বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস
আসুন, বিষণ্ণতা নিয়ে কথা বলি
১৯৪৮ সালের পর থেকে প্রতিবছর ৭ এপ্রিল নিয়মিতভাবে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। প্রতিবারের মতো এবারও একটি বিশেষ প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হচ্ছে দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আসুন, বিষণ্ণতা নিয়ে কথা বলি’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) ভাষ্যমতে, বিষণ্ণতা বর্তমান বিশ্বে একটি অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্বে ৩০ কোটির বেশি লোক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। হু’র সমীক্ষা অনুযায়ী ২০০৫-২০১৫ এই ১০ বছরে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
আসুন কথা বলি
আসুন, বিষণ্ণতা নিয়ে কথা বলি। কারণ, কথা বললেই বরফ গলবে। সামাজিকতার ভয়, কুসংস্কার, অসচেতনতা, লজ্জা, জড়তা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বিষণ্ণতার রোগীরা চিকিৎসকের কাছে যায় না। এতে এদের অনেকেই সুস্থ এবং উৎপাদনশীল স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ একটুখানি সহানুভূতি এবং সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি এদের সুস্থ, স্বাভাবিক, কর্মক্ষম জীবন নিশ্চিত করতে পারে।
হু’র মহাপরিচালক ড. মার্গারেট চ্যান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিষণ্ণতার রোগীদের যে পরিসংখ্যান, তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। বিষণ্ণতা নিয়ে কথা বলতে হবে। সবাইকে এর ভয়াবহতা এবং চিকিৎসা সম্পর্কে জানাতে হবে। এবারের প্রতিপাদ্যটি তাই বলা যায় একটি জাগরণের ডাক। যাকে বলে ‘ওয়েক আপ কল’।
হু’র মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ড. শেখর সাক্সেনা বলেন, ‘বিষণ্ণতা নিয়ে কথা বলা হলো বিষণ্ণতা চিকিৎসার প্রথম ধাপ।’
বরাদ্দ বাড়াতে হবে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর বিষণ্ণতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি এবং এর চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর ব্যাপারে সুপারিশ করছে। তারা বলছেন, উচ্চ আয়ের দেশগুলোতেও ৫০ শতাংশ বিষণ্ণতার রোগী চিকিৎসার আওতায় আসে না। তাঁরা মনে করছেন, এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে সরকারের মূল স্বাস্থ্য খাতের ৩ থেকে ৫ শতাংশ ব্যয় হয়। আর দরিদ্র দেশগুলোতে ব্যয় হয় তারও কম, মাত্র ১ শতাংশ। তাঁরা বলছেন, এই খাতে এক ডলার ব্যয় বাড়ালে ফিরে আসবে চার ডলার। কারণ, বিষণ্ণতার রোগীদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা কমে যায়। যার প্রভাব পড়ে দেশের মূল অর্থনীতিতে, এমনকি সামাজিক অগ্রগতিতেও।
বিষণ্ণতাকে জানুন
বিষণ্ণতা এক ধরনের মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো কাজে আনন্দ পায় না, আগ্রহ পায় না। সব সময় মন খারাপ করে থাকে, হতাশ ও অবসাদগ্রস্ত থাকে। মন খারাপের ভাবটা এত বেশি থাকে যে কোনো জায়গায় মনোযোগ দিতে পারে না। অহেতুক দুশ্চিন্তা হয়, খেতে ইচ্ছা করে না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুমের অসুবিধা হয়।
তবে মনে রাখতে হবে, হঠাৎ কোনো কারণে মন খারাপ হওয়াটা কিন্তু বিষণ্ণতা নয়। এই সমস্যাগুলো যদি দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থাকে, তাহলে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধরে নেওয়া যায়।
এ সমস্যা যখন গভীর হয় তখন একপর্যায়ে রোগী স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। হতাশ হয়ে পড়ে এবং ভাবতে থাকে, ‘এই বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।’ এতে একপর্যায়ে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়।
আছে অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি
বিষণ্ণতার কারণে শরীরে অন্য অসুখও বাসা বাঁধতে পারে অথবা রোগের প্রকোপ বাড়িয়ে দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মাদকাসক্তি, ডায়বেটিস ও হৃদরোগের কথা। অনেকের বিষণ্ণতার কারণে মাথাব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, শরীরের নানা অঙ্গে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দেয়। এর হয়তো কোনো সুনির্দিষ্ট শারীরিক কারণ নেই।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
রোগীর সঙ্গে সমস্যা নিয়ে কথা বলাই বিষণ্ণতার চিকিৎসার প্রথম ধাপ। অনেকে সাইকোথেরাপিতেই ভালো হয়ে যায়। কারো কারো ওষুধ লাগে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কেন চিকিৎসা লাগবে, কখন চিকিৎসা লাগবে সেটা নিয়ে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।
সুস্থ বিনোদন, সৃজনশীল সাংস্কৃতিক চর্চা, পাঠাভ্যাস, শরীরচর্চা, সুশৃঙ্খল, সামাজিক জীবন বিষণ্ণতা প্রতিরোধে সহায়ক।
লেখক : আবাসিক চিকিৎসক, বিএসএমএমইউ।