রুশ-জার্মানদের সমর্থন পাচ্ছে কট্টর ডানপন্থি এএফডি

রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী জার্মান এবং তাদের বংশধররা অতি-ডানপন্থি অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি-এএফডির সবচেয়ে জোরালো সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম৷ অভিবাসন-বিরোধী এই দল কেন তাদের কাছে আকর্ষণীয়?
জার্মানির অতি-ডানপন্থি এএফডি এখন জার্মান পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল৷ দলটির সমর্থন ক্রমাগত বাড়ছে৷ কিছু জরিপে দেখা গেছে, চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎসের রক্ষণশীল খ্রিস্টীয় ডেমোক্র্যাটস (সিডিইউ) এবং বাভারিয়া রাজ্যে তার মিত্র খ্রিস্টীয় সামাজিক ইউনিয়ন (সিএসইউ) এর চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছে৷
জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়া জুড়ে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে এএফডি ২০২০ সালের তুলনায় তিন গুণ বেশি ভোট পেয়েছে৷
রুশ-জার্মানদের মধ্যে এএফডির জনপ্রিয়তা
গবেষণায় দেখা গেছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পুনর্বাসন করা জাতিগত জার্মানদের এবং তাদের বংশধরদের মধ্যে এএফডির বিশেষ সমর্থন রয়েছে৷
কনরাড আডেনাউয়ার ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই রুশ-জার্মানদের ৩১ শতাংশ এএফডিকে ভোট দিতে প্রস্তুত৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘অভিবাসী পটভূমির এই জার্মানদের মধ্যে এএফডির গড় সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি, যা প্রায় ১৯ শতাংশ৷”
ডেসিম গবেষণা কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, জার্মানিতে অভিবাসী পটভূমির ভোটারদের মধ্যে সোভিয়েত-পরবর্তী দেশগুলোর মানুষ প্রায় ১২ দশমিক চার শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় নয় লাখ৷
ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিলে অভিবাসী-বিরোধী দল
নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যে ভোটের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ফলগুলোর মধ্যে একটি ছিল ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিলের নির্বাচনে৷ এই কাউন্সিলে অভিবাসী এবং আবেদনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া জার্মানদের স্বার্থরক্ষায় প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়৷
রাজ্যটির বিভিন্ন শহরে এএফডি দলের প্রতিনিধিরা এখন এই কাউন্সিলগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করবেন৷ পাডেরবর্ন শহরে এএফডি ২৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে; ডেটমোল্ডে তাদের ভোট ২৭ দশমিক নয় শতাংশ৷ বটট্রপ শহরে দলটি ২৬ দশমিক দুই শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে এবং এসপিডি দলের চেয়ে তাদের মাত্র দুটি ভোট কম ছিল৷
শুধুমাত্র জার্মানিতে অভিবাসী পটভূমির বাসিন্দারাই ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিল নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন৷ এর মধ্যে বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি, আবেদনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব পাওয়া জার্মান এবং জন্মস্থানসূত্রে জার্মান নাগরিকত্ব পাওয়া অভিবাসী বাবা-মায়ের সন্তানরাও অন্তর্ভুক্ত৷ পুনর্বাসিত হওয়া জাতিগত জার্মানরাও এতে অংশ নিতে পারেন, তবে প্রথমে তাদের ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হতে হয়৷
ফলে এনআরডাব্লিউ রাজ্যে অভিবাসী পটভূমির বাসিন্দারা এমন একটি দলের প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন, যারা অভিবাসন বিরোধী এজেন্ডা অনুসরণ করে৷ তাদের এজেন্ডার মধ্যে রয়েছে ‘পুনঃঅভিবাসন’ এর আহ্বানও৷ ‘পুনঃঅভিবাসন’ হচ্ছে অতি-ডানপন্থিদের এমন একটি প্রস্তাব, যার মাধ্যমে কেবল অনাগরিক নয়, বরং অভিবাসী পটভূমির জার্মান নাগরিকদেরও জন্মদেশে ফেরত পাঠানোর সুযোগ তৈরি হবে৷
