বাতজ্বরের চিকিৎসায় ভালভ প্রতিস্থাপন
বাতজ্বর হলে অনেক সময় হার্টের ভালভ আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তখন ভালভ প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন পড়ে। আজ ২৬ জুন, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৭৮তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এনআইসিবিডির কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এ কে এম মনজুরুল আলম।
প্রশ্ন : বাতজ্বর হলে এই ভালভ প্রতিস্থাপন কেন করা হয়?
উত্তর : সাধারণত আমাদের দেশে দেখা যায়, যাঁরা বাতজ্বরের চিকিৎসা করেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ বছর কিংবা ১৫ বছর পরে একটা অভিযোগ শুরু হয়—বুকে ব্যথা হয়, হাঁটতে গেলে হাঁপিয়ে যান। উৎসটা আসলে বাতজ্বর। এটা হওয়ার মূল কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে বাতজ্বরকে নিয়ন্ত্রণ না করা অথবা রোগ নির্ণয় করতে না পারা। যে কারণে একটি পর্যায়ে এসে ১০ থেকে ১৫ বছর পর দেখা যায়, বাতজ্বর জটিল আকার ধারণ করেছে এবং হার্টের মাইট্রাল ভালভ আস্তে আস্তে অকেজো হয়ে পড়েছে। ভালভের যে এলাকা আছে, সেটা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তখন ইকোর মাধ্যমে আমরা রোগ নির্ণয় করি।
প্রশ্ন : ভালভ যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, সেটা কীভাবে বোঝা যায়? এর লক্ষণগুলো কী?urgentPhoto
উত্তর : হাঁটতে গেলে হাঁপিয়ে যায়। ক্লান্তবোধ করে। দুর্বল লাগে। মাঝেমধ্যে শ্বাসকষ্ট হয়। মাঝেমধ্যে বুকে ব্যথা হয়। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও সমস্যাটা হলে তারাও সাধারণত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বাতজ্বর হওয়ার পর ভালভ নষ্ট হতে প্রায় অনেক দিন সময় লেগে যায়। যখন আমাদের কাছে আসে, তখন ভালভের ক্ষতি হওয়ার পরেই আসে।
প্রশ্ন : কোন বিষয়টা মাথায় রাখলে সেটি আসলে এতদূর পর্যন্ত আসার ঝুঁকি থাকে না?
উত্তর : আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বাতজ্বর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালে যোগাযোগ করলে বাতজ্বর নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। তবে আমাদের দেশে যেটা হয়, অনেকে দূরে থাকে, অনেকে জানেই না, অজ্ঞতা থাকে, চিকিৎসক দেখাতে পারে না। কিংবা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না। সে কারণেই এই সমস্যাটা পরবর্তী জীবনে হয়। ছোটবেলা থেকে চিকিৎসা নিলে বাতজ্বর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
প্রশ্ন : বাতজ্বরের উপসর্গ কী?
উত্তর : সাধারণত দেখা যায়, বাতজ্বরের পাশাপাশি ভালভ যদি যুক্ত হয়, তাহলে শ্বাসকষ্ট হয়, বুকে ব্যথা হয়, ক্লান্ত বোধ করে। গিরাগুলো ফুলে যায়। এগুলো দিয়ে তার লক্ষণ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে আস্তে আস্তে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়িত হয়ে যায়।
প্রশ্ন : ভালভ যখন দুর্বল বা অকেজো হয়ে যায়, তখন কী ধরনের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন?
উত্তর : প্রথমে যখন রোগী অভিযোগ করে, তখন ক্লিনিক্যালি রোগ নির্ণয় করি। তার পর একটা ভালো ইকো করতে বলি। সেখানে দেখা যায় যে মাইট্রাল ভালভ, সাধারণত আমাদের দেশে মাইট্রাল ভালভ বেশি যুক্ত হয়। সঙ্গে অরটিক ভালভও যুক্ত হয়। তখন আমরা দেখি, এটা আসলে অস্ত্রোপচারের পর্যায়ে আছে কি না। যদি থাকে, রোগীকে আমরা সেভাবে গাইড করি। সাধারণত যদি ভালভ পুরোটা যুক্ত হয় বা ক্যালসিয়াম জমে যায়, সে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিই। যদি ক্যালসিয়াম না জমে, ভালভের অবস্থা যদি দেখি এখনো ভালো আছে, অস্ত্রোপচার না করে আরো কয়েক দিন থাকা যাবে, সে ক্ষেত্রে ওষুধ খাইয়ে রাখি। অকেজো হয়ে গেলে নিয়ন্ত্রণ করি।
প্রশ্ন : ভালভ প্রতিস্থাপন কখন করতে হয়?
