স্ট্রোক প্রতিরোধে অস্ত্রোপচারের ভূমিকা কী
স্ট্রোক একটি জটিল সমস্যা। তবে স্ট্রোক প্রতিরোধে ভাসকুলার সার্জনদের কিছু ভূমিকা রয়েছে। আজ ২৯ জুন, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৮১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অ্যাপোলো হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক জেনারেল লেপারোস্কপিক অ্যান্ড ভাসকুলার সার্জন, যিনি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে এ জাতীয় কাজ করেছেন—ডা. এস এম জি কিবরিয়া।
প্রশ্ন : আমরা জানি, আপনি সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন এবং এর আগে প্রায় তিন দশক বিদেশে পরামর্শক হিসেবে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। স্ট্রোক প্রতিরোধে ভাসকুলার সার্জন হিসেবে আপনি ভূমিকা রাখছেন। শুরুতে একটু বলুন, স্ট্রোক বিষয়টি কী এবং কাদের বেশি হয়?
উত্তর : ক্যানসার ও হার্ট অ্যাটাকের পর পৃথিবীতে যে জিনিসটায় মানুষে মারা যায় বেশি, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশে, সেটা হচ্ছে স্ট্রোক। স্ট্রোকের কারণ হচ্ছে মস্তিষ্কের কোনো একটি জায়গায় হঠাৎ করে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর যে জায়গাটার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সেই জায়গাটা শরীরের যে অংশটুকুকে চালাত বা নিয়ন্ত্রণ করত, সেই জিনিসগুলো অবশ হয়ে যায়। কখনো যদি এটা বিরাটভাবে হয় তখন দেখা যায়, কোনো একটি মানুষের শরীরের একটা অংশ কাজ করছে না। এমন হয় অনেকে কথা বলতে পারেন না, খেতে পারেন না এমন পরিস্থিতি হয়।urgentPhoto
প্রশ্ন : এটা কাদের বেশি হয়?
উত্তর : যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, যারা ডায়াবেটিক, যারা ধূমপান করেন আর যাদের উচ্চ কোলেস্টেরল—এরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রশ্ন : এগুলো থাকার জন্য একজন মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ, তবে সবার স্ট্রোক হয় না, কারো কারো হয়। কেন?
উত্তর : মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের জন্য হতে পারে, হার্টের থেকে হতে পারে। রক্তের একটা অংশ মস্তিষ্কে চলে যেতে পারে। আর আরেকটি বিষয়, যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেটা এ দেশের মানুষের মধ্যে এখনো জানাশোনা নেই, সেটা হচ্ছে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল করার যে পাইপ, যেটাকে কেরোটিস আর্টারি বলি, এখানে হার্টের পাইপে যেমন ব্লক হয়ে যায়, ঠিক সে রকমটা হয়। হার্টে যদি অ্যাটাক হয়, একে বলা হয় হার্ট অ্যাটাক, আর স্ট্রোকটাকে মস্তিষ্কের অ্যাটাকও বলতে পারেন। এর চিকিৎসা আমাদের কাছে আছে। একজন সার্জন এই চিকিৎসা দিতে পারেন।
প্রশ্ন : কেরোটিস আর্টারিতে কী সমস্যা হলে একজন মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। সে ক্ষেত্রে স্ট্রোক করার আগেও তার কোনো লক্ষণ দেখা দিতে পারে কি না?
উত্তর : আমরা ডাক্তারি ভাষায় বলি সিগনিফিকেন্ট স্টেনোসিস। এই আর্টারি কতটুকু চিকন হয়েছে, তার ওপরে ঝুঁকিটাকে নির্ণয় করি। যখন চিকন হতে হতে প্রায় ৭০ শতাংশের দিকে চলে যায়, আমরা বলি, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এই ৭০ ভাগ চিকন হওয়ার পর আরো বেশি চিকন যদি হতে থাকে, তাহলে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। এর সঙ্গে তাদের যদি ডায়াবেটিস থাকে, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, কিডনির রোগ থাকে অথবা হার্ট অ্যাটাকের আগে কোনো ইতিহাস থেকে থাকে, তাদের ঝুঁকি আরো বেশি। আর আমরা এই ভাসকুলার সার্জনরা এই করোটিস আর্টারিকে সার্জারি করি। যাদের একবার এ সমস্যা হয়ে গেছে, তাদের আর যেন না হয়, এ জন্য রোগ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : যদি নালিটি চিকন হয়ে ছোট হয়ে যায়, তখন প্রাথমিকভাবে কোনো লক্ষণ দেখা দেবে কি না?
