শ্বেতী রোগের ক্ষতি
শ্বেতী রোগে ত্বকের বিভিন্ন জায়গা সাদা হয়ে যায়। শ্বেতী রোগে শরীরে তেমন কোনো সমস্যা না হলেও রোগীকে মনোসামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আজ ১৪ জুন, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৬৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট অ্যাসথেটিক ডার্মাটোলজিস্ট লেজার ট্রিটের প্রধান পরামর্শক, লেজার বিশেষজ্ঞ ডা. সকোর মাহবুব আহম্মেদ শামীম।
প্রশ্ন : শ্বেতী রোগে আমরা জানি, ত্বকের বিভিন্ন জায়গা সাদা হয়ে যায়। অনেকেরই হয়। এটা হয় কেন এবং কারা ঝুঁকিপ্রবণ?
উত্তর : আসলে কারণটা আমরা কেউই জানি না। তবে শ্বেতীটা কীভাবে হচ্ছে, এর প্রকারভেদ কী রকম—এ বিষয়গুলো আমরা জানতে পেরেছি। এর যেহেতু মূল কারণটা অজানা, তাই এটি একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। সারা বিশ্বের জনসংখ্যার এক ভাগ এই রোগে ভুগে থাকেন। তবে এ নিয়ে বেশি সচেতন আমরা, যাঁরা কালো মানুষ বা বাদামি মানুষ, তাঁরা। যাঁরা সাদা রঙের মানুষ, তাঁদেরও অনেক শ্বেতী হয়, সেটা বোঝা যায় না। সে জন্য এ নিয়ে তাঁরা খুব বেশি সচেতন নন। এটা কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। শুধু ত্বকের ভেতরে যে মেলানোসাইট আছে, যেটা থেকে আমাদের রংটা বের হয়, পিগমেন্ট বের হয়, সেটা যদি কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায় অথবা কাজ করা বন্ধ করে দেয়, মেলানিন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়, তখনই শ্বেতীর সৃষ্টি হয়। মানে সাদা ছোপ ছোপ দাগ তৈরি হয়।urgentPhoto
এটা অনেকভাবে হতে পারে। একটি হলো জেনারেলাইজড শ্বেতী (ভিটলিগো), আরেকটি হলো ফোকাল শ্বেতী। তা ছাড়া ইউনিভার্সেল শ্বেতী আছে। এটার মধ্যে আবার প্রকারভেদ আছে, যেমন—লিপটিপ শ্বেতী বা এক্রোফেসিয়াল ভিটলিগো, যেটা প্রান্তীয় অঞ্চলে হয়। ঠোঁটে, হাতে, পায়ের আঙুলের ডগায় হতে পারে; পায়ে হতে পারে। আরেক ধরনের শ্বেতী আছে, যাকে বলে সেগমেন্টাল শ্বেতী। যেটা একটা অংশে হয়। শরীরের কোনো একটি পাশে হয়।
প্রশ্ন : শ্বেতী রোগ হওয়ার সঙ্গে কোনো ঝুঁকির কারণ জড়িয়ে আছে কি না কিংবা কারো কারো ক্ষেত্রে খাবারের বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ আছে কি না?
