কোলন ক্যানসারের জন্য দায়ী পশ্চিমা খাবার?
ক্যানসার এক মরণব্যাধি। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা শুরু করলে রোগ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আজ ২ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১০৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন দেশের খ্যাতনামা ক্যানসার বিশেষজ্ঞ জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াররফ হোসেন।
প্রশ্ন : শুরুতে একটু বলেন সাধারণত কী কী ক্যানসারে মানুষ আক্রান্ত হয়?
উত্তর : পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসার বাংলাদেশে এক নম্বর। আর মেয়েদের মধ্যে আগে জরায়ুর ক্যানসারের হার বেশি ছিল। তবে এখন স্তন ক্যানসারের হার জরায়ুর ক্যানসারের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর যদি পুরুষ ও নারী দুজনের কথা বলি, তাহলে হেড নেক ক্যানসার বেশি। গলনালি, শ্বাসনালি, জিহ্বা, মুখগহ্বর এ ধরনের ক্যানসার বেশি। হেডনেক ক্যানসার আমাদের দেশে এত বেশি কেন? এর একটি মাত্র কারণ তামাকজাত দ্রব্য।
প্রশ্ন : এর বাইরে আর কী কী গুরুতর ক্যানসার রয়েছে?
উত্তর : এ ছাড়া রয়েছে পাকস্থলীর ক্যানসার। পাকস্থলীর ক্যানসার আমাদের দেশে মোটামুটি অনেক। একসময় জাপানে পাকস্থলী ক্যানসার অনেক বেশি ছিল। তখন জাপানে দারিদ্র্য ছিল। স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না। তবে এখন জাপান বেশ উন্নত দেশ হিসেবে পরিগণিত। তাদের দেশে এখন প্রতিবছরই স্ক্রিনিং বা এন্ডোস্কোপি বা অন্য পরীক্ষা করে দেখা হয় ক্যানসার আছে কি না। এই করেই তারা পাকস্থলীর ক্যানসার অনেক কমিয়ে এনেছে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আমরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি, তাই আমাদের দেশেও যদি ক্যানসার পরীক্ষা বা স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা থাকে তাহলে আমাদের দেশেও পাকস্থলীর ক্যানসারের হার অনেক কমে যাবে।
প্রশ্ন : কোলোরেক্টাল বা কোলন ক্যানসার সম্বন্ধে অনেক শোনা যায়। অনেক জনপ্রিয় লোক এই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন। বিশেষ করে লেখক হুমায়ূন আহমেদ...
উত্তর : এটা আসলে ছিল পশ্চিমাদের ক্যানসার। বিশেষ করে উন্নত দেশে ছিল। আমরা বলি যেসব দেশে ফ্যাটি ফুড বেশি খাওয়া হয়, যে খাবার খেলে পাঁচ-সাতদিনও তাকে টয়লেটে যেতে হয় না- এই ধরনের খাবারগুলো খেতে যাঁরা অভ্যস্ত, তাদের এই ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ওই ধরনের খাবারগুলোতে যে কারসেনোজেন থাকে, সেটা যদি মলদ্বার বা মলাশয়ে অনেক দিন ধরে থাকে সেই কারসেনোজেন ধীরে ধীরে অস্বস্তিকর উপাদান হিসেবে কাজ করে কোলোরেক্টাল ক্যানসার তৈরি করে। ইদানীং আমাদের দেশেও এই ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কারণ আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরা এই ধরনের পশ্চিমা খাবারে অভ্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। আমার আশঙ্কা আজ থেকে ২০ বছর পরে আমাদের দেশেও এটা একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। সে জন্য আগেই প্রতিরোধ দরকার।
প্রশ্ন : আমরা জানি শরীরের যেকোনো অংশেই ক্যানসার হতে পারে। সাধারণত কী কী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন ক্যানসার হলে?
উত্তর : মানুষের বোঝার জন্য সহজ ভাষায় বলি, তিনটি চিকিৎসা করা হয়। সার্জারি অথবা শল্যচিকিৎসা, রেডিও থেরাপি অথবা বিকিরণ চিকিৎসা, আর একটি কেমোথেরাপি বা ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা।
আমরা যদি দেখি রোগটি এক জায়গায় সীমাবদ্ধ, অন্য কোথাও যায়নি সেই সমস্ত ক্ষেত্রে সার্জারি অথবা রেডিও থেরাপি যেকোনো একটি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে এটা নির্ভর করবে ওই রোগটি রেডিও থেরাপিতে সংবেদনশীল কি না তার ওপর। যদি রেডিও থেরাপিতে সংবেদনশীল না হয় তাহলে সার্জারি একমাত্র উত্তর। আর যখন রোগটা ছড়িয়ে যায় এর পরেই আমাদের এমন কোনো চিকিৎসা করতে হবে যা সারা শরীরে কাজ করবে এবং রোগটিকে ধ্বংস করবে। সেই ক্ষেত্রে আমরা কেমোথেরাপি বা ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করি।
মহিলাদের এক ধরনের ক্যানসার হয় যেটাকে করিওকারসিনোমা বলি। রোগটি যদি জরায়ুতে সীমাবদ্ধও থাকে, সেই ক্ষেত্রে তার চিকিৎসা এই কেমোথেরাপি। এবং এই চিকিৎসায় ১০০ জন মহিলার মধ্যে ৯৫ জনের ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার তিনটি চিকিৎসাই প্রয়োজন। যেমন : স্তন ক্যানসার।
আমরা বলি, যেখানে স্তন ক্যানসার হলো, সেখানে অস্ত্রোপচার করে ফেললাম তাহলে আর চিকিৎসার দরকার কী? কিন্তু যদি পরবর্তী চিকিৎসাগুলো আমরা না দিই ছয় মাস, সাত মাস বা এক বছর পরে ওই রোগীটি ফুসফুস, লিভার বা হাড় অথবা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যেতে পারে। সে জন্য আমরা কেমোথেরাপি প্রয়োগ করি। তাহলে রোগটি আবার হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।
আর রেডিও থেরাপি সব ক্ষেত্রে লাগে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে সার্জারির পরে স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি করে থাকি। সে ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কতগুলো নিয়ম আছে সেটি অনুযায়ী চিকিৎসা করে থাকেন।
প্রশ্ন : চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভালো হওয়াটা নির্ভর করে কোন কোন বিষয়ের ওপরে?
উত্তর : রোগটি যখন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে থাকবে তখন চিকিৎসার জন্য এলে সে অনেক লাভবান হবে। আর রোগটি যখন সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যাবে এত বড় বিষয়টিকে দমন করা সত্যি খুব কঠিন কাজ। ক্যানসারের সমস্ত চিকিৎসাই বিষ। বিষকে বিষ দিয়ে শেষ করতে হয়। এই বিষ হজম করার মতো শারীরিক শক্তি থাকতে হবে। সুতরাং আমি সব সময় বলি, রোগটা যখন প্রথমে শুরু হলো তখন আসেন এবং শক্তি থাকতে আসেন। যদি এই দুটো শর্ত মেনে চলা যায় তাহলে ক্যানসার নিরাময় সহজ। ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক অনেক গুণ বেশি।
পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে অনেক বিজ্ঞাপন বা লেখালেখি করা হয় গ্যারান্টি দিয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া হয় এসব বিষয়ে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তখন মানুষ এসব প্রতারণার শিকার হয়ে অপচিকিৎসকের কাছে যায়। সময় ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায়। ফলে রোগীটির প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে যে ভালো বিষয়টি হতো এর সম্ভাবনা কমে যায়। চিকিৎসা দুরূহ হয়ে পড়ে।