা কিশি উৎসবে বিয়ে নিবন্ধনের অনুষ্ঠানগুলো সরাসরি সম্প্রচার করবে। তবে এক্ষেত্রে একটি সমস্যাই দেখতে পেয়েছিল দর্শকরা আর তা হলো বিয়ের জন্য যুগলের অভাব।
সম্প্রচার অনুষ্ঠানটিতে দেখানো হয় একটি বেশ বড় বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের হলরুমের বেশিরভাগ অংশই ফাঁকা। এ সময় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে যে ওই দিনে একটিও বিয়ের নিবন্ধন হয়নি। তবে এতে অনেক দেরি হয়ে যায়। মিয়ানইয়াংয়ের শূন্য ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন হলের এই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আর তা চীনের নিম্নমুখী বিয়ের হারকেই তুলে ধরে।
দেশটির সরকারি তথ্য-উপাত্তও বলছে যুবক-যুবতীতের যুগলবন্দি হতে সরকারের প্রচারণা ও উৎসাহ দেওয়ার পরেও বিয়ের হার কমছে সেখানে।২০১৩ সালে চীনে এক কোটি ৩৫ লাখ যুগল বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো গতবছর এই সংখ্যাটি নেমে এসেছে ৬৮ লাখে। সরকারি তথ্য আরও বলছে চীনারা এখন দেরিতে বিয়ে করছে, বিয়ে বিচ্ছেদের হারও বাড়ছে, বাড়ছে একা থাকার প্রবণতাও। চীনের যুবারাও এখন বলছে বিয়ে তাদের আধুনিক জীবনযাপনের সঙ্গে বেমানান।
গত মে মাসে পাইলট প্রকল্পের আওতায় চীনের ২০টি শহরে বিয়েকে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এমনকি চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশে নববিবাহিতদের জন্য আর্থিক পুরস্কারেরও ঘোষণা দেওয়া হয়। তাছাড়া ‘সঠিক বয়সে’ বিয়ে করার জন্যও যুবক-যুবতীদের উৎসাহিত করা হয় সেখানে। এছাড়া দেশটির গণমাধ্যমেও বিশেষ করে টিভি শোগুলোতে বিয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গুয়াংজৌ শহরের জেসিকা ফু (৩১) বলেন যে তিনি মনে করেন বিয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করার বিষয়টি সরকারের জন্মহার বাড়ানোর লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি বলেন, ‘চীনে কেবলমাত্র বিয়ের পরই সন্তান নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে।’
চীনে বিয়ের হার যেমন কমছে তেমনি শিশু জন্মহারও কমছে। আর এই অবস্থার যদি পরিবর্তন না হয় তবে এর প্রভাব গিয়ে পড়তে পারে দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধির স্বাভাবিক হিসাবে।
ব্যক্তিগত পছন্দের আবির্ভাব চীনের সমাজ ব্যবস্থায় বিয়ের বিষয়ে এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এ প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সটির প্রভাষক প্যান ওয়াং বলেন, ‘বিয়ে এখন জীবন ধারণের নানা রকম উপায়ের একটি হতে চলেছে।’
ওয়াংয়ের মতে চীনে এখন একক অর্থনীতির সময় চলছে। আর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সবখানেই-থাকার জায়গা হিসেবে বাড়ি থেকে শুরু করে গৃহাস্থলির সরঞ্জাম কেনা, রান্নাবান্নার কাজ, বিনোদন ব্যবস্থায় একক ট্রাভেল প্যাকেজ ইত্যাদি নানান রকম অফারের মধ্য দিয়ে।
প্যান ওয়াং বলেন, ‘আগের প্রজন্মের লোকদের কাছে ভালোবাসা ও বিয়ে ছিল একটি সম্মিলিত উদ্যোগ ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়টিকে বাইরে রেখে।’
ওয়ান শু (২৫) কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় একটি চীনা টেক কোম্পানির চাকরি হারান। এখন সে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের সামাজিক মাধ্যমের বিষয়গুলো দেখাশোনার কাজ করে। দীর্ঘ সময়ের কাজ এবং অপেক্ষাকৃত কম পারিশ্রমিকে জীবন চালাতে হচ্ছে তাকে। শুর মতে চীনের অর্থনীতিতে এখন যুবক-যুবতীদের জন্য খুবই খারাপ সময় চলছে। সরকারি হিসাবে গত জুনে চীনে যুবা বেকারত্বের হার ২১.৩ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়।
চীনে বর্তমানে ‘ডেট’ করার হার বাড়ছে। বিয়ের জন্য কনে বা বর না খুঁজে এখন দেশটিতে বাড়ছে ডেটিংয়ের প্রবণতা। অনলাইন বা অফলাইন ব্যবস্থায়, বন্ধুদের মধ্যে, পরিচিতজনের মধ্যে, সামাজিক মাধ্যমে, ডেটিং অ্যাপে বা ঘটকালীর প্লাটফর্মগুলোতে এখন চলছে ডেটিং।
এ বিষয়ে জেসিকা ফুর কথা না বললেই নয়। সংসারে তার বাবা-মা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের অবস্থা দেখে সে বিয়ে করার জন্য সঙ্গী না খুঁজে ডেটিংয়ের দিকে ঝুঁকেছেন। ফু বলেন, ‘আমি নিজেকে বলার চেষ্টা করি যে কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, তার চেয়ে বরং ডেটিংয়ের মাধ্যমে আরেকজনের সান্নিধ্যে সময়টাকে উপভোগ করাই শ্রেয়তর।’