ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড়
![](https://publisher.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/02/08/photo-1423383101.jpg)
সবাই বলত, ওই যে দেখা যায় একটা পর্বত, তার গায়ে তার ঢালুতে মেঘ লেগে আছে। এখানে বাস করত এক মুনি। তাঁর একটি মেয়ে ছিল। মেয়েটির নাম বনানী। সে বনের পশুপাখির ভাষা বুঝতে চাইত। বহু চেষ্টায় সে সত্যি একদিন অরণ্যের ভাষা আয়ত্ত করে ফেলল। সে ডাক দিলে অরণ্যের পাখি, পর্বতের পশু এবং গুহায় লুকিয়ে থাকা সিংহেরা গর্জন করে বেরিয়ে আসত। মেয়েটি সবাইকে ভীষণ ভালোবাসত। সে সিংহকে বলত—
সিংহ মশাই, সিংহ মশাই
মাংস খাবার যম,
ইংরেজিতে দখল ভারি
বাংলা জানেন কম।
বনানী সবাইকে ডেকে বলল, আমরা যত অরণ্যের অধিবাসী আছি, আমরা একটা সম্মেলন করব। এখানে সকলকে বসবাসের নিয়মকানুন শিখিয়ে দিতে হবে। যারা আমাদের সদস্যদের হিংস্র প্রাণী বলে, তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, আমাদের অনিষ্ট না করলে আমরা কারো ক্ষতি করি না।
আমরা জঙ্গলের প্রাণী বটে, কিন্তু আমরা তো আমাদের জঙ্গলের ভেতর সকলকে নিয়ে সহাবস্থান করি। আমরা শান্তিপ্রিয় প্রকৃতির সন্তান এবং চির স্বাধীন। আমাদের অনিষ্ট যাতে কেউ না করতে পারে, আমরা মহাসম্মেলনে সে বিষয়ে আলাপ করব। সিংহ যেহেতু অরণ্যের আদিম রাজা, সে জন্য তিনি হবেন সভাপতি। এই বলে সব পশুপাখি কলগুঞ্জন করে অরণ্যকে মুখরিত করে তুলল।
সিংহ তো মহাখুশি, কারণ সম্মেলনের সভাপতি হিসেবে সে সকলের বরণীয় রাজাধিরাজ হয়ে থাকবে। মনে মনে সিংহ বলল, আমাকে তো কিছু করতে হবে না। সবাই আমাকে সালাম দেবে এবং উপহার নিয়ে আসবে। আমি সিংহ রাজা হয়েই থাকব। আমি অন্যের অনিষ্ট করব না, তাহলেই তো শান্তি আসবে।
আমি বন্য এই অরণ্য
আমার রাজত্ব,
এখানে সবাই আমার প্রজা
কী মজা! কী মজা! কী মজা!
এই বলে সিংহ একটি গর্জন করে লাফ দিল। সবাই সিংহের লাফ দেখে হাসিতে আর বাঁচে না। সিংহ যখন হাসে, তখন তার লেজটা থিরথির করে নাচতে থাকে। তার দাঁত ঝলমল করে ওঠে এবং তার মাথার চুল তার ঘাড়ের ওপর ফুলে ফুলে দুলতে থাকে। একেই বলে সিংহ। এ হলো বনের রাজা, কী যে মজা!
বনের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী আসলে ছাগল। ছাগল যখন দেখল যে সিংহ সিংহাসনে বসতে যাচ্ছে তখন সে ভাবল, আমিও সিংহকে একটু তাক লাগিয়ে দিই না কেন! সে সন্ধ্যার আলোতে দাড়ি নাড়তে নাড়তে এসে হাজির হয়ে ছড়া কেটে বলল,
সিংহের মামা আমি ভম্বল দাস
ঘন ঘন দাড়ি নড়ে দু-চক্ষ বিজলি মাড়ে
এক একটা বাঘ আমার এক এক গ্রাস!
বাঘ শুনে ভাবল, এ এবার কে! এক একেকটা বাঘ যদি এক এক গ্রাস হয়, তাহলে তো সর্বনাশ! তার চেয়ে বরং আমি লেজ গুটিয়ে পড়ে থাকি না কেন! কে যাবে তার একটা গ্রাস হতে!
ছাগল ভাবল, আমি আসলেই দুর্বল প্রাণী। কিন্তু এই দুর্বলতা প্রকাশ করলে সবাই মিলে আমাকে খেয়ে ফেলবে। তার চেয়ে বরং আমি কেবল ভয় দেখিয়ে দাড়ি নাড়িয়ে এগোতে থাকব। তা না হলে কে কখন আমার ওপর লাফিয়ে উঠবে, তার কোনো ঠিক আছে?
