ওজন কমাতে অস্ত্রোপচার কখন করবেন
বেরিয়াট্রিক সার্জারি দেশে এখনো তেমনভাবে প্রচলিত নয়। ওজনাধিক্য লোকের ওজন কমানোর জন্য এই সার্জারি করা হয়। আজ ৫ জুলাই এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৮৭তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সরদার এ নাইম।
প্রশ্ন : বেরিয়াট্রিক সার্জারি খুব বেশি পরিচিত নাম নয় এখন পর্যন্ত। শুরুতেই জানতে চাইব, বেরিয়াট্রিক সার্জারি কী?
উত্তর : বেরিয়াট্রিক সার্জারিকে অন্যভাবে ওবেসিটি সার্জারি বলতে পারি। অতিরিক্ত মেদবহুল শরীরকে কমানোর জন্য যে সার্জারি, সেটা বেরিয়াট্রিক সার্জারি। ওজনাধিক্য কেবল যে আমাদের দেশে আছে, তা নয়। সারা বিশ্বেই এটি একটি সমস্যা। কোনো কোনো সময় ওজনাধিক্য এমন একটি পর্যায়ে চলে যায়, তখন সার্জিক্যাল চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আমরা অবশ্যই বলি, খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে যদি ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটা অনেক ভালো। যাঁদের ওজন পর্যায় এক বা দুইয়ে থাকে, হয়তো ডায়েট করে ব্যায়াম করে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তবে তিনের বেশি হয়ে গেলে আর এগুলোতে সম্ভব হয় না। তখন এই সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।
বেরিয়াট্রিক সার্জারির যদি সংজ্ঞা বলা হয় তাহলে বলতে হয়, যে সার্জারির সাহায্যে শরীরের ওজন কমানো হয় এবং ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন—এ জাতীয় কিছু রোগেরও উপকার পেতে পারি। এ জন্য আমরা বেরিয়াট্রিক ওবেসিটি সার্জারির পাশাপাশি মেটাবলিক সার্জারিও বলি। এর মাধ্যমে একসঙ্গে অনেক উপকার পাওয়া যায়। বিশেষত, যাঁদের ওজনের সমস্যা রয়েছে তাঁরা।urgentPhoto
প্রশ্ন : কাদেরকে আপনারা আসলে ওবেস (স্থূল) লোক বলছেন?
উত্তর : মূলত আমরা বি এমআই (বডি মাস ইনডেস্ক) দেখি। এটি ভাগের পদ্ধতি, উপরে ওজন কেজিতে এবং নিচে উচ্চতা মিটার স্কয়ারে—এই ক্যালকুলেশন করলে বিএমআই পেয়ে যাবে। ১৮ দশমিক ৫-এর নিচে হলে তাকে কম ওজন বলি। ১৮ দশমিক ৫ থেকে ২৬ পর্যন্ত বার সেটাকে স্বাভাবিক ওজন বলি। এর পর ২৬ থেকে ৩০ পর্যন্ত বলি বাড়তি ওজন। আমাকে যেমন দেখা যাচ্ছে, আমিও বেশি ওজনের।
প্রশ্ন : তবে একজন মানুষের বাড়তি ওজন হলেই কি বেরিয়াট্রিক সার্জারির প্রয়োজন হয়?
উত্তর : ওজনাধিক্য হয় ৩০-এর ওপরে। ৩০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে ক্লাস ওয়ান ওজনাধিক্য হয়। ৩৫ থেকে ৪০ হলে এটা ক্লাস টু ওজনাধিক্য। ৪০-এর ওপরে হলে ক্লাস থ্রি ওজনাধিক্য। এই বাড়তি ওজনের লোকগুলোকে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ বা ব্যায়ামের মাধ্যমে কোনোভাবেই ঠিক করা যায় না, যদি বাস্তবিকভাবে বলি। তবে যদি খুব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হয়ে সে না নামে। বেশি ডায়েট ব্যায়াম করলে আবার ক্ষতি হবে। কারণ, বাড়তি ওজনের লোকদের কেবল এটিই তো সমস্যা নয়, এর সঙ্গে তাঁদের ডায়াবেটিস এবং হাইপার টেনশন থাকছে, আর্থ্রাইটিস হচ্ছে।
বাড়তি ওজনের কারণেই আর্থ্রাইটিস হয়ে যাচ্ছে। কারণ, হাঁটুগুলো বেশি ওজন বইতে বইতে আর ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, ব্যায়ামও করতে পারে না। এর জন্য আমাদের এই সার্জারিতে যেতে হয়। তবে এটা সম্ভব হয়েছে ল্যাপারেস্কোপিক সার্জারির জন্য। কারণ, অত বড় মানুষের পেট কেটে সার্জারি না করে যদি ল্যাপারেস্কোপ দিয়ে করি, সেটা অনেক সহজ হয় রোগীর জন্য।
প্রশ্ন : এই সার্জারি কীভাবে করতে হয়?
