ল্যাপারস্কোপিক সার্জারি কেন করা হয়
ল্যাপারস্কোপিক সার্জারি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। পেটে ছোট তিনটি বা চারটি গর্ত করে, বিশেষ ক্যামেরা প্রবেশ করিয়ে এই সার্জারি করা হয়। আজ ১৩ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৬৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সরদার এ নাইম।
প্রশ্ন : ল্যাপারস্কোপিক সার্জারি খু্ব জনপ্রিয়। সবাই কম বেশি জানে বিষয়টি নিয়ে। আমরা জানি ল্যাপারস্কোপিক সার্জারিতে আপনি পথিকৃত। এ দেশে প্রথম যে সার্জারিটি হয়েছে সেটি আপনার মাধ্যমেই হয়েছে। ল্যাপরস্কোপিক সার্জারি বলতে আসলে কী বুঝায়?
উত্তর : ল্যাপারস্কোপিক সার্জারির অর্থ হলো পেটের মধ্যে ক্যামেরা ঢুকিয়ে যে সার্জারি করা হয়। ল্যাপারো কথার অর্থ হলো পেট । ল্যাপারোটমি বলতে আমরা পেটকে খোলা বা কাটা বুঝাই। আর স্কোপ হলো, মাইক্রস্কোপে যেমন ছোট জিনিস দেখা যায়, টেলিস্কোপে দূরের জিনিস দেখা যায় তেমনি ঠিক ল্যাপারস্কোপ মানে পেটের মধ্যে ক্যামেরা দিয়ে দেখা। ল্যাপরস্কোপির সার্জারির সংজ্ঞাটা হলো ক্যামেরার সাহায্যে সার্জারি করা। আমরা ক্যামেরা দিয়ে সরাসরি দেখে তো আর করি না। ক্যামেরা পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিই। পেটের মধ্যে খুব ছোট ছোট চারটা গর্ত করি। এটা গল্ডব্লাডার সার্জারির জন্য। এপেনডিকসের জন্য আবার তিনটা করি। একটি ক্যামেরা ঢুকানোর জন্য যদি আমরা বোর্ড করি, একটি ট্রকার দিয়ে ক্যামেরা ঢুকিয়ে দিই তাহলে পেটের ভেতরের সব অঙ্গ প্রতঙ্গগুলোকে সুন্দরভাবে দেখতে পাই। সাধারণ টেলিভিশন মনিটরে দেখা যায়। সেই কাজটা তখন আমরা সুন্দরভাবে করতে পারি।urgentPhoto
যেই কাজটা এত দিন পেট কেটে দেখে করতে হতো, সেটা করতে হয় না। ল্যাপারস্কোপির সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্জারি ল্যাপারস্কোপিক্যাল সিস্টেকটোমি। অর্থাৎ গল্ডব্লাডার বা পিত্তথলির সার্জারি। ল্যাপারস্কোপি আসার আগে পিত্তথলির সার্জারি পেট কেটে করতে হতো। পিত্তথলিতে পাথর আছে , টিউমার আছে, পলিপ আছে । পিত্তথলিটাকে পাথরসহ ফেলে দিতে পারে। সেটা ফেলতে হলে তো পেটের ভেতরে দেখতে হবে। না দেখেতো ফেলতে পারব না। এই দেখার জন্য আগে আমাদের যেটা করতে হতো পেটের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত লম্বা করে কাটতে হতো। এখন আর কাটার প্রয়োজন হয় না। একই কাজ আমরা ক্যামেরার সাহায্যে দেখি। এতে সুবিধা হলো, পেট কাটার দরকার হয় না। ছোট ছোট চারটি গর্ত করেই আমরা এই কাজটা করে ফেলতে পারলাম।
এই দেখাটা পেট কেটে আমরা যেভাবে করি তার থেকে ভালোভাবে করা যায়। আমি একটা উদাহরণ দিই সবসময়। মাইক্রোভিডিও ক্যামেরা দিয়ে মশাকেও আমরা হাতির সমান দেখাতে পারি। কারণ জিনিসটা বড় করে দেখা যায়, জিনিসটা ম্যাগনিফাইড করে আসছে। ল্যাপরেস্কোপির মাধ্যমে সুন্দর করে পিত্তথলি ম্যাগনিফাইড করে দেখতে পারি। ওটাকে ফেলতে আমাদের অনেক সহজ হয়। তবে এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে।
প্রশ্ন : পেট কেটে সার্জারি আর ল্যাপরস্কোপির সুবিধা- এর মধ্যে পার্থক্যটা কী? সুবিধা কোথায়?
