সঞ্জীবনী
স্বপ্ন দিয়ে শুরু হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতাল
শুরুর কথা
২০০২ সাল। নভেম্বরের ২২ তারিখ। রমনা রেস্তোরাঁর সামনের অঙ্গনে বসেছিলেন সমমনা কয়েকজন তরুণ চিকিৎসক। দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার অনৈতিক ও অমানবিক বিষয়গুলো কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, এ নিয়েই ছিল সবার ভাবনা। এই ভাবনা থেকেই একটি হাসপাতাল নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন তাঁরা, যেখানে নিম্ন আয়ের রোগীদের কম খরচে ভালো মানের চিকিৎসা দেওয়া হবে।
স্বপ্ন বাস্তবায়ন হলো দুই বছরের মাথায়, ২০০৪ সালে। ৫০ জন তরুণ চিকিৎসক নিজেদের টাকা জমিয়ে পান্থপথ গ্রিন রোড সিগন্যালের একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে শুরু করেন তাঁদের স্বপ্নের ‘হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতাল’। এর একটি চমৎকার স্লোগানও তৈরি করেন তাঁরা : ‘আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের স্বপ্ন’।
গত ১০ বছরে এটি পরিণত হয়েছে জরুরি বিভাগসহ একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালে। এখানে রয়েছে ইনডোর ও আউটডোর সুবিধা। ইনডোরে নিয়মিত প্রায় ৭০ জন রোগীর সেবা দেওয়া হয়।
কথা হয় হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মোমবাতির আলো দিয়ে প্রথম আমরা রোগী দেখা শুরু করি। এমনকি শুরুতে চিকিৎসকদেরও আলাদা কোনো বসার জায়গা ছিল না। সবাই এক জায়গায় বসতাম। সে সময় আমাদের মূলধন ছিল কেবল ৯৬ লাখ টাকা, যখন একটি এক্স-রে মেশিনের দামই ছিল ৪০-৪৫ লাখ টাকা। তখন আমাদের চিকিৎসক বন্ধুরাই রোগীর বেড তৈরি করা, রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো—এসব কাজে হাত লাগান। আমরা তখন রোগীর বিছানা, চাদর ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজেরাই কেনাকাটা করতাম। এসব কেনার জন্য যাতায়াত ভাড়া আমরা নিজেরাই বহন করতাম। তা ছাড়া হাসপাতালটি তৈরির চিন্তা নিয়ে আমাদের শুভানুধ্যায়ীদের কাছে গিয়েছি। তাঁদের অনেকেই বিভিন্নভাবে আর্থিক সাহায্য করেছেন। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করিয়েছি।’
সেবাদানই একমাত্র লক্ষ্য
‘প্যাথলজি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন, রোগীদের জিম্মি করে টাকা আয়—এসবের বিপরীতে একটি সুস্থ চিন্তাধারার চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায় কি না, এসব ভাবনা থেকেই মূলত হাসপাতালটি তৈরি করা হয়,’ বললেন ডা. লেলিন চৌধুরী।
ডা. লেলিনের মতে, এটি একটি স্বপ্নের লালন ও বাস্তবায়ন। ‘আমরা যারা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছি, এটি আমাদের আনন্দের জায়গাও বটে। একজন কবি যেমন কবিতা লিখে আনন্দ পান, একজন গায়ক যেমন গান গেয়ে আনন্দ পান, তেমনি এখানে কাজ করে আমরা আনন্দ পাই।’
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যখন ঠিক করি একটি নৈতিক চিকিৎসাধারা চালু করব, তখন প্রথমে এর বাধাগুলো চিহ্নিত করি। রোগী এবং চিকিৎসকদের মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল, যারা রোগী নিয়ে আসে, তারা একটি পারিশ্রমিক দাবি করে। সচরাচর ক্লিনিকগুলো তাদের দাবি মিটিয়ে থাকে, যার চাপটা রোগীর ওপরই পড়ে। আমাদের কাজ ছিল, এই দালালশ্রেণিকে এড়িয়ে রোগীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা; কমিশন রেফারের বাইরে যেসব চিকিৎসক প্র্যাকটিস করতে আগ্রহী, তাদের নিয়ে কাজ করা। অর্থের প্রলোভনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কতজন চিকিৎসককে পাওয়া যায়, সেটি দেখা। আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল, সরাসরি যারা সেবাগ্রহীতা, তাদের মধ্যে কীভাবে আমাদের কথা পৌঁছানো যায়, সেটি ভাবা।’