সিডিইউ/সিএসইউ থেকে এএফডিতে
জার্মান সাপ্তাহিক ফোকাস-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে, এনআরডাব্লিউ রাজ্যের যেই জেলাগুলোতে সবচেয়ে বেশি রাশিয়ান-জার্মানদের বাস, সেগুলোর মধ্যে দুটি হচ্ছে পাডেরবর্ন ও ডেটমোল্ড৷
মিউনিখ ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেসের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্দ্রেয়াস উস্ট বলেন, ‘‘এটা স্পষ্ট যে অনেক পৌরসভায় এএফডি-এর জোরালো সমর্থন ছিল এবং যেসব জায়গায় রাশিয়ান জার্মান বা পুনর্বাসিতদের সংখ্যা বেশি, সেখানে সেই সমর্থন আরও শক্তিশালী ছিল৷”
২০১৫-২০১৬ সালের দিকে রাশিয়ান জার্মানদের রাজনৈতিক সমর্থন মোড় নেয় বলে ধারণা করা হয়৷ সেই সময় লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ জার্মানিতে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছিলেন৷ এদের বেশিরভাগই সিরিয়া ও আফগানিস্তানের সংঘাত থেকে পালিয়ে এসেছিলেন৷ এর আগের গবেষণাগুলতো, রক্ষণশীল সিডিইউ/সিএসইউ ব্লককেই সমর্থন করার প্রবণতা দেখিয়েছিলেন রাশিয়ান জার্মানরা৷
তবে ২০১৫-১৬ সালে সিডিইউ/সিএসইউ শাসন ক্ষমতায় থাকাকালীন অভিবাসনের এই ঘটনা ঘটার পর থেকেই রাশিয়ান জার্মানরা তাদের সমর্থন এএফডির দিকে সরিয়ে নেয় বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
এএফডি এর রাশিয়া-বান্ধব অবস্থান
অভিবাসী পটভূমির জার্মানদের ভোট দেওয়ার আচরণ নিয়ে গবেষণা করা উস্ট মনে করেন, কারা জার্মান নাগরিক হতে পারবেন, এ নিয়ে এএফডি দলের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি রাশিয়ান জার্মানদের আকর্ষণ করে থাকতে পারে৷
উস্ট বলেন, ‘‘উদাহরণস্বরূপ, জার্মান সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং সেইসঙ্গে নাগরিকত্বের ভিত্তি হিসাবে জার্মান বংশদ্ভুত হওয়া, এমন একটি বিষয় যা অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় রাশিয়ান জার্মান এবং পুনর্বাসিত হওয়া অন্য জার্মানদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷”
অন্য বেশিরভাগ জার্মান দলের বিপরীতে এএফডি কিছু বিষয়ে রাশিয়া-বান্ধব অবস্থান নিয়েছে৷ ফেব্রুয়ারিতে ফেডারেল নির্বাচনের আগে দলটি তাদের ইশতেহারে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা অন্তর্ভুক্ত করেনি। দলের সহ-নেত্রী অ্যালিস ভাইডেল ধ্বংসপ্রাপ্ত নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন পুনর্নির্মাণেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷
এই ক্রেমলিন-বান্ধব অবস্থান এএফডিকে কে রুশ-ভাষী ভোটারদের মন জয় করতে সাহায্য করেছে৷ ডিডাব্লিউকে উস্ট বলেন, ‘‘অবশ্যই তারা (সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পুনর্বাসিত জার্মান) রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন, তাদের শিকড় বজায় রয়েছে এবং একটি রুশ-জার্মান পরিচয় ধরে রাখেন৷ এ কারণেই রাশিয়ার তীব্র সমালোচনা এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন প্রায়শই তারা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন৷”
রাশিয়ান জার্মানদের নিয়োগ করছে এএফডি
রাশিয়ান জার্মানরা অভিবাসী পটভূমির ভোটারদের মধ্যে বৃহত্তম জনসংখ্যার মধ্যে একটি৷ তবে তারা এখনও সামগ্রিক ভোটারদের খুবই ছোট একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করে৷
তবে এএফডি স্পষ্টতই এই ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর জন্য কাজ করেছে৷ বহু বছর ধরে দলটির সাবেক আইনপ্রণেতা অয়গেন শ্মিড্ট ছিলেন বুন্ডেসটাগে রুশ-জার্মান বিষয়ক কমিশনার৷ এএফডি রুশ ভাষায় তাদের কর্মসূচিও বিতরণ করে৷ সাধারণত ভোট দিতে অনিচ্ছুক অভিবাসী পটভূমির এমন ভোটারদেরও এই পদ্ধতি উৎসাহিত করেছে৷