চলনবিলে বিনা চাষে রসুন আবাদে ঝুঁকছে কৃষক
পাবনার চলনবিলের চাটমোহর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে বিনা চাষে সাদা সোনা খ্যাত রসুন আবাদে ঝুঁকছে কৃষকরা। গত বছর আবাদ করা রসুনের দাম তুলনামূলক কম হওয়ার পরও কৃষকরা রসুন আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি।
কৃষকের কথা, দাম কম হলেও চাষাবাদ খরচ ও ঝামেলা কম হওয়ায় অন্যান্য ফসলের চেয়ে লাভ অনেক বেশি বিনা চাষে রসুন আবাদে। উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন বিনা চাষে রসুন আবাদ হয়।
চলনবিলের রসুনের আবাদ এ অঞ্চলের কৃষকের অন্যতম অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। প্রায় দুই দশকের অধিক সময় ধরে বিনা চাষে রসুনের আবাদ হচ্ছে এ উপজেলায়। রসুন রোপণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে নারী শ্রমিকরা। বীজ বাছাই ও রোপণে কাজ করে তারা। একজন মহিলা কৃষিশ্রমিক প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা মজুরি পায় আর পুরুষ কৃষিশ্রমিকরা পায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি।
কয়েকজন কৃষিশ্রমিক বলেন, আমনের আবাদ ঘরে তোলার পর আমাদের তেমন কোনো কাজ থাকে না। এ সময় আমাদের একটু অভাবের মধ্যেই দিন অতিবাহিত হয়। বিনা চাষে রসুন আবাদ পদ্ধতি চালু হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে আমাদের বসে থাকতে হয় না। আবার এ রসুন ঘরে তোলার সময়ও আমরা কাজ করি সব মিলিয়ে আমাদের এখন সবসময় কাজ থাকে।
মহিলা কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা বলেন, আমরা গ্রামে থাকায় এখানে তেমন কোনো কর্মসংস্থান নেই। আমরা বাড়ির কাজ করেও কিছু টাকা উপার্জন করি। কারণ পরিবারের একজনের আয় দিয়ে প্রয়োজন মেটানো কঠিন হয়। এখন আমরা এই সময়ের অপেক্ষায় থাকি কারণ বিনাহালে রসুন বপন করে আমরা প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পাই। তাতে করে বেশ কিছুদিন কাজ করলে বাড়তি আয় হয়। আবার রসুন জমি থেকে তোলার পর আমাদেরই বাছাইয়ের জন্য কাজ দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে এমন চাষ পদ্ধতি আমাদের ভালো একটা আয়ের উৎস।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তিন হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বিনাচাষে রসুন আবাদ করে ৩৭ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছিল। গড় ফলন ছিল ৯ দশমিক ৬৫ মেট্রিক টন। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে চার হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ এবং ৪৭ হাজার ৯১৫ মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
পাবনা জেলার মধ্যে চাটমোহর উপজেলাতেই কেবল এই পদ্ধতিতে (বিনাহালে) রসুনের আবাদ হয়। পাশের জেলা নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া, তাড়াশ উপজেলাতেও এই পদ্ধতিতে রসুন চাষ হয়।
উপজেলার ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের বালুদিয়ার গ্রামের কৃষক জিয়াউল হক জানান, পাঁচ বিঘা জমিতে তিনি বিনাহালে রসুন আবাদ করেছেন। আমন ধান কাটার পর জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার করে জমি ভেজা বা কাঁদা মাটি থাকতেই প্রতি এক বিঘা জমিতে ৩০ কেজি টিএসপি, ২৫ কেজি পটাশ এবং ১৫ কেজি জিপসাম সার ছিটিয়ে পরের দিনই সারিবদ্ধভাবে বীজ রোপণ রসুন করতে হয়। এক বিঘা জমিতে দুই মণ বীজ লাগে। বীজ রোপণ করার পরই খড় বা বিচালি দিয়ে পুরো জমি ঢেকে দিতে হয়। এক মাস পর পানি সেচ দিয়ে ১০ কেজি ইউরিয়া সার দিতে হয় বিঘাপ্রতি। এই পদ্ধতিতে রোগ বালাই নেই বললেই চলে। ১০০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে ওঠে। বিঘাপ্রতি উৎপাদন ২৫ থেকে ৩০ মণ পর্যন্ত হয়।
উপজেলার বিলচলন ইউনিয়ন বোঁথর গ্রামের কৃষক আরিফুল ইসলাম জানান, এ বছর সাত বিঘা জমিতে তিনি বিনাহালে রসুন আবাদ করেছেন। এক বিঘা জমিতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। তবে কৃষিশ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় খরচও বেড়েছে। তার পরও দাম কম হলেও ৬০ হাজার টাকার রসুন বিক্রি করা হয়। দাম বেশি হলে লক্ষাধিক টাকার বেশি পাওয়া যায়।
পক্ষান্তরে আমনের আবাদ শেষে বেশ কিছুদিন মাটি কর্দমাক্ত থাকায় কাঙ্ক্ষিত রবিশস্য চাষ করা সম্ভব হয় না। যার ফলে জমি পতিত পরে থাকে সেই সময়টাকেই কাজে লাগিয়ে আবাদ করা হচ্ছে তাতে করে এ চাষে বাড়তি আয়ের সম্ভাবনাও দেখছে কৃষক। দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালনে অংশীদার হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ কুন্তলা ঘোষ বলেন, বিনা হালে রসুন আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন এ অঞ্চলের কৃষক। সঠিক ব্যবস্থাপনা ও কৃষকদের সহযোগিতা পেলে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

এ বি এম ফজলুর রহমান, পাবনা