এই হাসপাতালের সেবাদানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেসব রোগী ভর্তি আছেন, প্রতিদিন সকালে এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পঙ্কজ কান্তি সূত্রধর তাঁদের সঙ্গে নিজে গিয়ে দেখা করেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের সমস্যার বিষয়টি নিজে জেনে সমাধানের চেষ্টা করেন। এ ছাড়া এ হাসপাতালে যেসব শিশু জন্ম নেয়, তাদের প্রত্যেকের জন্মদিনের দিন উইশ করা হয় এবং কার্ড পাঠানো হয়।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সব সময় একটি জিনিস ভাবার চেষ্টা করি, যদি মানুষের ভালো করা না যায়, তবে রোগ ভালো করা যাবে না। স্বজনদেরও উৎকণ্ঠা দূর করতে হবে। চিকিৎসকের প্রধান কাজ রোগীর চিকিৎসা। এই চিকিৎসা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে করা যায়, সেটি রোগীর কাছে অনেক নির্ভরযোগ্য হয়। কোনো ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হলে তাঁকে যদি মানসিকভাবে সবল করা যায়, তবে রোগের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। তাই এ ধরনের ব্যবস্থা। তাই উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তা চিকিৎসক সরাসরি রোগীদের অবস্থা জানার চেষ্টা করেন। আমাদের ১০ বছর পূর্তিতে ভর্তি রোগী যারা ছিল, তাদের একসঙ্গে করা হয়েছিল। প্রায় ৫০০ জন পুরোনো রোগী সেখানে একত্র হয়েছিলেন। এর উদ্দেশ্য, তাঁরা যেন একে শুধু একটি হাসপাতাল না ভাবেন, যেন ভাবেন এটি একটি পরিবার।’
হাসপাতালটাই যেন পরিবার
এই হাসপাতালে নিয়মিত সেবা নেন বিক্রমপুরের শিবরামপুরের শ্রীনগরের মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক আবদুল হালিম খান। তিনি জানান, এই হাসপাতালে ভালো সেবা পাওয়া যায়। এখানকার চিকিৎসক এবং নার্সরা রোগীদের প্রতি বেশ আন্তরিক। আমার সব ধরনের সমস্যার চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালেই আসি। মোটকথা, এদের সার্ভিসটি সার্বিক অর্থেই ভালো। একে আমার পারিবারিক হাসপাতাল মনে করি।’
হেলথ অ্যান্ড হোপে বর্তমানে প্রায় ৯৯ জন চিকিৎসক রয়েছেন, যাঁরা অনৈতিক ও বাণিজ্যমুখী চিকিৎসা-স্রোতের বাইরে দাঁড়িয়ে চিকিৎসার জন্য যুদ্ধ করছেন। নতুন একটি ইউনিট চালু করা হয়েছে। বর্তমানে এ হাসপাতালের দুটো ইউনিট মিলে ২২০ জনের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এখানে একটি ওয়েলফেয়ার ফান্ড রয়েছে, যেখানে সামাজিক বন্ধুরা অনেকেই সাহায্য করেন। এই ফান্ডের টাকা দরিদ্র ও অসমর্থ রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধা, প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক, পোশাকশ্রমিক—যারা অর্থের দিক থেকে দুর্বল, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এসব মানুষের চিকিৎসায় এই ফান্ডের অর্থ ব্যয় করা হয়। দেখা যায়, অনেক সময় হয়তো ৭০ শতাংশই ফান্ড বহন করে। তাদের কাছ থেকে ন্যূনতম সিট ভাড়া এবং ওষুধের দাম রাখা হয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর বেশ কিছু হেলথ ক্যাম্প করে। হেলথ ক্যাম্পগুলো এমন জায়গায় করার চেষ্টা করা হয়, যেখানে সাধারণত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যান না। নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া বরাইত গ্রাম এ রকম জায়গায় করা হয়। কতগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একত্রে কাজ করে। বীরশ্রষ্ঠ মতিউর রহমান ফাউন্ডেশন, আঁচল ট্রাস্ট।
ডা. লেলিন চৌধুরী আরো বলেন, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির উন্নতি হচ্ছে, খরগোশের মতো না হোক, কচ্ছপের মতো গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আজ ১০ বছর পর আমরা বলতে পারি, আমাদের লক্ষ্য এবং হাসপাতাল পরিচালনার কৌশল ভুল ছিল না। ৫০ জন মূলধন দিয়েছিলাম, সেটা এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যাঁরা পরিচালনায় ছিলাম, তাঁরা অনেক বছর ধরে সম্মানী নিতাম না। এখনো যা নেওয়া হয়, সেটা ন্যূনতম। এই পর্যন্ত হাসপাতালের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত আছি, কেউ কোনো লভাংশ নিইনি।
চিকিৎসক যখন লেখক