উত্তর : ভালভ প্রতিস্থাপন করতে হয় তখনই যখন বুঝি পুরো ভালভটাই ক্যালসিফিকেশন হয়ে যায় অনেক সময়, ক্যালসিয়াম জমে যায়, ভালভের মুখটা প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়। স্বাভাবিক জ্বরে এনাটোমিক্যাল গঠন সেটা পরিবর্তন হয়ে যায়। এর ওপর ভিত্তি করে আমরা সিদ্ধান্ত নিই ভালভগুলো পরিবর্তন করতে হবে কি না। পাশাপাশি হার্টের অবস্থাও ভালো থাকতে হয়।
প্রশ্ন : প্রতিস্থাপনের জন্য যেসব ভালভ ব্যবহার করেন, সেগুলো কোথা থেকে পান?
উত্তর : সাধারণত বেশির ভাগ ভালভই আমেরিকা থেকে আসে। এই কৃত্রিম ভালভগুলো আমরা বাংলাদেশে প্রতিস্থাপন করি। এর ফলাফল ভালো পাওয়া যায়। সঠিকভাবে চিকিৎসা করলে হার্টের অন্যান্য পেরামিটার যদি ঠিক থাকে, তাহলে ভালভ প্রতিস্থাপন করলে হার্ট ভালো থাকে।
প্রশ্ন : অস্ত্রোপচারটি হয়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে আপনারা কোন কোন বিষয় দেখেন?
উত্তর : সাধারণত অস্ত্রোপচার হওয়ার ৭ থেকে ১০ দিন পরে আমরা রোগীকে ছেড়ে দিই। এর পর রোগীকে দুই সপ্তাহ বা ২০-২৫ দিন পরে আসতে বলি। মূল ফলোআপটা এখানে দরকার পিটি এবং আইএনআর রোগীকে মেজারমেন্ট করে দেখি।
প্রশ্ন : এর মাধ্যমে আপনারা কী দেখেন?
উত্তর : আমরা সাধারণত দুই ধরনের ভালভ লাগাই। মেকানিক্যাল ভালভ এবং টিস্যু ভালভ। সাধারণত যাদের বয়স ৫০-এর নিচে, তাদের আমরা পরামর্শ দিই মেকানিক্যাল ভালভ লাগানোর জন্য। আর টিস্যু ভালভটা লাগাই যাঁদের বয়স ৫০-এর বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে। কারণ, মেকানিক্যাল ভালভ সাধারণত সারা জীবন চলে যায়। তবে তাকে প্রতি মাসে এসেই চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিতে হয়। ওয়ারিন ট্যাবলেট দিই; এর মূল কাজ হচ্ছে রক্তকে তরল রাখা। যখনই একটি মেকানিক্যাল ভালভ প্রতিস্থাপন করি, তখন ওয়ারিনের ডোজটার সমন্বয় করে রক্তের সঙ্গে তারল্য নির্ধারণ করে দিই। কখনো ৫ মিলিগ্রাম দিই, কখনো একটা দিই। এটা নির্ভর করে যেই রোগীর ভালভ আমরা প্রতিস্থাপন করলাম, তার পিটি এবং আইএনআরের প্রতিবেদনের ওপর।
এতে করে রোগীর স্ট্রোকের আশঙ্কা কম থাকে। আর যেসব রোগীর বয়স ৫৫-এর ওপরে, তাঁদের আমরা টিস্যু ভালভ লাগানোর জন্য পরামর্শ দিই। টিস্যু ভালভের সুবিধা হলো, লাগানোর পর আর ওয়ারিন ট্যাবলেট খেতে হয় না। এতে করে প্রতি মাসে তাঁকে আমাদের কাছে আসতে হয় না। তবে অসুবিধা হচ্ছে ভালভের মেয়াদ থাকে ১৫ থেকে ২০ বছর। এর পর আবার প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। এ জন্য বয়স্ক লোকদের আমরা এটা করার পরামর্শ দিই। আর তরুণদের বলি, আপনারা মেকানিক্যাল ভালভ লাগান। এটা সারা জীবন চলে যায়। তবে ভালভ লাগানো যত সোজা, মেনে চলা তত কঠিন।
প্রশ্ন : মেনে চলার জন্য আপনারা কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : এর জন্য প্রথম পরামর্শ হলো আমাদের কাছে একটু ফলোআপের জন্য আসা, শরীরে যেকোনো অংশে ভালভ লাগানোর পর রক্তপাত শুরু হতে পারে তখন ওয়ারিন ট্যাবলেট খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া। বাংলাদেশ সরকার প্রতিজ্ঞাবন্ধ এর চিকিৎসার জন্য। সরকার বাতজ্বরের চিকিৎসার জন্য তো হাসপাতাল খুলেছেই। কেবল তাই নয়, যাঁদের ভালভ যুক্ত রয়েছে, তারাও আমাদের কাছে আসে এবং সরকার প্রচুর ভালভ গরিব রোগীদের জন্য বিনা পয়সায় দেয়। রোগীদের প্রয়োজনে বিনামূল্যে সেগুলো হৃদরোগ হাসপাতালে প্রতিস্থাপন করা যায়।