উত্তর : এটার আসলে তেমন কোনো বিষয় নেই। কারণগুলোর কিছু অনুসিদ্ধান্ত (হাইপোথিসিস) আছে। এক নম্বর হচ্ছে, এটি একটি অটোইমিউন ডিজঅর্ডার। আমাদের শরীরে যে বিভিন্ন রকমের কোষ আছে, লিম্ফোসাইড আছে, এটি মেলানোসাইটগুলো ধ্বংস করে দেয়। এটি সবচেয়ে পরিচিত হাইপোথিসিস। আরো দুটো আছে, মেলানোসাইটের যে স্নায়ুর পরিবহন আছে, সেটার কোনো একটা তারতম্যের কারণে মেলানোসাইট ধ্বংস হয়। আরেকটি হলো সেল্ফ ডিসট্রাকশন মেথড। কোনো অজানা কারণে ভেতরে মেলানোসাইটগুলো নিজে নিজে ধ্বংস হয়ে যায়। এ ছাড়া আরো কিছু বিষয়ের কারণে হতে পারে। যেমন—জেনেটিক কারণে হতে পারে। মা-বাবার কারো যদি শ্বেতী থাকে, তার ১০ শতাংশ আশঙ্কা থাকে কোনো এক বাচ্চার। আর যদি পুরো পরিবারে কারো থাকে, তবে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ রকম হতে পারে।
আরেকটি হচ্ছে, কখনো কখনো সূর্যের আলোর কারণে হতে পারে। আবার খুব চাপের কারণেও হতে পারে। তা ছাড়া আরেকটি ধরন আছে, যাকে কেমিক্যাল ভিটিলিগো বা লিউকোডার্মা বলি। কোনো কারণে, কোনো রোগের ফলে সাদা হয়ে যেতে পারে। তাই কারণগুলো অনেকটা এ রকমই। মূল কারণটা আমরা জানতে পারি না।
প্রশ্ন : শ্বেতী হলে ক্ষতি কী? এটি কি ব্যথা বা অন্য কোনো প্রভাব ফেলে শরীরের ভেতরে?
উত্তর : কেবল কসমেটিক সমস্যা হয়। দেখতে খারাপ দেখায়। আর যদি অন্যভাবে চিন্তা করি, তবে মেলানোসাইট থেকে মেলানিন বের হয়। সেই মেলানিনটা ত্বককে অতি বেগুনি রশ্মি (আলট্রাভায়োলেট) থেকে সুরক্ষা দিয়ে রাখে। এখন যদি সারা শরীরে শ্বেতী হয়ে যায়, তাহলে রোগ বাঁচিয়ে চলতে হবে। না হলে অতি বেগুনি রশ্মির ফলে ত্বকে সমস্যা হতে পারে। সমস্যা বাড়তে পারে। তবে মূল সমস্যা হলো সামাজিক এবং দেখতে খারাপ লাগা।
প্রশ্ন : একজনের এই রোগ হলে তাঁর কোনো শারীরিক সমস্যা হয় না। তবে সামাজিকভাবে সমস্যা হয়, বিয়েতে সমস্যা হয়, তাঁর মানসিক ও সামাজিক সমস্যা বড় হয়ে দেখা দেয়। এ বিষয়ে কী বলবেন?
উত্তর : আপনি জানেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে শ্বেতীর আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর কাজ করছি। এবং কখনো কখনো একদিনে ১০০ শ্বেতী রোগীও দেখতাম আমরা। এই রোগীদের সঙ্গে দিনের পর দিন ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে। সপ্তাহে দুবার-তিনবার করে তাঁরা আমার কাছে আসেন, বছরের পর বছর। তাই তাঁদের খুব কাছ থেকে যেটা বুঝেছি, তাঁদের মনের কষ্ট যেটা, সেটা অনেক বেশি। কারণ, তাঁকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। পরিচিত মানুষ হয়তো বাদ দিয়ে, কোনো জায়গায় গেলে তাঁকে একটা হলেও এ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এই প্রশ্নের ভয়ে অনেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন, আড়াল করে ফেলেন। বিয়েশাদিতে তো সমস্যা হয়ই অনেকের। এমনকি উচ্চশিক্ষিত মানুষকেও দেখেছি, যাঁর শ্বেতী আছে, তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে চান না অনেকে; কোলাকুলি করতে চান না বা বিয়ে দিতে চান না এই পরিবারে। অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে শ্বেতীকে ‘ধবন কুষ্ট’ নামে ডাকা হয়। সুতরাং তাঁদের মনের যন্ত্রণা বেশি।
প্রশ্ন : যদি পরিবারে থাকে, তবে অন্য কারো শ্বেতী হওয়ার আশঙ্কা কত?
উত্তর : ১০ শতাংশ শিশুর শ্বেতী হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আর যেই পরিবারে শ্বেতী আছে, সেটা এক অথবা দুই প্রজন্ম পরেও শ্বেতী বহন করে।
প্রশ্ন : অনেককে বলতে শোনা যায়, শ্বেতী পুরোপুরি ভালো হয় না। আসলে বিষয়টি কী?