উত্তর : দুটো সার্জারির ধরনই বলে দেয় আমাদের সুবিধাটা কী। যেমন একটি সার্জারি করার জন্য কমপক্ষে সাত ইঞ্চি বা আট ইঞ্চি বড় ইনসিশন দিয়ে কেটে করা হয়। ইনশিসন কেবল চামড়ায় নয়। চামড়ার নিচে পেশি, চর্বি সব জায়গায় কেটে তার পর পেটের মধ্যে গিয়ে করা হয়। আর ল্যাপারসস্কোপিতে শুধু ছোট ছোট চারটি পাংচার করলেই হয়। মাত্র ৫ মিলিমিটারের তিনটি এবং একটি ১০ মিলিমিটারের পাংচার হুল দিয়ে আমরা যখন পিত্তথলির পাথরসহ নিয় আসি তখন রোগী একদিন পরে বাড়ি চলে যেতে পারে।
যদিও ব্যথার বিষয়টি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি নির্ভর করে। তবে ল্যাপারস্কোপিতে ব্যথা নেই বললেই চলে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ মিলিমিটারের গর্তে ব্যথা অনেক কম হয়। রোগী একদিন পরই বাড়ি চলে যেতে পারে এবং স্বাভাবিক কাজে ফিরতে পারে তিন দিনের মাথায়। আর যদি কেটে করি তবে রোগী দুই সপ্তাহ থেকে ছয় সপ্তাহ পরে কাজে ফিরবে।
সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক কমে যায় ল্যাপারস্কোপিতে । আর সাধারণ সার্জারিতে সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যায় এবং ব্যথা অনেক বেশি হয়। পেটের কাটা আর না কাটার মধ্যে তফাৎ হলো কসমেটিকের উপকারিতা। আপনি জানেন তরুণীরা পেটে অনেক বড় একটি অস্ত্রোপচারের দাগ থাকুক তা চায় না। তাই আমি বলব এই প্রজন্মের জন্য ল্যাপারস্কোপিক সার্জারি আশীর্বাদ। কারণ অত বড় করে কেটে যেটা করতে হতো সেটা এখন না কেটেই আমরা করতে পারি।
প্রশ্ন : ল্যাপারস্কোপিক সার্জারি কোন কোন ক্ষেত্রে করা হয় সেটি আপনি অনেকটা বলেই দিয়েছেন। আর কোন কোন ক্ষেত্রে এই সার্জারি করা যায়। ল্যাপারস্কোপ বা এই ধরনের ক্যামেরা দিয়েই এখন শরীরের প্রায় সব অংশেই কাজ হয়। সাধারণ সার্জারিতে যেমন গল্ডব্লাডার, এপেনডিক্স, হার্নিয়া করা যায়, তেমনি ল্যাপারস্কোপিতেও এখন সব সার্জারি করা হয়। গাইনির প্রায় সব সার্জারি ল্যাপারস্কোপির মাধ্যমে হয়। যেমন : ওভারিয়ান সিস্ট, চকলেট সিস্ট, সিম্পল সিস্ট , হিসট্রেকটমি সব ল্যাপারেস্কোপির মাধ্যমে করা যায়।
তেমনি ইউরোলজিস্টরা ইউরোলজিক্যাল সব সার্জারিগুলো এই ক্যামেরা ট্যাকনোলোজি দিয়ে করছেন। এমনকি মস্তিস্কের সার্জারিও হচ্ছে।
একটা সময় ছিল, কে কত বড় সার্জন এ বিষয়ে বলা হতো, যার যত বড় ইনসিশন সে তত বড় সার্জন। এখন যে যত ছোট করে কেটে রোগীকে সর্বোচ্চ উপকারিতা দিতে পারবে সে তত বড় সার্জন। পরবর্তী প্রজেন্মের কেউই নিজেকে বড় সার্জন বলতে পারবে না যদি ল্যাপরস্কোপির জ্ঞান না থাকে।
প্রশ্ন : একটি অভিযোগ শোনা যায় ল্যাপারস্কোপি সার্জারিতে খরচটা একটু বেশি। এটি কেন?
উত্তর : আসলে ল্যাপারস্কোপিতে কিছু যন্ত্রপাতির ব্যবহার করা হয় । এটি পুরোটাই একটা প্রযুক্তি নির্ভর সার্জারি। সাধারণ সার্জারির যন্ত্রপাতির থেকে এখানে কিছু বাড়তি বিষয় লাগে। ল্যাপারস্কোপি সার্জারিতে ব্যবহারের জন্য ক্যামেরা, আলোর উৎস (লাইট সোর্স), মনিটর এগুলো খুব দামি। তাই একটু বাড়তি টাকা-পয়সার চাপ হয়। কিন্তু দিন শেষে আমি বলব ল্যাপরস্কোপিক সার্জারি সস্তা, অন্য সার্জারির তুলনায়। তার কারণ হাসপাতালের থাকার সময় কমে যাচ্ছে। কারণ যে রোগীটা সাত দিন হাসপাতালে থাকবে তাকে যে টাকাটি দিতে হবে সেটা যদি ল্যাপারস্কোপিতে খরচ করে তবে প্রায় সমান টাকাই খরচ হবে।
আর আমাদের দেশে দ্রুত কাজে ফিরে যাওয়া আর্থিকভাবে জরুরি। যেই রোগী অফিসে না গেলে আয় করতে পারবে না। সে যত তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে ততই ভালো। সুতরাং সার্বিকভাবে চিন্তা করলে এই সার্জারি যন্ত্রপাতির কারণে ব্যয়বহুল মনে করলেও উপকারিতা বেশি।