এ অরণ্য আমার জন্য
আমি ধন্য আমি বন্য।
এখন ফিরে আসি বনানী, অরুণ্যানীর কথায়; এমনিতে মেয়েটি চঞ্চল হলেও মানবী হিসেবে অতুলনীয়া। সব সময় হাসিখুশি আর মুখের মধ্যে একটা ভালোবাসি-ভালোবাসি ভাব। কিন্তু ভালোবাসতে হলে তো সমকক্ষ, প্রতিপক্ষ এবং অতিদক্ষ অংশীদার লাগবে।
ভালোবাসি তো মুখের কথা নয়, কাউকে আলিঙ্গন করা। এখন এই জঙ্গলে মঙ্গলময় ভালোবাসার গল্প তৈরি করা সহজ কাজ নয়। অন্যদিকে, বনানীর যৌবন দেহের সীমা ছাড়িয়ে ফেটে পড়তে চাইছে—যে তাকে দেখে, সে-ই মুগ্ধ হয়। বনানী হাসে আর মনে মনে বলে, লালা ঝরুক সবার আমার জন্য। আমার নামেই তো প্রেম।
আমি ভালোবাসার শিক্ষয়ত্রী। আমি শেখাব মিলনের জয়গান। এই অরণ্যে গাছে গাছে, লতায়-পাতায় আমি ডেকে আনব বসন্ত। বসন্তের বাতাসে আমার গাত্রবর্ণ চাঁপা ফুলের মতো সুন্দর সুরভীযুক্ত সুঘ্রাণ ছড়িয়ে ঝরিয়ে নাচের মুদ্রা তুলে নেচে নেচে চলে যাবে জলতরঙ্গ বাজিয়ে। আমি রানি, মহারানি। সকলেই আমার রূপে ঝলসে যাবে। আমি সুন্দর, আমি সুন্দরী আবার আমি একই সঙ্গে ভয়ংকরীও বটে।
আমি ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানি। আমি প্রেম, আমি নর-নারীর বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দ সৃষ্টি করি। আমি স্বস্তির মেঘ; আমি বৃষ্টি ঝরাই। সকল প্রাণী আমার জয়গান করুক; মহোৎসবে মেতে থাক। আমি সাজ পরব দেহে, ঘুঙুর বাঁধব পায়ে। আমি নাচব হেলেদুলে। তার পর এই কথা বলেই বনানী বনের সব পশুপাখিকে ডাক দিল শালিক পাখির ভাষায়—
“শালিক শালিক ডাকছে কে
বনের ভাষা বুঝবে যে,
একটা শালিক অমাঙ্গলিক
দুইটা শালিক ভালো,
তিনটা শালিক কিচিরমিচির
ডাকঘর বসাল,
চিঠি শুধুই চিঠি
কুটোর থেকে তক্ষকতা খকখকিয়ে কেশে
অবশেষে হাসল মিটিমিটি।”
ডাক শুনে ওই বাঁক ঘুরে আসছে ধেয়ে এক সুরে গান গেয়ে, সব নেচে নেচে।
নাচতে নাচতে আসছে ঐ
আমি বনের কেউ কি নই!
আমি বনের বন্য ফুল
মাথায় আমার লম্বা চুল,
বাঁধি খোঁপা চুল দিয়ে
খোঁপা সাজাই ফুল দিয়ে।
এইভাবে ডাক দিয়ে এসে বনের মাঝে বসে পড়ল বনানী। সবাই ডাক শুনে চলে এলো বনের প্রান্তরে।
ঝরছে পাতা হলুদ রং
সভা হবে জবর জং।
এর মধ্যে হাসির খিলখিল শব্দ ছড়িয়ে বনানী বলল, আমার নাম বনানী, আমি এই বনের রানি। আমার কোনো সঙ্গী নেই, তবু আমি বন্ধু খুঁজি এই অরণ্যে।
আমার জন্য গাইছি গান
আমার সমান সঙ্গী চাই
ভালোবাসার যাকেই পাই,
তাকেই আমি প্রাণে জড়াই।
এ কথা শুনে সকলেই হেসে, উল্লাসে ফেটে পড়ল। সিংহ থেকে ছাগল পর্যন্ত সবাই বলল, আমরাও সবাইকে ভালোবাসতে চাই। আমরা খাই খাই ছেড়ে দিয়েছি। আমরা সকলেই সখাসখী হয়ে এই বনে, এই অরণ্যে একে অপরের জন্য ভালোবাসার ডাক দিয়েছি, হাঁক দিয়েছি। সময় আমাদের ডাক শুনে রুপালি নদীর বাঁক ঘুরে এখানে হাজির হয়েছে। এখন আর কিছু বাকি নেই। আমাদের উদ্দেশ্য তো স্পষ্ট। আমরা কারও কষ্ট সহ্য করতে পারি না। আমরা এই অরণ্যকে প্রাণীদের প্রেমের রাজধানী বানাব। এ কথা শুনে শিয়াল পণ্ডিত বলল, আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। আমি একটু সকলকে নাচ দেখিয়ে খুশি করে দিই।
নাচ ধরেছে শিয়ালে
হাসির ছটা দু’গালে,
সবাই নাচে এক তালে
নাচ ধরেছে শিয়ালে।
শিয়াল হঠাৎ নাচের পর দাঁড়িয়ে বলল, তোমরা কি জানো! পৃথিবীর যত জন্তু-জানোয়ার আছে, তাদের সবার লেজ বাঁকা, কিন্তু একমাত্র আমার লেজ বাঁকা নয়, পেছনে সোজা হয়ে থাকে এবং আমার শরম ঢেকে রাখে। তবে আমার একটা বদ অভ্যাস আছে, সেই অভ্যাসটা আমি ছেড়ে দিতে চেষ্টা করছি।
আমাকে শুধু লোকে নয়, সব প্রাণিকুল মুরগি চোর বলে ডাকে। আর চুরি করাটাই আমার বদ অভ্যাস। আচ্ছা বলুন তো, এক একটা মুরগি খেলে কী হয়?
