পায়ুপথের রক্তক্ষরণের কারণ ও চিকিৎসা

পায়ুপথের রক্তক্ষরণ আমাদের দেশে বেশ প্রচলিত সমস্যা। সাধারণত দুটো কারণে এই রোগ দেখা দেয়। পাইলসের জন্য এবং বাউয়েল ক্যানসারের জন্য। আজ ১২ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৬৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দ্য রয়েল কলেজ অব সার্জনস অব ইংল্যান্ডের কনসালটেন্ট কোলোরেকটাল সার্জন অধ্যাপক রাবিবুল আনোয়ার।
প্রশ্ন : পায়ুপথের রক্তক্ষরণের প্রধান কারণগুলো কী কী?
উত্তর : সাধারণভাবে দেখা যায় যেকোনো দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ পায়ুপথের রক্তক্ষরণে প্রতিবছর ভুগে থাকে। ওই ভাবে যদি আমরা চিন্তা করি, যুক্তরাজ্যে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ। যদিও বাংলাদেশে সে রকম না। বাংলাদেশে যুবসমাজ বেশি। তবে বাংলাদেশেও প্রায় ৫০ ভাগের বেশি জনসংখ্যা প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁদের বছরে একবার পায়ুপথের রক্তক্ষরণ হতেই পারে এবং হয়ও। পায়ুপথের রক্তক্ষরণ প্রচলিত, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা মারাত্মক রোগের উপসর্গ। প্রচলিত যেগুলো হয়, যেমন পাইলস। তা ছাড়া রক্তক্ষরণের অন্যান্য কারণগুলো হচ্ছে ফিসার। তবে পায়ুপথের ওপরের দিকে যেই সমস্যাগুলো হয় তার ভেতরে বাউয়েল ক্যানসার হলো সবচেয়ে মারাত্মক অসুখ। যদিও ইনফ্লামেটরি বাউয়েল রোগ যে রকম, তেমনি আলসারিভ কোলাইটিস বা ক্রনস ডিজিজ এগুলোতেও পায়ুপথ দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। আর ডাইভাটিক্যাল ডিজিজ নামে আরেকটি অসুখ আছে, তা ছাড়া পাকস্থলী এবং আপার স্মল বাউয়েল থেকেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। এর ফলে পায়ুপথ দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়।urgentPhoto
প্রশ্ন : কী কারণে হচ্ছে সেটি বোঝার কি কোনো উপায় রয়েছে?
উত্তর : পায়ুপথের রক্তক্ষরণকে কখনো এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সেটার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শের খুবই প্রয়োজন আছে।
প্রশ্ন : তার মানে একজন মানুষ যখন দেখছে, তার মলের সঙ্গে রক্তক্ষরণ হচ্ছে ওই সময়টিতেই কি তার উচিত হবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া?
উত্তর : যদি কোনো গুরুতর কারণের জন্য সমস্যাটি হয়ে থাকে সেটা সাধারণ মানুষের কাছে বোঝাটা কঠিন হবে। যে জন্য পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্তক্ষরণ হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : আপনাদের কাছে যখন এই জাতীয় সমস্যা নিয়ে একজন রোগী আসে, তখন কী করেন?
উত্তর : যেকোনো রোগীর জন্যই এটা প্রযোজ্য, যখন একটা রোগী আসে তার কাছে তার ইতিহাস জেনে নেই। রোগের লক্ষণ বা রোগীর রক্ত কতটুকু যাচ্ছে, কী রং, পায়খানার সঙ্গে রক্ত মিশে আছে না কি আলাদা আছে, অন্যান্য উপসর্গ কী আছে এরকম পায়খানার কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না। আগে স্বাভাবিক ছিল, এখন নরম হচ্ছে বা কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে যাচ্ছে এসব উপসর্গগুলো জানার চেষ্টা করা হয়। এরপর পরিবারের ইতিহাস নিতে হয়, যে পরিবারে তাদের বাউয়েল ক্যানসারের কোনো ইতিহাস আছে কি না। এগুলো নেওয়ার পরে তখন পরীক্ষা করতে হয়। এবং পরীক্ষার দুটো জিনিস দেখতে হয়। পেটে কোনো লাম্প আছে কি না, সেটা দেখতে হয়। আরেকটা জিনিস হলো পায়ুপথে গ্লাভস পরা আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। মানুষ হয়তো এটা করতে লজ্জা বোধ করে। আর সঠিকভাবে না করলে এর ফলে ব্যথার সৃষ্টি হয়। তো সাধারণ মানুষ লজ্জার জন্য বা ব্যথা পাবে এই ভয়ে এই পরীক্ষা করতে চায় না।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে এটাই প্রধান কারণ যে এই জাতীয় অসুবিধাগুলোতে রোগীদের চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ার। এর ফলে রোগটি যে জটিল হয়ে যাচ্ছে, সেটি আর তারা বুঝতে পারে না। পায়ুপথের রক্তক্ষরণ যে জটিল দিকে যাচ্ছে সেটি আসলে বোঝার উপায় কী? কী কী উপসর্গ এই রক্তক্ষরণের পাশাপাশি হতে পারে?
