নাক ডাকার সমস্যা কেন হয়
নাক ডাকা অনেকের জন্যই বড় সমস্যা। সময়মতো এর চিকিৎসা না করলে সমস্যা জটিল হয়ে উঠতে পারে। আজ ২২ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৭৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বারডেম হাসপাতালের নাক কান গলা এবং হেড নেক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. জাহির আল আমিন।
প্রশ্ন : নাক ডাকা বিষয়টি কী?
উত্তর : নাক ডাকা অবশ্যই একটি সমস্যা। এটি শারীরিক এবং সামাজিক একটি সমস্যা। আমরা অনেক ক্ষেত্রে মনে করি এটা কোনো সমস্যাই না, এই ভাবনাটাও সমস্যা। নাক ডাকাকে আমরা খুব সহজভাবে নেই। লোকজন মনে করে নাক তো ডাকেই। ছেলেরা একটু বেশি নাক ডাকে, মেয়েরা কম ডাকে। আবার একটা বয়সের পর মেয়েরা বেশি নাক ডাকে। ছোট বাচ্চারাও নাক ডাকে। আমরা বলি কী আর এমন হলো, কোনো ক্ষতি তো হলো না। আসলে এটা বিরাট একটা সমস্যা। পাশ্চাত্য বিশ্বে এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সাংসারিক ঝামেলা হয়, অনেকের নাক ডাকার জন্য তালাক পর্যন্ত হয়ে যায়।
আমাদের দেশে অবশ্য এটা এখনো শারীরিক সমস্যা হিসেবেই আছে। আসলে নাক ডাকলে অনেক সমস্যা হয়।
প্রশ্ন : সমস্যাটা কোথায় এটা কী, দর্শকদের একটু বুঝিয়ে বলবেন?
উত্তর : আমাদের শ্বাস নেওয়ার রাস্তা রয়েছে। এর জন্য তিনটি ফুটো রয়েছে। নাকের দুই ফুটো এবং মুখ দিয়ে একটি শ্বাসের রাস্তা। তো অনেক সময় নাক বন্ধ থাকে তখন আমরা মুখ দিয়ে শ্বাস নিই। অথবা একটি বন্ধ থাকলে আরেকটি ব্যবহার করি। আমাদের উচিত যে স্বাভাবিক সেটাই বন্ধ করা। বেশির ভাগ ডাকা শুরু হয় নাক বন্ধ থাকার কারণে বা নাকে যদি কোনো সমস্যা হয় তখন।urgentPhoto
দেখা যায়, নাক ডাকার শব্দটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে একটা সময় গিয়ে দমটা বন্ধ হয়ে যায়। এটাকে এপিনিয়া বলি। যখনই এই নাক ডাকা শুরু হয়, তখনই রক্তের মধ্যে অক্সিজেনের পরিবহন ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে এবং একটা কঠিন অবস্থায় চলে যায়। যখন দম বন্ধ হয়ে যায়, তখন অনেক কমে যায়। এর ঝুঁকিও রয়েছে। এটি তার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, দেখা যায় সে ধড়ফড় করে উঠছে। শরীর যখন খুব বেশি খারাপ অবস্থায় চলে যায়, তখন এটা হয়। এর ফলে দেখা যায়, যেখানে আমরা সবাই বিশ্রাম নিই সেখানে সে সংগ্রাম করছে। এর প্রভাবটা তার দৈনন্দিন কাজের ওপর পড়ছে। এর ফলে সারা দিন সে ঘুমাচ্ছে, ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে। ধীরে ধীরে মনোযোগও কমে যেতে থাকে। অনেকে দুর্বলতা বোধ করতে পারে। রক্তচাপ বেড়ে যায়। অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক মানে তো রক্তের মধ্যে অক্সিজেন যাচ্ছে না। নাক ডাকার কারণে যদি শরীরে অক্সিজেন ধীরে ধীরে কমে যায় তাহলে হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। বেশির ভাগ হার্ট অ্যাটাক হয় ভোর রাতের দিকে। অনেক সময় দেখা যায়, মোটা মানুষ খেয়েদেয়ে ঘুমালো, তখন বুকের ভেতর একটা চাপ হয়। আবার নাকও ডাকল। এতে অক্সিজেন পরিবহন কমে গেল। সবগুলো মিলেই হার্ট অ্যাটাক হয়। এটি হার্ট অ্যাটাকের একটি কারণ হিসেবে কাজ করছে। এ জন্য নাক ডাকাকে আমাদের অবশ্যই জরুরি বিষয় হিসেবে নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন : একজন মানুষ যে এই জাতীয় সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার কখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত?
উত্তর : একটি বিষয় হলো বাচ্চাদের নাক ডাকা উচিত না। বাচ্চা যখন নাক ডাকে, সেটা একদমই ভালো জিনিস না। প্রাপ্তবয়স্কদেরও নাক ডাকা ভালো জিনিস না। নাক ডাকবে সাধারণত বয়স হয়ে গেছে এমন লোকেরা। প্রাপ্তবয়স্ক লোক যদি নাক ডাকে তবে মনে করতে হবে তার আসলেই সমস্যা আছে। সবারই সমস্যার সমাধান করতে হবে। চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : কী কারণে নাক ডাকছে এটি আপনারা নিশ্চিত হন কীভাবে?
