রোজায় ডায়াবেটিস রোগীরা কী করবেন?
রোজায় ডায়াবেটিস রোগীদের কিছু বিশেষ নিয়ম মেনে চলতে হয়। আজ ২৩ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৭৫তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বারডেম হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. তোফায়েল আহমেদ।
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখার জন্য কিছু পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়। রোজার সময়ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের তুলনায় তাদের খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হয়। একজন ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার জন্য পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে কি না এবং কেন?
উত্তর : ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে রোজা সবার জন্য ফরজ। আর যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী তাদের জন্যও এটা ফরজ, তবে সবার জন্য না। এই ইবাদতটা যারা করতে চায় তারা যেন ঠিক মতো করতে পারে এর পূর্ব শর্ত হচ্ছে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় কী ধরনের পরিবর্তন আসবে সেটা ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তুতি নেওয়া। আমরা সাধারণভাবে বলি, কারো যদি ডায়াবেটিস থাকে অন্তত তিন মাস আগে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে ডায়াবেটিস একেবারে ভালো আছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে রোজা রাখতে পারবে- এ রকম অবস্থায় ডায়াবেটিসকে নিয়ে যেতে হবে। দৈনন্দিন খাদ্যের যে পরিবর্তন আসবে তার পরামর্শ ডাক্তারের কাছ থেকে নিতে হবে। তাহলে যারা ডায়াবেটিস হওয়ার পরও রোজা রাখার জন্য ফিট আছে তারা রোজা রাখতে পারবে।
প্রশ্ন : যদি তারা সঠিকভাবে পূর্ব প্রস্তুতি না নেয় তাহলে কী সমস্যা হয়?
উত্তর : যাদের ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা, ওষুধ, খাদ্য ব্যবস্থার এবং জীবনযাপনের কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে রক্ষা করতে হয়। তবে রোজার সময় ১৬-১৭ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হয়। এখানে চার রকমের সমস্যা হতে পারে। যার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই তার রক্তের শর্করা বেড়ে যেতে পারে। অথবা কারো কারো ক্ষেত্রে ইফতারের আগে বিশেষ করে আসরের পরে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তের শর্করার স্বল্পতা হয়ে তারা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। শরীরে পানির ধারণক্ষমতা কমে যাবে। কারণ রোজার সময়তো পানিও খেতে পারছে না। এতে স্বাস্থ্য হুমকিতে পড়বে। অথবা আরো মারাত্মক হলো রক্তে শর্করার সাথে সাথে লবণ এবং অন্যান্য জিনিসের পরিবর্তন হয়ে ডায়াবেটিক কেটোয়েসিডোসিস -এই ধরনের সমস্যা হতে পারে। এসব বিষয় মোকাবিলার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। তবে কী করণীয় এ বিষয়ে চিকিৎসকরা তাদের পরামর্শ দিয়ে দেন।
প্রশ্ন : যারা তিন মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছে তারা ভালো করেছে, আর যারা নেয়নি তাদের ক্ষেত্রে কী পরামর্শ এই রোজার সময়?
উত্তর : আপনি লক্ষ্য করবেন ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসক মাত্র সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। কিছু ওষুধ আছে যেমন মেটফরমিন, অথবা কিছু ওষুধ আছে যা ইনসুলিনের সংবেদনশীলতাকে বাড়ায় এগুলো যারা খাচ্ছে তাদের ওষুধে কোনো পরিবর্তন আনতে হবে না। তাদের শুধু খাওয়ার সময়টা ঠিক আছে এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যেমন ইফতার তো সবাই ঠিক মতো খায়। কেউ কেউ আছে শেষ রাতে গিয়ে খেতে চায় না। তাদের শেষ রাতে গিয়ে আজানের আগে আগে খেয়ে নিতে হবে। আবার মাঝখানে আরেকটি খাবার খেয়ে নিতে হবে। আমাদের দেশে সংস্কৃতি অনুযায়ী বলি অন্তত তিনটা মিলের অভ্যাস তাদের করে নিতে হবে। যাতে ওষুধগুলোর সাথে তার একটি সমন্বয় করা যায়। ধরেন ইনসুলিন আছে সেগুলোর পরিবর্তন হবে। আবার কিছু ওষুধ আছে ইনসুলিন তৈরি করে সেগুলোরও পরিবর্তন করতে হবে। সেটা করার জন্য তার খাদ্য ব্যবস্থাকে ঠিকমতো সন্নিবেশিত করতে হবে। আবার রক্তচাপ মাপার জন্য তাকে প্রন্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
প্রশ্ন : ওষুধ খাওয়ার বিষয়ে সেখানে খাওয়ার ওষুধ হোক বা ইনসুলিন হোক রোজার সময় কী ধরনের পরির্তন আনতে হয়?