সেখানে সবার পেছনে বসে থাকা একটা মুরগি ছিল। সে কককক করে ডেকে বলল, সর্বনাশ! এই শিয়াল মশাই সুযোগ পেলেই আমাকে খেয়ে ফেলবে। আপনারা আমার পেছনে থাকলে আমি শিয়ালের চোখের ওপর দুটো ঠোঁট দিয়ে ঠোকর মারব।
সে আমাকে খাবে কেন? সকলেই বলল, কথা তো ঠিক। আমরা তো সকলেই হিংস্রতা ত্যাগ করেছি। আমরা কাউকে তো মারি না, সহাবস্থানের জন্য আমরা পরস্পরকে ভালোবাসব বলে এই সম্মেলন করছি। এটা হলো বন্যপ্রাণীদের সভা। এটা হলো প্রেমের সম্মেলন। আমরা হিংস্রতা করি না। একে অন্যকে দেখে সহ-হৃদয় ভাব নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে সকলকে বনে থাকার ব্যাপারে সহযোগিতা করি।
বন ছেড়ে যাব না
কারো গোশত খাব না,
আমরা ধরব না কাউকে
মারব না কাউকে,
লোকে বলে পশুর দল
আমরা হলাম শিশুর দল,
নেচে-গেয়ে বাঁচতে চাই
ভালোবাসার ঢোল বাজাই।
দমাদম বাজছে ঢোল
ভাঙল খোঁপা আমার চুল,
কেশের বাহার ছড়িয়ে নাচ
নাচ দেখে সব সাজরে সাজ,
এর নামই তো খেমটা নাচ
কোথায় বসন কোথায় লাজ,
নাচের পাগল এই সমাজ।
নাচতে নাচতে শরম ঢাক
শরম কোথায়? পরম সুখ
চুমু খেতে কেউ তো ছুঁক।
এ কথায় সকলেই লাফিয়ে উঠে বলল, ‘আমি।’
আমি আমি উঠল রব
চতুর্দিকে কি উৎসব!
এ উৎসবে সকলেরই আনন্দের বাঁধ ভেঙে গেল। সকলেই খুশিতে ডগমগ। এ সময় অরণ্যের লতাপাতার ভেতর থেকে জেগে উঠল একটা মুখের ছবি। দেখা গেল, বনানীর মুখ। বনানী হেসে বলল, আরে আমি তো এই অরণ্যের প্রথম কবি হতে চাই। আমি কবি আর সবাই আমার বন্ধু; আমার প্রিয় পশুপাখির দল।
আমার নাম বনানী
আমি অনেক গান জানি,
গানের সুরে ডাক দিই
সবকে সমান ভাগ দিই।
কম পড়ে না কারো হাত
ঘি মাখা এই গরম ভাত,
একসাথে সব করো মাত।
শেষ পর্যন্ত সবাই বনানীর কাছে এসে বলল, ওগো বনের সুন্দরী, আমরা তোমার সখীর দল। আমাদের নিয়ে এই অরণ্যে আর কী করবে বলো? এবার আমরা শান্তি চাই, শেষ চাই, একটা নতুন দেশ চাই। আমাদের ভালোবাসা দিয়ে এই গল্পের সমাপ্তি করে দাও। এখন ঢোল বাজুক শেষের ঢোল।
দমাদম বাজুক ঢোল
বুকের ভেতর নাচুক ঢোল,
নাচতে নাচতে শেষ করি
নাচের তো আর নেই জুরি।