রোজা রাখা যাবে ইনহেলার নিয়েও
শ্বাসকষ্ট একটি পুরোনো যন্ত্রণাদায়ক রোগ। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি লোক এই রোগে আক্রান্ত। হাঁপানির সময় অনেক চিকিৎসকই ইনহেলার ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। তবে এর ভুল ব্যবহারের জন্য রোগী এর সুফল তেমনভাবে পায় না। আজ ১৭ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৬৯তম পর্বে হাঁপানি রোগ এবং তার সঙ্গে ইনহেলারের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন বিশিষ্ট বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. ইকবাল হাসান মাহমুদ।
প্রশ্ন : শুরুতে জানতে চাইব হাঁপানি বলতে কী বুঝি? এবং ইনহেলারের কী কী সম্পর্ক রয়েছে?
উত্তর : হাঁপানি খুব যন্ত্রণাদায়ক একটি শ্বাসকষ্টের রোগ। এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে এটি পুরোনো কষ্টকর এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোর শীর্ষে অবস্থার করছে। মানুষকে খুবই যন্ত্রণাদায়ক কষ্টে ফেলে। বাংলাদেশে এক কোটি লোক হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। সাধারণত এ রোগে শ্বাসনালিতে কোনো পদার্থের কারণে স্পর্শকাতরতা তৈরি হয়। তখন সেই পদার্থের সংস্পর্শে এলেই স্পর্শকাতরতা বেড়ে যায়। এবং শ্বাসনালিগুলোতে খিঁচুনি হয়। যতবার খিঁচুনি হয়, শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকবে। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়াকেই হাঁপানি বলে এবং এখানে অ্যালার্জি একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
প্রশ্ন : কোন কোন বিষয়ে এটি অতিসংবেদনশীল, সেটা বোঝা যাবে কী করে?
উত্তর : হয়তো ধরেন স্বাভাবিক লোক, সে যদি ধুলাময় পরিবেশে থাকে তার হয়তো কিছুই হবে না। আর যে লোকটির শ্বাসনালি খুবই স্পর্শকাতর, খুবই সংবেদনশীল সে একটু ধুলাময় পরিবেশে গেলেই তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাবে। অর্থাৎ সেই বিশেষ লোকটির শ্বাসনালি স্পর্শকাতর। প্রথম দিকে হয়তো একটি দুটি এলার্জির প্রতি তার স্পর্শকাতর থাকে। যখন আস্তে আস্তে ক্রনিক হয়ে যায় তখন দেখা যায় সবকিছুর প্রতি তার স্পর্শকাতরতা তৈরি হয়।urgentPhoto
একটু বেগুন খেলেই তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে বা যে ঘরে বেশি কার্পেট আছে সে ঘরে গেলে শুরু হচ্ছে বা যে ঘরে বেশি কাপড়চোপড় আছে, নাড়াচাড়া করা হচ্ছে, পুরোনো খবরের কাগজ নাড়াচাড়া করা হয়, সেই ঘরে ঢুকলেই তার হাঁচি শুরু হয়ে যাবে। চোখ দিয়ে পানি পড়বে।
একপর্যায়ে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাবে এবং সেটা প্রচণ্ড আকার ধারণ করবে। আবার এই পরিবেশ থেকে যদি তাকে মুক্ত রাখা যায় তবে দেখা যাবে সে বেশ ভালো আছে।
প্রশ্ন : পরিবারের ইতিহাসের সঙ্গে কি এর কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে?