উত্তর : শুধু রক্তক্ষরণই একটি জটিল রোগের উপসর্গ হিসেবে দেখা দিতে পারে। এবং সেই জন্যই শুধু রক্তক্ষরণ হলেও আরো অগ্রগতিপূর্ণ পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। বিশেষ করে যদি পরিবারের ইতিহাস থাকে, যদি বয়স একটু বেশি হয়। বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যের জনগণের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি তরুণ বয়সের লোকদেরও বাউয়েল ক্যানসার হচ্ছে। তারপরও যদি যেকোনো বয়সের মানুষের অনেক রক্তক্ষরণ হতে থাকে বা ঘন ঘন রক্ত ঝরতে থাকে, অথবা যদি রক্তের রং গাঢ় লাল হয়, পায়খানার সঙ্গে যদি মিশে থাকে-এই বিষয়গুলোর জন্য বেশি পরীক্ষা করতে হয়। যে রকম কোলোনোস্কপি। এটি খুব ভালো পরীক্ষা। তবে যেটা বললাম অনেক ব্যক্তির এই সমস্যা হয়, তবে কি আমরা সবাইকেই কোলোনোস্কপি করব? না।
প্রশ্ন : তাহলে কাদের ক্ষেত্রে কোলোনোস্কপি করতে হবে সেটি আপনারা কীভাবে নির্ধারণ করেন?
উত্তর : যাদের পারিবারিক ইতিহাস আছে, এনিমিয়া আছে সেই একটা সাবগ্রুপকে অবশ্যই কোলোনোস্কপি করার দরকার আছে।
প্রশ্ন : তারপর আপনারা যদি নিশ্চিত হন রক্তক্ষরণ হয়েছে। এরপর চিকিৎসা কীভাবে নির্ধারণ করেন?
উত্তর : সম্পূর্ণ নির্ভর করবে রোগ নির্ণয়ের ওপর। যদি পাইলস হয়, এর আলাদা গ্রেড আছে, সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। অনেক সময় অস্ত্রোপচার লাগে। অনেক সময় অস্ত্রোপচার না করেও পাইলসের চিকিৎসা করা যায়। পাশাপাশি যদি বাউয়েল ক্যানসার হয়, তাহলে প্রথম দেখতে হবে কোন পর্যায়ে সে আছে এই বিষয়টি। বাউয়েল ক্যানসারের চারটি পর্যায় আছে। প্রথম পর্যায়ে ধরা পড়লে অস্ত্রোপচার করা হলে সম্পূর্ণ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে জন্য আগে রোগটি নির্ণয় করা প্রয়োজন। সেই জন্যই যখন পায়ুপথে রক্তক্ষরণ হয়, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন : সঠিক সময়ে যদি চিকিৎসা না করা হয়, তবে কী কী ধরনের জটিলতা হতে পারে? এবং সেটি কতখানি মারাত্মক হতে পারে?
উত্তর : আমি মূলত দুটো জিনিসের ওপর গুরুত্ব দেব। কারণ বাংলাদেশে এই দুটো জিনিসই প্রচলিত। একটা হলো পাইলস হওয়া। এর যদি ঠিকমতো চিকিৎসা করা না হয় তবে এর অনেক জটিলতা হতে পারে। পাইলস থেকে গ্যাংরিন হতে পারে। পাইলস থেকে পোর্টাল পাইয়েমিয়া হতে পারে; সমস্যাটি লিভার পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে। যদি রোগের উপসর্গ থাকে, রক্ত যেতে থাকে তবে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। তবে দুভাবেই চিকিৎসা করা যেতে পারে। অস্ত্রোপচার করে অথবা না করে।
আর ক্যানসারের জটিলতা তো মারাত্মক। কারণ যদি প্রাথমিক পর্যায়ে না ধরা যায় বা শেষপর্যায়ে ধরা পড়ে তাহলে তো মানুষ বাঁচতে পারবে না। যদিও সব পর্যায়েরই চিকিৎসা আছে। চিকিৎসার ব্যয়ভারও নির্ভর করবে কোন পর্যায়ে ধরা পড়ছে এর ওপর। একটা অস্ত্রোপচার করলে সেটা শেষ হয়ে যেতে পারে। সেটার জন্য দেখা যায় যে কেমোথেরাপি দিতে হবে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে রক্ত বের হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।