উত্তর : রোজার সময় সাধারণ ওষুধ, যেগুলো মেটফরমিন, কিছু আছে সেনসেটাইজার সেগুলোর তেমন কোনো পরিবর্তন করতে হয় না। আবার কখনো কখনো দেখি যাদের রক্তে শর্করার মাত্রা ভালো আছে, এইচবিওয়ান সি ভালো আছে, শুধু মেটফরমিন নিচ্ছে, তাদের বলি রোজার সময় খাদ্য ব্যবস্থাই চলবে, ওষুধটা বন্ধ রাখবে। আর যারা ইনুসুলিন উৎপাদনকারী ট্যাবলেট নেয় তাদের অবস্থা দেখে পরিবর্তন করা হয়। সাধারণভাবে যে নীতিমালা সেটা বলছি, এটা অবশ্য সবার জন্য প্রযোজ্য হবে না। চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেবেন। যদি ২৪ ঘণ্টা মেয়াদি ওষুধ খায় সেগুলোকে শর্ট অ্যাকটিংয়ে নিয়ে আসতে হবে। এগুলোকে রাতের খাবারের সাথে দিতে বলা হয়।
আর যারা দুই বেলা ওষুধ খায় তাদের বলা হয়, রাতের ওষুধটা সকালবেলা নিয়ে যেতে। আর যেই ওষুধটা সকালে খেত সেটা মাগরিবের পরে রাতের খাবারের সময় খেতে হয় এবং রোগী যদি সবল থাকে তখন পুরো ডোজে শুরু করি।
আর রোগী সবল না থাকলে ওষুধটি কম ডোজে শুরু করি। আমরা নিশ্চিত হতে চাই তার আছরের সময়ের পর রক্তের শর্করা কমে গেছে কি না। সাধারণভাবে যেন ছয়ের নিচে না নামে। ওটা যদি না নামে তখন সেহরির আগে রক্তে শর্করা কেমন আছে সেটা দেখে আরো একটু পরিবর্তন করি। যাতে তার রক্তচাপ মোটামুটি একটা নিরাপদ অবস্থায় থাকে এবং এইচবিএওয়ানসি সেটারও যেন পরিবর্তন না হয় । আর যারা ইনসুলিন পায় তার নানা রকম ইনসুলিন আছে, নানা গাইডলাইন আছে- সেটা দেখে ডাক্তার তাকে নির্ধারণ করে দেবে।
একটি কথা চালু আছে, রোজার সময় খেতে কোনো হিসাব নেই, আসলে হিসাব আছে। হিসাব মেনেই খেতে হবে, চলতে হবে।
রাতে যেন রক্তের শর্করা খুব বেড়ে না যায়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো যেন ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে এদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন সাধারণত বিকেলের দিকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার লক্ষণ থাকে। একজন রোগী কী লক্ষণ দেখলে বুঝবে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হচ্ছে?
উত্তর : আমরা জানি ডায়াবেটিস রোগী যারা ইনসুলিনের মধ্যে রয়েছে তাদের জীবনে কখনো না কখনো হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে। মাথা ধরা যদি থাকে, ক্ষুধার ভাব আসে বা হঠাৎ করে ঘাম হয় বা মনোযোগ যদি কমে যায়- ওই সময়ে যেটা সবচেয়ে নিরাপদ সেটা হলো রক্তের শর্করাটা পরীক্ষা করে নেওয়া। আমরা বলি ছয়ের উপরে থাকলে নিরাপদ, যদি তিন চার হয়ে যায় তখন হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কারণে তার স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এ সময় তাকে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। পরে যখন সুস্থ হবে তখন করতে হবে।