উত্তর : মুটিয়ে যাওয়া নাক ডাকার একটি বড় কারণ। আরেকটি নাক ডাকার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো নাকে সমস্যা। নাকে যদি কোনো ব্লকেজ থাকে বা কিছু হয় তাহলে নাক ডাকার সমস্যা দেখা যায়। আর কিছু অভ্যাসের বিষয় রয়েছে, ধূমপান, মদ্পান, অতিরিক্ত কাজের চাপ-এসব বিষয়গুলোকে বন্ধ করে দিলে আমরা অনেক সহজেই নাক ডাকা থেকে নিস্তার পেতে পারি। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নাক ডাকে টনসিল এবং এডিনয়েডের জন্য। যদি নাকের পেছনের এডিনয়েড বড় হয়ে যায়, তাহলে নাক ডাকতে পারে। টনসিল যদি বড় হয়ে যায়, তাহলেও নাক ডাকতে পারে।
তবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে যেসব কারণে নাক ডাকে সবই ঠিক করা সম্ভব। এগুলো প্রতিকার করা সম্ভব। কাজেই এদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
প্রশ্ন : কীভাবে এটার প্রতিকার করা হয়?
উত্তর : একটা বিষয় হলো আপনি যদি ওজন কমাতে পারেন তাহলে প্রতিকার সম্ভব। তবে ওজন কমানো খুব কঠিন কাজ। তারপরও চেষ্টা করতে হবে। ওজনাধিক্য সব রোগের জন্যই একটি বড় কারণ। এটা কোনোমতেই সহজভাবে নেওয়া উচিত না।
নাকে যদি কোনো সমস্যা থাকে হাড় বাঁকা থাকে, পলিপ থাকে, অ্যালার্জি থাকে তবে এই সমস্যা হয়। অনেক ক্ষেত্রে এগুলোর সহজ কয়েকটা ওষুধ সেবন করলেই সমস্যা ভালো হয়ে যায়।
প্রশ্ন : নাক ডাকার সমস্যার প্রতিকারে সার্জিক্যাল কোন কোন বিষয়গুলো আপনারা বলে থাকেন...
উত্তর : নাকের হাড় বাঁকা থাকলে, পলিপ থাকলে সার্জারি করলে সমস্যা কমে যায়।
আর আরেকটি বিষয় হলো, যখন ওজনাধিক্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তখন আমরা মাঝে মাঝে সার্জিক্যাল চিকিৎসায় যাই। যেটা এখন এ দেশেও করা হচ্ছে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে অনেকের গলার ভেতরে জিহ্বাটা অনেক বড় থাকে সেটা আমরা ছোট করে ফেলতে পারি। লেজার ব্যবহার করতে পারি।
আসলে নাক ডাকা মানে ফুটো ছোট হয়ে গেছে, রাস্তাটা ছোট হয়ে গেছে। এই রাস্তাকে আমরা বড় করতে পারি। এরা চিকিৎসা করলে রোগী খুব উপকার পায়।
প্রশ্ন : যখন চিকিৎসা করে, তখনই সে বুঝতে পারে কতটা উপকার হচ্ছে...
উত্তর : তার কাজকর্মের সময় যে কষ্টটা ছিল, দুর্বলতাটা ছিল সেটা যখন ভালো হয়ে যায় সে ভালোই বোধ করে।
প্রশ্ন : তবে শুরুর দিকে যখন সে এই সমস্যায় ভোগে, তখন বুঝতে পারে না চিকিৎসাটা দরকার...
উত্তর : নাক ডাকা যে একটি সমস্যা, এই ধারণাই বোধ হয় এখনো প্রচলিত নয় আমাদের দেশে। এটা যে বিরাট একটি প্রভাব ফেলছে রক্তচাপের ওপরে, হার্টের ওপরে এবং কাজকর্মের ওপরে সেটা বুঝি না। ঘুমের মধ্যে যদি অক্সিজেন পরিবহন কমে যায়, তাহলে মস্তিষ্ক কাজ করবে কীভাবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হলে বৃদ্ধি কমে যায়। বাচ্চা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায়।
প্রশ্ন : বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যখন এডিনয়েড বা টনসিলের সমস্যা হয়, সেটি প্রতিকারের কী উপায়?
উত্তর : আমরা অনেকে ভাবি, এই সমস্যা আস্তে আস্তে কমে যাবে। বুঝতে হবে বাচ্চার বৃদ্ধি ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পরামর্শ খুব সহজ-ওষুধ খান। যদি না সারে, তবে সার্জারি করতে হবে। অনেকে ভাবে সার্জারি না করে ওষুধ খেয়ে দেখি, এটা ঠিক নয়। কথা হলো, এটা একটা সমস্যা। সমস্যা হলে সমাধান করতে হবে। পুষে না রেখে চিকিৎসা করতে হবে, তাহলে জটিলতা এড়ানো যাবে।