উত্তর : হাঁপানি দুই ধরনের হয়, এটোপিক এবং নন এটোপিক অ্যাজমা। এখানে এটোপিক হয় অনেকটা বংশগত কারণে। আর যারা নন এটোপিক হাঁপানিতে ভুগছে, সেখানে অ্যালার্জি খুব একট বড় ভূমিকা রাখে না। সেখানে দেখা যায়, বিশেষ করে মধ্যবয়সী নারী যার মানসিক উত্তেজনা, মানসিক বিষণ্ণতা রয়েছে তার এ রকম হলেই শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে।
এটার সঙ্গে অনেক কিছুর সমস্যা আছে। যেমন হয়তো স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয়েছে বা স্ত্রীর-শাশুড়ির ঝগড়া হয়েছে বা একটা বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর কথাকাটাকাটি হলো-এই যে বিষণ্ণতা, এই মানসিক চাপ, এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে হাঁপানির মধ্য দিয়ে। সুতরাং কেবল অ্যালার্জিই নয়, পারিপার্শ্বিক রোগ এবং মানসিকতার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে।
প্রশ্ন : হাঁপানি মানেই ইনহেলার নিতে হবে এ রকম একটা ধারণা অনেকের মধ্যে আছে। একটা ভুল ধারণা রয়েছে, ইনহেলারের প্রতি একটা ভীতি রয়েছে রোগীদের মধ্যে। তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : আমরা এখনো পর্যন্ত চেষ্টা করেই যাচ্ছি হাঁপানির চিকিৎসা করতে হবে ইনহেলারের মাধ্যমে। প্রয়োজন হলে তো আমরা ওষুধ দেবই, ইনজেকশন দেব সেটা আলাদা কথা। রোগীদের মধ্যে একধরনের ভীতি বা স্টিগমা কাজ করে। ইনহেলার যদি একবার শুরু করে তাহলে সারা জীবন হয়তো বয়ে বেড়াতে হবে। আসলে তা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ইনহেলার প্রয়োজন হলে যে কোনো সময় শুরু করা যায়, যেকোনো সময় বন্ধ করা যায়। এর ওষুধের পরিমাণ শ্বাসনালিতে খুব কম য়ায়। সেজন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব কম এবং যেহেতু সরাসরি শ্বাসনালিতে যাচ্ছে এটা খুব দ্রুত কাজ করে। দ্রুত কাজ করার ফলে রোগী তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়।
এখানে কথা হচ্ছে, ইনহেলার হয়তো আপনি চিকিৎসাপত্রে দিয়ে দিয়েছেন, রোগীও নিচ্ছে তবে। ঠিকমতো নিচ্ছে না। সুচারুরূপে নিতে পারছে না।
আমার কথা বলি, আমি যদি কোনো রোগীকে ইনহেলার লেখি কোনো রোগীকে তখন তাকে শিখিয়ে দিই কীভাবে নিতে হবে। যদি ইনহেলারের নেওয়াটা ঠিক না হয়, তাহলে সুফল পাবে না। দোষ দেবে সেই ইনহেলারের।
তাই চিকিৎসকরা ইনহেলার যখন চিকিৎসাপত্রে লিখবেন, রোগীকে ভালোমতো বুঝিয়ে দিতে হবে যে এভাবে এটা প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে নিলে আপনি ইনহেলারের সুফল পাবেন। অনেক রোগী গিলে ফেলে, তখন ওষুধটি পাকস্থলীতে চলে যায়, তাহলে তো লাভ নেই। আমার শ্বাসনালিতে ইনহেলার পৌঁছাতে হবে। সেই জন্য আমরা ইনহেলারের ব্যবহারের লোকদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। যদিও মাত্র ১১ থেকে ১৫ শতাংশ লোককে আমরা ইনহেলারের আওতায় আনতে পেরেছি।
প্রশ্ন : খুবই দুঃখজনক আসলে, আরো অনেক দরকার এর আওতায় আসা...
উত্তর : ইনহেলার নিতে সময় খুব কম লাগছে। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হচ্ছে, আপনি যদি একটি সালবিউটামল ট্যাবলেট খান আপনার হয়তো হাত-পা কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে এই সমস্যাগুলো ইনহেলারে নেই।
প্রশ্ন : রমজান তো চলেই আসছে এ সময় তারা কী কী বিষয় মেনে চললে তাদের জটিলতা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে?
