মুখের রোগে তামাকের সম্পর্ক কী
তামাক সেবনে বিভিন্ন ধরনের মুখের রোগ হয়, যা একপর্যায়ে অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আজ ২৭ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৭৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন তামাকবিরোধী আন্দোলনের প্রধান উদ্যোক্তা ডা. অরূপ রতন চৌধুরী।
প্রশ্ন : তামাকজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে কোন কোন বিষয়গুলো পড়ে?
উত্তর : তামাককে আসলে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি। একটা হলো স্মোকিং টোব্যাকো, যেটা ধোঁয়া নির্গত করে। যেমন : সিগারেট, বিড়ি, হুক্কা। আরেকটি হলো, নন স্মোকিং টোব্যাকো। যেমন : জর্দা, খৈনি, দোক্তা, গুল, সাদা পাতা। এগুলোর ধোঁয়া দেখা যায় না। নীরবে কেউ পানের সঙ্গে খায়। কেউ নেশা করার জন্য গালের মধ্যে রেখে দেয়। কেউ আবার দাঁত মাজার জন্য গুল ব্যবহার করে।
অনেকে মনে করেন সিগারেট গ্রহণ করলে ক্ষতি বেশি হয়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, দুটোর ক্ষতি সমানভাবেই হয়। অর্থাৎ যার ফুসফুসের ক্যানসার হয়, ধূমপানের কারণে তার তামাক-জর্দার কারণে এই সমস্যা হতে পারে, হার্টে অসুখ হতে পারে। তারও ফুসফুসে ক্যানসার হতে পারে, মস্তিষ্কে স্ট্রোক হতে পারে। সুতরাং এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে দুই ধরনের তামাকই আমাদের দেহের জন্য ক্ষতি করে। তামাকজাত দ্রব্য কী কী রয়েছে সেগুলোও আমাদের জানতে হবে।
প্রশ্ন : মুখের এবং দাঁতের কোন কোন রোগ তামাকের কারণে হতে পারে?
উত্তর : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে এশিয়া মহাদেশ, ভারত বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান এসব অঞ্চলগুলোতে ধোঁয়াহীন তামাকের ব্যবহার বেশি। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মুখ গহ্ববরের ক্যানসারের প্রাদুর্ভাব এসব অঞ্চলে বেশি।
সম্প্রতি ভারতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছে, সেই সম্মেলনে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এবং ভারত ধোঁয়াহীন তামাকের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। অর্থাৎ আমাদের দেশে যে বয়সের লোকেরা তামাক গ্রহণ করত এখন দেখা গেছে আরো কম বয়সী লোকের মধ্যেও এই জাতীয় তামাক গ্রহণের মাত্রা বেড়ে গেছে। তাহলে সব মিলিয়ে বলা যায় বাংলাদেশ তামাকের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। এই জন্য দেখা গেছে বাংলাদেশেও মুখের ক্যানসার, ঠোঁটের ক্যানসার এগুলোর হার সবচেয়ে বেশি। আমার নিজস্ব হাসপাতালেও যত রোগী আসে, তাদের ৩০ শতাংশ মুখে ঘা নিয়ে আসে। তাদের ইতিহাস থেকে জানা যায় কোনো না কোনোভাবে তারা তামাক গ্রহণ করেছে; হয় সিগারেট, নয়তো জর্দা গ্রহণ করেছে।
আমরা যাঁরা চিকিৎসক, সবারই উচিত রোগীর একটা ইতিহাস নেওয়া। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এটি থেকে জানা যায় সে ধূমপায়ী কি না বা জর্দা গ্রহণ করে কি না। মুখের যেকোনো ধরনের রোগের সঙ্গে এখন তামাক জাতীয় জিনিসের সম্পৃক্ততা বেশি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
যেমন, ফুসফুসের ক্যানসারের সঙ্গে ধূমপান বা তামাকের যেই সম্পৃক্ততা রয়েছে তা আজ থেকে ১০০ বছর আগে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। এখন ৫০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষের যে ফুসফুসে ক্যানসার হয়, এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ধূমপান।urgentPhoto