উত্তর : এই সার্জারিতে ওজনাধিক্য লোকের পাকস্থলীর পরিমাণ কমিয়ে দিই। দুই-তিন রকমের অস্ত্রোপচার হয়। পাকস্থলী থেকে খাবার শোষণ শুরু হয়। আমরা যদি খাবার গ্রহণ ও শোষণ দুটোই কমিয়ে দিতে পারি, তাহলে এমনিতেই ওজন কমে যাবে।
একটা করি স্লিপ গ্ল্যাসট্রেকটোমি; ল্যাপারেস্কোপি দিয়ে পেটের মধ্যে ঢুকে পাকস্থলীর বাইরের দিকে বেশ খানিকটা অংশ কেটে ফেলে দিই। পাকস্থলীর তিন ভাগের দুই ভাগ ফেলে দিয়ে এক ভাগ রাখি। সার্জারির পর রোগী তরলজাতীয় খাবার দিয়ে শুরু করি, পরে ভারী খাবার দিই, তবে গ্রহণটা কমে যায়। আমাদের ক্ষুধা হয়, ক্ষুধা মস্তিষ্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। পাকস্থলী যখন ভরে যায়, তখন মস্তিষ্ক আপনাতেই জেনে যায় তার আর খাওয়া সম্ভব নয়। তখন এমনিতেই খাওয়া কমতে থাকে। এর ফলাফল খুব ভালো হয়।
আরেক ধরনের সার্জারি হয়, একে বলা হয় রুয়েন ওয়াই বাইপাস। আরেকটি মিনিগ্যাসট্রিক বাইপাস। আমি সাধারণভাবে বোঝানোর জন্য বলছি, পাকস্থলী থেকে তখন খাদ্যগুলো ক্ষুদ্রান্তের মধ্য দিয়ে যায়, সেই জিনিসটাকে যদি আমরা ছোট করে দিই, কারণ এই পথ দিয়ে যেতে যেতেই সে শোষণ হয়। আমরা যদি এটাকে আধা পথেই পাকস্থলীর সঙ্গে লাগিয়ে দিতে পারি, তাহলে খাদ্যটা আধা পথ পর্যন্ত গেল। এসব সার্জারির মাধ্যমে পাকস্থলী কমিয়ে দেওয়া বেরিয়াট্রিক সার্জারির উদ্দেশ্য। এটা বিভিন্ন স্ট্যাপলার দিয়ে ল্যাপারেস্কোপির মাধ্যমে করা হয়।
প্রশ্ন : এই ফলটা কত দিন পরে ভোগ করে, কত দিন পরে ফলোআপের জন্য আসতে বলেন?
উত্তর : জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে আমরা এই সার্জারি শুরু করেছি। অনেক কেস করেছি। প্রতিটি কেসের ফলাফল ভালো। ১২০ কেজি ওজনের মানুষটি ছয় মাসের মধ্যে ১০০ কেজির নিচে নেমে আসে। তবে রোগীদের প্রথম কিছু অসুবিধা হয়, আমাদের খুব কাছে থেকে দেখতে হয়। কেবল সার্জারি করে ফেললাম, এটাই শেষ নয়। এর জন্য একটি টিমের প্রয়োজন, ফলোআপের প্রয়োজন। কারণ যে শোষণটা বন্ধ করে দিচ্ছি, সেখানে অর্ধেক মিনারেল ও ভিটামিনও শোষণ হচ্ছে না। তখন একজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট লাগে, তিনি এই হরমোন ঠিক করেন। একজন প্লাস্টিক সার্জন লাগে। এত বড় পেট ছিল, সার্জারি করার পর তো চামড়াটা ঝুলে যায়। তখন অনেক সময় চামড়া ফেলে দেওয়ার জন্য প্লাস্টিক সার্জন লাগে। তাই এটাকে আমরা দলভিত্তিক কাজ বলছি। এখন ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার জন্য এই সার্জারিকে ভাবা হচ্ছে। যেসব ওবেস লোক এই সার্জারি করেন, করার পর ইনসুলিনের ডোজও কম দিতে হয়।
আমি বলব, এই সার্জারি করার মতো যেন কারো জীবনে অভিশাপ না আসে। ওজন বেড়ে গেলেই আমাদের উচিত সার্জারি করা।