উত্তর : কারো কারো শুধু ঘটনাক্রমে ধরা পড়ে। আবার কারো কারো, আমরা যেটাকে বলি মিনি স্ট্রোক, এ ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে আপনি হঠাৎ করে চোখে অন্ধকার দেখলেন, কিছুই দেখছেন না এক চোখে। ঘণ্টাখানেক পর আবার আপনার চোখের দৃষ্টিটা ফিরে এলো। এটা এক ধরনের মিনি স্ট্রোক। আবার পুরোপুরি স্ট্রোক বৃদ্ধি পেল, তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্ট্রোকটা ভালো হয়ে গেল। এটাও মিনি স্ট্রোক। যেই স্ট্রোক ২৪ ঘণ্টার বেশি হচ্ছে, একে আমরা পুরোপুরি স্ট্রোক বলছি। উভয় ক্ষেত্রে আমরা সার্জনরা পরবর্তী অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে পারি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। এবং এই পরবর্তী অ্যাটাকটা সাধারণত ১৫ দিনের মধ্যে হয়।
প্রশ্ন : একবার কেউ স্ট্রোক করলে তার পরবর্তী সময়ে স্ট্রোকের ঝুঁকি কতখানি?
উত্তর : বছরে শতকরা ২৫ ভাগ। তার মানে যদি ১০০ জনকে ধরেন, এর মধ্যে ২৫ জনের এ সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে আপনারা নিশ্চিত হোন, কীভাবে আবার যে স্ট্রোক হবে এর জন্য কেরোটিস আর্টারি কোনো ভূমিকা রাখছে কি না? এবং তখন কী করণীয়?
উত্তর : স্ট্রোকের রোগীরা সরাসরি আমাদের কাছে আসেন না। প্রথমে নিউরোফিজিশিয়ান বা নিউরোলজিস্টের কাছে যান। তবে যাঁরা নিউরোলজিস্ট, যাঁরা জানেন যে এই ব্যাপারে একজন সার্জন আছেন, তাঁদের কাছে পাঠান। আবার কিছু রোগী সরাসরি আমাদের কাছে আসেন যে এ কারণে এই সমস্যা হয়েছে কি না। তখন আমরা একটা আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যানের মাধ্যমে এটা বলে দিতে পারি।
প্রশ্ন : যখন দেখেন এর কারণে হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আপনারা কী করেন?
উত্তর : আমরা যেটা করি, প্রথমে রোগীকে বলি আপনার এ সমস্যা হয়েছে। আপনার আরেকবার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা কী করতে পারি। এবং এই সার্জারি করলে কী উপরকার হবে। উপকার হচ্ছে, এটাই আপনার স্ট্রোক হওয়ার আরেকবার যে আশঙ্কা, সেটা হয়তো আমি সম্পূর্ণ কমিয়ে দিতে পারছি না। তবে এ কারণে সমস্যাটি আর হবে না।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে আপনারা তো সার্জারি করেন?
উত্তর : অবশ্যই। এই অস্ত্রোপচার হচ্ছে সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় আমরা মস্তিষ্কের রক্ত চলাচলকে বন্ধ করে দিয়ে এই ধমনিটাকে আমরা খুলি। খুলে ভেতরে যে ময়লাটা আছে এটা বের করে দিই, চর্বিকে বের করে দিই। এরপর আবার ধমনিটাকে সেলাই করে দিই। যখন অস্ত্রোপচারটা চলতে থাকে, আমরা রোগীর সঙ্গে কথা বলতে থাকি। আমি বলব, এই অস্ত্রোপচার অত্যন্ত সূক্ষ্ম, অত্যন্ত জটিল। তবে এতে অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয় না। এবং রোগীর জন্য কোনো ভীতিপ্রদ কাজ নয়। এটা জটিল হলেও যাঁরা জানেন করতে, তাঁদের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ অবশ্যই না।