আমি একজন ডেনটিস্ট হিসেবে রোগী এলে ইতিহাস প্রথমে নিই। তখন যদি জানতে পারি তিনি ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করেছেন, আমার চিকিৎসাপত্রে প্রথম বিষয়টিই হয়, তাকে ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে। একজন ডেনটিস্ট হিসেবে আমি তাকে প্রথমে পরামর্শ দিই এবং তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি কেন এটা ছাড়া উচিত। এটা প্রত্যেক চিকিৎসকের উচিত রোগীকে ওই বিষয়ে কাউন্সেলিং করা। এটা চিকিৎসার একটি অংশ। আমি যদি রোগীকে কেবল ওষুধ দিয়ে দিই, সে যদি ধূমপান করতে থাকে, জর্দা খেতে থাকলে তার ঘা শুকাবে না। সুতরাং মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো তাকে পরামর্শ দেওয়া এবং অভ্যাসটি থেকে ত্যাগ করানো। অর্থাৎ ধূমপান বা তামাক যাতে ছাড়তে পারে, সেই আত্মবিশ্বাসটি এনে দিতে হবে। আমি যদি ব্যর্থ হই, তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে পারি।
তামাক একধরনের নেশা। সাত হাজার রাসায়নিক পদার্থ তামাকের মধ্যে থাকে। এর মধ্যে ৭০টি কারসিনোজেন যেটা ক্যানসারের জন্য দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সাত হাজার রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে একটি হলো মারাত্মক ক্ষতিকর যেটাকে বলা হয় ড্রাগ, যেটা হলো নিকোটিন। এই নিকোটিন যখন একটা সিগারেট টানার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের রিসেপটর কোষে যায়, তখন সে আরো নিকোটিন চায়। তখন তার নেশা বাড়তে থাকে। সে এটার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। তখন এটা ছাড়া থাকতে পারে না। জর্দার ক্ষেত্রেও একই বিষয়। সে নির্ভশীলতা তৈরি হওয়ার কারণে ছাড়তে পারে না। তাই মাদকাশক্তির মতো একই বিষয় তামাকাশক্তি। তাকে মুক্ত করার জন্য পরামর্শ এবং চিকিৎসা দরকার।
প্রশ্ন : মুখগহ্বরের ক্যানসার শুরুর দিকে কীভাবে প্রকাশ পায়?
উত্তর : মুখে নানা ধরনের ঘা হয়। যদি লিউক্লোপ্লাকিয়া হয় এটি ক্যানসারের পূর্বাবস্থা। আমার চিকিৎসাপত্র হবে তাকে বায়োপসি করানো। মুখের ঘা যদি তিন সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়, অবশ্যই সেই ঘা-এর বায়োপসি করে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন সেটা ক্যানসার, না কি অন্যকিছু। লিউক্লোপ্লাকিয়া হলে কেন হয়েছে রোগীর ইতিহাস নিলে জানা যাবে। তাকে পান, জর্দা, তামাক ইত্যাদি থেকে ছাড়াতে হবে। যদি সার্প টিথ থেকে হয়, দেখা যায় নানা ধরনের সমস্যা আছে সেগুলো ভিটামিনের অভাবেও হয়। রক্তের প্রোফাইল দেখলে বুঝতে পারব কোন ভিটামিনের অভাবে হচ্ছে। ভিটামিন বি ১২, আয়রন সেগুলোর অভাব থাকলেও মুখে ঘা হয়। সুতরাং ঘায়ের নানা কারণ এবং ব্যাখ্যা আছে। কোনটার সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করব। তারপর সেই চিকিৎসার পরামর্শ নিলে রোগী ভালো হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: যখন আপনারা রোগ নির্ণয় করে দেখেন ঘা মুখের ক্যানসারের দিকে যেতে পারে সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসা কী হয়?
উত্তর : যদি বায়োপসি করে দেখি ক্যানসার হয়েছে তখন নির্দিষ্ট জায়গায় রেফার করি। যেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা হয়।
প্রশ্ন : প্রতিরোধের বিষয়টি একটু ছোট্ট করে বলে দিন।
উত্তর : প্রথম প্রতিরোধ হচ্ছে তামাক ছেড়ে দেওয়া। দ্বিতীয় প্রতিরোধ হচ্ছে তামাক ছেড়ে দেওয়া। তৃতীয় প্রতিরোধ হচ্ছে তামাক ছেড়ে দেওয়া। এর কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং আমরা সব সময় বলি তামাক থেকে মুক্ত হতে হবে। পানের সঙ্গে জর্দা যেমন খাওয়া যাবে না এবং সিগারেটও গ্রহণ করা যাবে না। এ দুটোই আমাদের জীবনে নিশ্চিতভাবে মুখের ক্যানসারসহ ২৫টি রোগ সৃষ্টি করতে পারে। দেহের এমন কোনো অঙ্গ নেই যে তামাক ক্ষতি করে না। যেটার পরিমাণ ভয়াবহ। আমরা যেমন রোগীকে চিকিৎসকরা তামাকমুক্ত থাকার জন্য পরামর্শ দিই, তেমনি প্রত্যেকে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও তামাকমুক্ত থাকার জন্য পরামর্শ দেবেন।