ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলে নিহত ১

ইরানের ওপর ইসরায়েলের চলমান হামলার প্রতিশোধ হিসেবে তেহরান শনিবার (১৪ জুন) ভোরে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় ইসরায়েলে একজন নিহত ও কমপক্ষে ৭১ জন আহত হয়েছে। এই পাল্টাপাল্টি হামলা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের তীব্রতা এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। খবর সিএনএনের।
ইসরায়েলি পুলিশের মতে, ইসরায়েলি শহর রামাত গানে এ নারী নিহত হয়েছেন, যা ইরানি হামলার প্রথম প্রতিবেদন।
পুলিশ জানিয়েছে, তেল আবিবের পূর্বে অবস্থিত শহরের দান এলাকায় ঘটনাস্থলেই ওই নারীকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে।
মেডিকেল কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে একজন পুলিশ মুখপাত্র জানিয়েছেন, বেশ কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য জরুরি পরিষেবা সহ পুলিশ এখনও ঘটনাস্থলে কাজ করছে।
ইসরায়েলে রাতভর হামলা ও ক্ষয়ক্ষতি
শনিবার ভোররাতে ইসরায়েল জুড়ে দফায় দফায় বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠে ও বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে আহ্বান জানায়।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ইরান থেকে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩’ নামক এই প্রতিশোধমূলক হামলায় কয়েক ডজন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে, যার মধ্যে কিছু ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে। মার্কিন গ্রাউন্ড-ভিত্তিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (প্যাট্রিয়ট, থাড) ও একটি নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ইসরায়েলকে ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে সাহায্য করেছে।
তেল আবিবের শহরতলিতে আকাশচুম্বী ভবনের উপরে ধোঁয়া উড়ছিল বলে একজন এএফপি সাংবাদিক জানিয়েছেন। ইরানের বিপ্লবী গার্ড জানিয়েছে, তারা ইসরায়েলের কয়েক ডজন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করেছে। ইসরায়েলের অগ্নিনির্বাপণ পরিষেবা জানিয়েছে, তাদের দলগুলো ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, যার মধ্যে একটি উঁচু ভবনে আটকা পড়া লোকদের উদ্ধার করা হচ্ছে।
উদ্ধারকারীরা জানিয়েছেন, গুশ দান এলাকায় ৪০ জন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন মহিলাও রয়েছেন যিনি পরে তার আঘাতে মারা গেছেন। দ্বিতীয় দফায় আরও ৩১ জন আহত হয়েছেন বলে ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানিয়েছে। সব মিলিয়ে ইসরায়েলে ১ জন নিহত ও ৭১ জন আহত হয়েছেন।
বাসিন্দা চেন গ্যাবিজন এএফপিকে জানিয়েছেন, তিনি একটি সতর্কতা বিজ্ঞপ্তি পাওয়ার পর একটি ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে গেছেন। তিনি বলেন, ‘কয়েক মিনিট পর, আমরা একটা বড় বিস্ফোরণ শুনতে পেলাম, সবকিছু কাঁপছিল, ধোঁয়া, ধুলো, সবকিছুই ছিল সর্বত্র।’
ইসরায়েলের পূর্ববর্তী হামলা ও ইরানের ক্ষয়ক্ষতি
এই ইরানি হামলা ইসরায়েলের পূর্ববর্তী আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে এসেছে। ইরান জানিয়েছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের শহর, সামরিক স্থাপনা এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক হামলা চালিয়েছিল। এই হামলাগুলোতে ইরানের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাসহ ৭৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ৩২০ জনেরও বেশি লোক আহত হয়েছেন বলে তেহরান দাবি করেছে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
ইসরায়েলি হামলায় নিহত শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক কমান্ডারদের মধ্যে জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি (সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধায়ক), জেনারেল হোসেইন সালামি (বিপ্লবী গার্ডের প্রধান), ও জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ (গার্ডের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির প্রধান) রয়েছেন। এছাড়াও ছয়জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা (নাতানজ, ফোর্ডো, ইসফাহান নিউক্লিয়ার টেকনোলজি সেন্টার), ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সংরক্ষণাগার, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাসস্থান।

তেহরানের পরিস্থিতি ও বিশ্বনেতাদের আহ্বান
শনিবার ভোরে ইরানের রাজধানী তেহরানে, মেহরাবাদ বিমানবন্দর থেকে আগুন এবং ভারী ধোঁয়া উড়ছিল বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও একজন এএফপি সাংবাদিক জানিয়েছেন। ইরান আগেই বলেছিল যে তারা তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করেছে এবং রাজধানী জুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। রাতারাতি তেহরানের রাস্তায় কয়েক ডজন মানুষ তাদের দেশের সামরিক প্রতিক্রিয়ায় উল্লাস করতে নেমেছিল, কেউ কেউ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং ইসরায়েল-বিরোধী স্লোগান দিচ্ছিল।
জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত শুক্রবার বলেছেন যে, ইসরায়েলের প্রথম দফায় হামলায় ৭৮ জন নিহত এবং ৩২০ জন আহত হয়েছেন। টানা বোমাবর্ষণের পর, জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি শুক্রবার গভীর রাতে এক্স-এ লিখেছেন, ‘যথেষ্ট উত্তেজনা। থামার সময় এসেছে। শান্তি ও কূটনীতি অবশ্যই জয়ী হবে।’
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও আর্থিক প্রভাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাত থেকে নিজেদের দূরে রাখার চেষ্টা করছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, ইসরায়েলের এই আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই জড়িত নয়। একইসঙ্গে, তিনি ইরানকে এই অঞ্চলে অবস্থিত আমেরিকান ঘাঁটিতে আক্রমণ করার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন, ও মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার বলে উল্লেখ করেছেন।

জাতিসংঘ ছাড়াও, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদসহ বিভিন্ন দেশ-সংস্থা উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের এবং উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে। সৌদি আরব ইসরায়েলের হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা করেছে।
এই পরিস্থিতিতে, মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে এবং ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। এই পাল্টাপাল্টি হামলা কেবল দুই দেশের মধ্যেই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে ও বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের অস্থিরতা বাড়িয়েছে, বিশেষ করে হরমুজ প্রণালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহ রুটের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।