প্রাণঘাতী রোগ গুলেন বেরি
আমার খুব কাছের এক বন্ধুর আত্মীয় মারা যান বছর বিশেক আগে। ঘটনাটা ছিল এ রকম যে, হঠাৎ করেই তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেন। ডায়রিয়া ভালো হয়ে গেলেও অন্য সমস্যা দেখা দিল। তার দুই পায়ে শক্তি কম পাচ্ছেন। শুরুতে কষ্ট করে হাঁটতে পারলেও কয়েকদিন পর অবস্থা খুব খারাপ হলো। ভাবলেন, হয়তো বা ডায়রিয়াজনিত দুর্বলতা থেকে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। ভালো ভালো খাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকল।
ধীরে ধীরে অবশ ভাব ওপরের দিকে উঠে আসতে থাকল। হঠাৎ করে তিনি লক্ষ করলেন, তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তখন আর দেরি করলেন না। চিকিৎসকের কাছে গেলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর, সে সময় ঈদের ছুটি চলছে। অনেক কষ্ট করে একজন চিকিৎসককে দেখালেন। চিকিৎসক তাঁকে দ্রুত আইসিইউতে ভর্তি করতে বললেন। কিন্তু আইসিইউতে সিট না পাওয়ায় তাঁকে ওয়ার্ডে ভর্তি থাকতে হলো। কিছুক্ষণ পর তা শ্বাসকষ্ট মারাত্মক আকার ধারণ করল। কোনো ব্যবস্থা কাজে লাগল না। অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনি।
প্রাণঘাতী এক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। এই রোগের নাম গুলেন বেরি সিন্ড্রোম। সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন বা ডায়রিয়ায় আক্রান্তের পর এক থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে এ রোগ দেখা দেয়। তবে সব ধরনের শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন বা ডায়রিয়ায় এটি হয় না। দেখা গেছে, ক্যামপাইলোব্যাকটার-জনিত ডায়রিয়া বা সাইটোমেগালো ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা ব্যাকটেরিয়াজনিত শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশনের পরই গুলেন বেরি সিন্ড্রোম দেখা দিতে পারে। বলা হয়, এ অণুজীবগুলোর বিরুদ্ধে দেহ অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এ পদার্থগুলো অণুজীবের পাশাপাশি দেহের স্নায়ুতন্ত্রের সোয়ান কোষের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে। ফলে স্নায়ুর আবরণ মাইলিন সিথ ধ্বংস হয়ে যায়। এতে করে স্নায়ু বা নার্ভ কোনো কাজ করতে পারে না। দেখা দেয় মাংসপেশির দুর্বলতা। শুরুতে দূরের মাংসগুলো যেমন- পা দুর্বল হয়ে পড়ে। পরে ধীরে ধীরে তা ওপরের দিকে উঠতে থাকে এবং একসময় শ্বাস-প্রশ্বাসের জড়িত ডায়াফ্রামকে আক্রান্ত করে। ডায়াফ্রাম আক্রান্ত হলেই দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। শ্বাসতন্ত্র অকেজো হয়ে মারা যান অনেকেই।
এটাই এ রোগের মারাত্মক দিক। সাধারণত এক থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত মাংসপেশির দুর্বলতা চলতে থাকে। এ সময় পর ধীরে ধীরে দুর্বলতা কাটতে থাকে। নার্ভ কনডাকশন ভেলোসিটি (এনসিভি), ইএমজি করে এ রোগ বোঝা যায়। এ ছাড়া সিএসএফ স্টাডি করেও এ রোগ নিশ্চিত হওয়া যায়।
এ রোগে আক্রান্ত হলে খুব সচেতন হতে হয়। যখন মাংসপেশির দুর্বলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন খেয়াল রাখতে হয় শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছে কি না। যদি শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়, তাহলে দেরি না করে দ্রুত কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, এ রোগে আক্রান্ত শতকরা ৪০ ভাগের আর্টিফিশিয়াল শ্বাসপ্রশ্বাসের দরকার হয়। এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। এ রোগের চিকিৎসা আছে। এ রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসকরা উচ্চমাত্রার স্টেরয়েড দিয়ে থাকেন। কারো কারো ক্ষেত্রে প্লাজমাফেরেসিস করতে হয়। শরীরের রক্ত বের করে মেশিনের মাধ্যমে অ্যান্টিবডি মুক্ত করে আবার শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এ ছাড়া ইমিউনোগ্লোবিন ইনজেকশন আকারে দেওয়া হয়।
এ রোগে আক্রান্তের বেশির ভাগই সুস্থ হয়ে যান। কারো কারো ক্ষেত্রে কম সময় লাগলেও কারো ক্ষেত্রে বেশ সময় লাগতে পারে। সুস্থদের মধ্যে কারো আবার মাংসপেশি দুর্বলতা থেকেই যায়। এ জন্য নিয়মিত ফিজিওথেরাপি করতে হয়।
ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।