এ হাসপাতালের একটি মজার বিষয়, এখানকার চিকিৎসকদের মধ্যে ১৫-১৬ জনের মতো বিভিন্নভাবে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন। কেউ কবিতা লেখেন, কেউ বা উপন্যাস, আবার কেউ স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন বইপত্র। ডা. জিল্লুর রহমান মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে উপন্যাস লেখেন, ডা. পঙ্কজ কান্তি সূত্রধর কবিতা লেখেন, ডা. মিলন কিবরিয়া স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখা লেখেন, ডা. বিলকিস চৌধুরী স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখালেখি করেন। এ ছাড়া আরো অনেকেই লেখালেখি করেন।
যেসব চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়
একটি সাধারণ হাসপাতালে যেসব চিকিৎসা দেওয়া হয়, এখানেও সেসব চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। মেডিসিন, জেনারেল ল্যাপরেস্কোপি সার্জারি, গাইনি, অবস, চক্ষু, অর্থপেডিক, ইএনটি, কিডনি, নিউরোসার্জারি, ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি, প্লাস্টিক সার্জারি, ক্যানসার চিকিৎসা, মানসিক রোগীর চিকিৎসা, শিশু রোগ, দাঁত, ফিজিক্যাল মেডিসিন, হেপাটোলজি, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ, পুষ্টি পরামর্শ ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে শিশু এবং ভাষা বিকাশ কেন্দ্র, শিশু নিউরোলজি, সিপি ক্লিনিক, ফিজিওথেরাপি।
রয়েছে নিজস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টার, যা ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। এখানে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম, ডিজিটাল এক্স-রে, ডেন্টাল এক্স-রে, এন্ডোস্কোপি ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। সব পরীক্ষায় ২৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। শুক্রবারে বন্ধ থাকে বহির্বিভাগ। রয়েছে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। বহির্বিভাগ সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বিকেলে রোগী দেখে থাকেন।
খরচ খুব কম
মাছরাঙা টেলিভিশনের সিনিয়র প্রডিউসার, প্রোগ্রাম স্বীকৃতি বড়ুয়া জানান, ‘এই হাসপাতালে আমার দ্বিতীয় সন্তানটির জন্ম হয়। মধ্যবিত্তদের জন্য এটি খুব ভালো একটি হাসপাতাল। চিকিৎসকরা বেশ সহযোগী। আমার স্ত্রী বিভিন্ন গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যায় এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এখানে এলেই অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় কম টাকা নেয়। এরা কমার্শিয়াল নয়।’
এখানে চিকিৎসার সব ক্ষেত্রেই মূল্য কম ধরা হয়। সব টেস্টে ২৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। বেড ভাড়া ৮০০ টাকা। কেবিনগুলো এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘অন্য হাসপাতালে যেখানে কোনো অস্ত্রোপচারে লাগে ৮০ হাজার টাকা, সেটা ৪০ বা ৪৫ হাজার টাকায় আমরা করি। এ জন্য আমাদের এখানে নিউরোসার্জারি ও অর্থপেডিক সার্জারিগুলো বেশি হয়। কারণ এখানে খরচ কম। আমাদের কোনো মার্কেটিং অফিসার নেই। রোগী আমাদের চিকিৎসায় খুশি হয়ে যদি কাউকে এখানে আসতে পরামর্শ দেন, সেটাই আমাদের মার্কেটিং। যদি মানুষকে বোঝানো যায়, তাকে যে সেবা দেওয়া হচ্ছে তার যৌক্তিক খরচ কত, তাহলে সে আর বিরক্ত হবে না। আমাদের কিছু সহযোগী চিকিৎসক আছেন বিভিন্ন দেশের। তাঁরাও এখানে এসে সেবা দেন। চিকিৎসা শেষে প্রত্যেক রোগীকে ফরম দেওয়া হয় তাঁদের কী ভালো লাগল, না লাগল সে বিষয়ে মন্তব্য নেওয়ার জন্য। এর পর মাস শেষে একটি বিশ্লেষণ করা হয়।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘কিছু লোক হাসপাতালে এসে ফাইভস্টার হোটেলের চাকচিক্য আশা করেন। সেটা আমাদের পক্ষে এত অল্প টাকায় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অনেকে এখানে এসে নাক উঁচু করে চলে যায়। আমরা আসলে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষের পাশে থাকতে চাই।’
যোগাযোগ
১৫২/১-এইচ, গ্রিন রোড, পান্থপথ ক্রসিং, ঢাকা-১২০৫।
ফোন : ০১৬৭৮১৩১২৫২, ০১৮১৯৪৯৪৫৩০, ৯১৪৫৭৮৬, ৯১৩৭০৭৬।