ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কারোপ : ভারতের অর্থনীতিতে যেভাবে প্রভাব ফেলবে

রাশিয়ার সঙ্গে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বাণিজ্য করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়ে ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছেন। এতে ভারতীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের মোট শুল্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই পদক্ষেপ যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে ভারতীয় রপ্তানি ও দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একইসঙ্গে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ ভারতকে চাপে রাখার একটি কৌশল বলে মনে করেন তারা।
রাশিয়া থেকে ভারতের তেল ক্রয় অব্যাহত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বুধবার (৬ আগস্ট) ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন। তবে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের সর্বোচ্চ ক্রেতা চীনের ওপর কোনো অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেননি ট্রাম্প। এই অতিরিক্ত শুল্কারোপ ভারতের টেক্সটাইল, সামুদ্রিক ও চামড়া রপ্তানি খাতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের স্বাক্ষরিত নির্বাহী আদেশ বাস্তবায়নের সময়সীমায় বলা হয়েছে, মূল শুল্ক ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে এবং অতিরিক্ত শুল্কারোপ ২১ দিন পর ২৭ আগস্ট থেকে শুরু হবে।
নির্বাহী আদেশে বলা হয়, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি, ভারত সরকার বর্তমানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে। সেহেতু বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা ভারতের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।’
ট্রাম্পের শুল্ক তালিকায় ভারতের অবস্থান কোথায়?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংশোধিত শুল্ক কাঠামো ভারত ও ব্রাজিলকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেকায়দায় ফেলেছে, উভয় দেশের পণ্যই মার্কিন বাজারে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ শুল্ক হারের মুখোমুখি হবে। কম শুল্কের সুবিধা পাওয়া এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে--মিয়ানমার (৪০ শতাংশ), থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া (৩৬ শতাংশ), বাংলাদেশ (৩৫ শতাংশ), ইন্দোনেশিয়া (৩২ শতাংশ), শ্রীলঙ্কা (৩০ শতাংশ), মালয়েশিয়া (২৫ শতাংশ), ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম সর্বনিম্ন (২০ শতাংশ)।
ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে ভারতে কী প্রভাব পড়বে?
এই শুল্কের প্রভাব পড়বে পোশাক, রত্ন ও অলংকার, চিংড়ি, চামড়া ও পাদুকা, পশুজাত পণ্য, রাসায়নিক এবং বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক যন্ত্রপাতি খাতে। তবে, এই বর্ধিত শুল্কের আওতামুক্ত খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে ওষুধ, জ্বালানি সম্পদ যেমন অপরিশোধিত তেল, পরিশোধিত জ্বালানি, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, বিদ্যুৎ ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ, কম্পিউটার, ট্যাবলেট, স্মার্টফোন, ফ্ল্যাট প্যানেল ডিসপ্লে এবং ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক উপাদান।
রপ্তানি শিল্পের প্রতিনিধিদের মতে, এই পদক্ষেপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্য রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনসের মহাপরিচালক (ডিজি) অজয় সহাই বলেন, ‘এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের ৫৫ শতাংশ রপ্তানির ওপর প্রভাব ফেলবে।’
আইসিআইসিআই সিকিউরিটিজ প্রাইমারি ডিলারশিপের প্রধান অর্থনীতিবিদ এ প্রসন্নের বলেন, অতিরিক্ত শুল্ক ২১ দিন পরে কার্যকর হবে। তবে এটি আগের ২৫ শতাংশের সঙ্গে যোগ হবে। তাই মোট ৫০ শতাংশ হারে শল্ক ভারতীয় রপ্তানির জন্য একটি বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ১৫-৩০ শতাংশ শুল্কের মধ্যে থাকা দেশগুলোর তুলনায় ভারতীয় পণ্য রপ্তানি অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে।
নির্মল ব্যাংক ইনস্টিটিউশনাল ইক্যুইটিজের প্রধান অর্থনীতিবিদ টেরেসা জন মনে করেন, নতুন করে আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের ফলে ভারতের ওপর বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্তের চাপ তৈরি হচ্ছে। ভারত পর্যায়ক্রমে রাশিয়া থেকে অপরিশধিত তেল ক্রয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে এবং অন্যান্য দেশ থেকে সংগ্রহে সম্মত হতে পারে।
ইওয়াই ইন্ডিয়ার ট্রেড পলিসি লিডার অগ্নিশ্বর সেন, এই পদক্ষেপকে হতাশাজনক বলে মনে করেন। তিনি বলেন, যখন আমরা পূর্ববর্তী ব্যবধানগুলো কমাতে এবং একটি বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছি, তখন এই অতিরিক্ত শুল্কারোপের ঘোষণা হতাশাজনক। আমি আশাবাদী, ভারত সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করবে।
অর্থনীতিবিদরা আরও সতর্ক করে বলেছেন, শুল্কের হার দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করায় ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এইচডিএফসি ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ সাক্ষী গুপ্তা বলেন, ট্রাম্পের আদেশ বাস্তবায়িত হবে ২১ দিন পর, যদি তা প্রত্যাহার না হয় তবে আমাদের এফওয়াই২৬ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস উল্লেখযোগ্যভাবে ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
ভারতকে চাপে রাখতে ট্রাম্পের কৌশল?
বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে প্রস্তাবিত ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তিতে মার্কিন দাবির বিষয়ে ভারতের অবস্থানকে প্রভাবিত করার কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস চায়, যার মধ্যে রয়েছে শিল্পজাত পণ্য, অটোমোবাইল (বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যানবাহন), ওয়াইন, পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষি পণ্য, দুগ্ধজাত পণ্য, আপেল, বাদাম ও জিনগতভাবে উদ্ভাবিত ফসল। উভয় দেশই এই বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে চুক্তির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ চূড়ান্ত করার লক্ষ্য নিয়েছে। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাশিয়া থেকে উচ্চ পরিমাণে অপরিশোধিত তেল আমদানিকারী দেশগুলোকে হুমকি দিয়ে ট্রাম্প রাশিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য দ্বার বন্ধ করে দিতেও চেষ্টা করছেন।
ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপে ভারতের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত। ভারত একে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করেছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ভারত পূর্বেই এই বিষয়গুলোতে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, তেল ক্রয়ের সিদ্ধান্তগুলো বাজারের পরিস্থিতি ওপর নির্ভর করে এবং ভারতের ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার জ্বালানি চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য এটি অপরিহার্য। বিশেষ করে উদ্বেগের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যদি অন্যান্য দেশ তাদের জাতীয় স্বার্থে একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়, তাহলে তাদের কোনো পরিণতি ভোগ করতে হবে না। আমরা আবারও বলছি, এই পদক্ষেপগুলো অন্যায্য ও অযৌক্তিক। ভারত তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।