উত্তর : কথাটা অনেকাংশে সত্য। কিছু কিছু ধরনের শ্বেতী ভালো করা খুব কঠিন, যেমন : এক হলো, সেগমেন্টাল ভিটলিগো। আরেকটি হলো লিপটিপ ভিটলিগো বা এক্রোফেশিয়াল ভিটলিগো, সেসব জায়গায় চিকিৎসা খুব ধীরে ধীরে হয় এবং পুরোপুরি ভালো করা সম্ভব হয় না। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, আমরা যাঁরা ডার্মাটোলজিস্ট, তাঁরা যদি একটু খেয়াল করি লোমগুলোর রঙের পরিবর্তনের দিকে, লোমগুলো সাদা হয়েছি কি না সেদিকে, যদি সাদা না হয় তবে ভালো হওয়ার আশঙ্কা অনেক। কারণ আপনি জানেন, লোমগুলো যদি কালো থাকে, তবে মেলানোসাইট কার্যকর। সুতরাং এখানে চিকিৎসা করলে মেলানিন বের হওয়ার আশঙ্কা বেশি। বিশেষত, অল্প বয়সে শ্বেতী হলে ভালো হয়ে যায়।
শুধু যেসব জায়গায় লোম নেই, যেমন—ঠোঁটে, হাতের পাতায় লোম নেই, এই জায়গাগুলো দেরিতে ভালো হয়।
প্রশ্ন : ভালো যাঁরা হন, তাঁদের কী ধরনের চিকিৎসা দিয়ে ভালো করেন?
উত্তর : আমরা চিকিৎসা দুইভাবে করি। একটি মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট, আরেকটি সার্জিক্যাল। আরেক ধরনের হলো ডি পিগমেনটিন ট্রিটমেন্ট।
এখন মেডিক্যাল চিকিৎসার জন্য কাদের আমরা নির্ণয় করব। ছোট ছোট জিনিস থাকে, খুব অল্প, ১০ সেন্টিমিটার—এ রকম হলে মেডিক্যাল চিকিৎসাতেই ভালো হয়ে যায়।
তার আগে আরেকটি বিষয় বলি, কীভাবে রোগটি নির্ণয় করব। এটা খুব সহজ একটি পরীক্ষা। একটা উডস ল্যাম্প পরীক্ষা আছে। একটি ল্যাম্প আছে, যেটা দিয়ে অন্ধকার কক্ষে গিয়ে দেখতে হয়। তা ছাড়া যদি কোনো সন্দেহ থাকে, আমরা ত্বক বায়োপসি করে থাকি। আরো কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করি।
প্রশ্ন : একটু চিকিৎসা সম্বন্ধে যদি বলেন?
উত্তর : মলম দিয়ে চিকিৎসা করি। স্টেরয়েড ক্রিম আছে, সেটার ব্যবহার করতে পারি।
সবচেয়ে ভালো যে চিকিৎসা, সেটা হলো ফটোথেরাপি। একে আগে পুবাথেরাপি বলা হতো। এখানে আগে একটি ওষুধ খেতে দিতাম, এর পর ইউভিএ দিতাম, যেটা হচ্ছে ব্রড বেন ফটোথেরাপি। এখন আধুনিক যেটা বের হয়েছে একে বলে ন্যারো বেন ফটোথেরাপি। সেটা সপ্তাহে দুবার-তিনবার করে ছয় মাস, এক বছর করা হলে অনেক ভালো হয়ে যায়। এবং এতে পয়সা খরচ হয় অল্প।
প্রশ্ন : সার্জিক্যাল চিকিৎসার ক্ষেত্রে কী করে থাকেন?
উত্তর : যদি দেখি রোগীর শ্বেতীটা বাড়ছে না, সে ক্ষেত্রে আমরা সার্জারিতে চলে যাই। অনেক সার্জারি রয়েছে। আর যদি দেখি, অনেকে ৫০ শতাংশ বা এর বেশি শ্বেতী হয়ে গেছে, তখন তাঁকে আমরা কিছু ব্লিচিং এজেন্ট দিয়ে দিই। যেই জায়গাটা কালো আছে, সেখান থেকে ত্বকটাকে সাদা করে দিই।