উত্তর : এক কোটি লোকের মতো হাঁপানি রোগী এ দেশে আছে। সবাই তো রোজা রাখতে চায়। এটি তো একটি ফরজ ইবাদত। বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞদের কাছে সবাই এই প্রশ্নটি করেন।
এখন অনেক সুন্দর সুন্দর ডিভাইস চলে আসছে, যা ব্যবহার করলে সুন্দরভাবে রোজা রাখতে পারবেন। যেমন একটি ইনহেলার রয়েছে, এক ধরনের সালবিউটামল। এটি আমরা ইফতারের সময় দুই পাফ নিতে পারি। সেহেরির সময় দুই পাফ নিতে পারি। নিলে এটা লম্বা সময় ধরে ভালো থাকে।
আর বলা হচ্ছে, রোজা রাখা অবস্থায় যদি কেউ ইনহেলার নেয়, তবে রোজা ভাঙবে না। কারণ ইনহেলার তো খাদ্যের পরিপূরক নয়।
অনেকে বলে ধূমপান করলে রোজা ভেঙে যাবে। ধূমপান তো নেশা। কিন্তু ইনহেলার তো নেশা নয়, এটা হচ্ছে তাকে সুস্থ রাখা। সব আলেমরা এই বিষয়ে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, এটা সহজেই রোজা রেখে নেওয়া যাবে। তারপরও যদি কেউ না নিতে চান তবে সেহেরি এবং ইফতারের সময় দুই পাফ করে নিতে হবে।
আর এখন বিভিন্ন জেনথিন দলের আছে, ইউনিকনটেন আছে, কনটেন আছে- একটা ২০০ মিলেগ্রামের বড়ি, ইফতার করে একটা খেয়ে নিলেন, সেহেরির পর একটা খেয়ে নিলেন। তাহলে পুরো সময়টাই তিনি শ্বাসকষ্ট মুক্ত থাকতে পারছেন। আর রাতে শোয়ার সময় একটু মন্টিলুকাস ১০ মিলিগ্রাম ওষুধ খেয়ে নিলেন, তাহলে খুব সহজেই তিনি রোজা রাখতে পারছেন।
তবে এখানে কথা হচ্ছে, কিছু কিছু খাবার আছে যেগুলো খুব অ্যালার্জিতে ভরা। যেমন, গরুর মাংসের অনেক পদ হয়, অনেক হাঁপানি রোগীই আছে যাদের এই মাংসের প্রতি অ্যালার্জি আছে। চিংড়ি মাছের পদ হয়, বেগুনি থাকে-এগুলো তাকে এড়িয়ে চলতে হবে, যদি তার এসব খাদ্যে সংবেদনশীলতা থাকে। তাহলে সেগুলো তিনি খাবেন না। ইফতারটি ওইভাবে সাজিয়ে নেবেন। আসলে খুব ভাজাপোড়া খাবার কারো জন্যই ভালো না।
আরেকটি জিনিস একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি। আজকে যেই তেল দিয়ে ইফতার ভেজেছে, তিন-চারদিন ধরে হয়তো ওই তেল দিয়েই ইফতার ভেজেছে। বিশেষ করে বাইরের খোলা দোকানগুলোতে।
অনেকে বাসায়ও করতে পারে, তাদের জন্য পরামর্শ থাকবে আজকে যেই তেল দিয়ে ইফতার ভেজেছেন, সেই তেলটা ফেলে দেবেন। তিন-চার দিন যদি একই তেল দিয়ে ভাজেন, এটা মারাত্মক ক্ষতিকারক বস্তু কারসিনোজেন তৈরি করে। যার ফলে ক্যানসার তৈরির একটি কারণ হিসেবে কাজ করে। সুতরাং আজকের তেলের কাজ শেষ হওয়ার পর এটা ফেলে দেবেন। তেলযুক্ত খাবার আসলে যত কম খাওয়া যায়, তত ভালো।
একজন হাঁপানি রোগীও যদি খুব পেট ভরে খায়, তবে দম নিতে সমস্যা হচ্ছে। আসলে সুস্থভাবে রোজা যেন রাখতে পারে, সে জন্য কিছু নিয়মকানুন অবশ্যই মেনে চলতে হবে। আমাদের যে মূল লক্ষ্য, সব কিছুর মধ্যে ভারসাম্য করে চলতে হবে, পরিমিতি বোধ থাকতে হবে। রোজা পরিমিতি বোধের শিক্ষা দেয়, আমরা যদি খুব বেশি ইফতার করি রোজার যে সুফলটা পাব সেটা হয় না।