করনারি হার্ট ডিজিজের চিকিৎসায় কী করবেন?
করনারি আর্টারি রোগ বেশ জটিল একটি রোগ। তবে বাংলাদেশে এখন এর সফলভাবে চিকিৎসা হচ্ছে। আজ ১১ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১১৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. শফিকুর রহমান পাটোয়ারি।
urgentPhoto প্রশ্ন : করনারি হার্ট ডিজিজ কঠিন একটি নাম। হৃদরোগের ভয়াবহতা সম্বন্ধে এখন আমরা বেশ সবাই জানি। করনারি হার্ট ডিজিজের মধ্যে আসলে কোন রোগগুলো পড়ে?
উত্তর : আমাদের হার্টের দুটো রক্তনালি থাকে। একটা হচ্ছে রাইট (ডান) করনারি আর্টারি। আরেকটি হচ্ছে লেফট (বাম)করনারি আর্টারি। এই দুটো রক্তনালির মাধ্যমে হার্টের নিজস্ব রক্ত চলাচল হয়। এর মাধ্যমে হার্ট অক্সিজেন এবং পুষ্টি নিয়ে থাকে। এই রক্তনালিতে কোলেস্টেরল জমার কারণে যদি ব্লক হয়, কোলেস্টেরল জমে প্লাক হয়, এই প্লাক হওয়ার কারণে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে। বাধাগ্রস্ত হলে যদি ৭০ ভাগের ওপরে ব্লক হয় তখন ব্যথা শুরু হয়। যেমন, কাজ করতে গেলে ব্যথা হবে। জোরে একটু কথা বলতে গেলে ব্যথা হবে। স্বাভাবিক কাজকর্মে আস্তে আস্তে ব্যথা বাড়তে থাকবে এবং এই ব্লকের পরিমাণ যদি ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ হয়ে যায় তাহলে তো ব্যথা অনেক বেশি হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, হার্টের রক্তনালি ব্লকজনিত কারণে বুকে ব্যথা হবে। এটাকে আমরা বলি করনারি আর্টারি ডিজিজ বা ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ এবং এই হার্টের রোগে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ থাকে। এক এক রোগী এক এক রকম লক্ষণ নিয়ে আসে। যেমন কোনো রোগী এসে বলে- আমি আগে কাজ করতে পারতাম এখন কাজ করলে বুকে ব্যথা হয়। আবার যদি বিশ্রাম নেই ব্যথা চলে যায়। যেটাকে আমরা বলি স্ট্যাবল এনজাইনা। কিছু কিছু রোগী এসে বলে আগে যেই ব্যথা ছিল সেটা দিন দিন বাড়ছে। তাহলে এই পর্যায়গুলোকে বলা হয় আনস্ট্যাবল এনজাইনা।
ব্যথাটা অনেক সময় ধরে আছে। ২০ থেকে ৩০ মিনিট ধরে আছে। রোগী প্রচণ্ড ঘামাচ্ছে, বমি হচ্ছে। ব্যথার তীব্রতা হচ্ছে। তখন একে আমরা হার্ট অ্যাটাক বলি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে করনারি আর্টারি রোগটি তিন ভাগে প্রকাশ পাচ্ছে। সাধারণত ব্যথার মাধ্যমেই রোগটি আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম দিকে ব্যথাটা কাজ করার ফলে হবে। বিশ্রামে গেলে ব্যথাটা কমে যায়। অথবা এক ধরনের ওষুধ আছে যেটা জিহ্বার নিচে দিলে বা স্প্রে দিলে ব্যথা কমে যায়। এই ভাবেই রোগগুলো লক্ষণ প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন : প্রাথমিকভাবে এই লক্ষণগুলো দেখেই কী আপনারা নিশ্চিত হয়ে যান যে তার করনারি হার্ট ডিজিজ হয়েছে?
উত্তর : বুকে ব্যথা অনেক কারণে হতে পারে। যেমন প্যাপটিক আলসার ডিজিজ যেটাকে গ্যাসট্রিক বলা হয় সেটা হলে হতে পারে। বুকের হাড়ে ব্যথা থাকলে, হার্টের সমস্যা হলেও ব্যথা থাকতে পারে। ফুসফুসের সমস্যা বিভিন্ন কারণে ব্যথা হতে পারে।
তবে হার্টের রোগীদের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ বিষয় রয়েছে। এদের হাঁটার পর, কাজ করার পর, সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর এই ব্যথা হয়। সাধারণত কাজের সাথে এই ব্যথাটা হয় বা আবেগজনিত কারণেও বুকের ব্যথা থাকতে পারে। এই ধরনের লক্ষণে যদি বুকে ব্যথা হয় এবং ওই অবস্থাটা কমার পর যদি ব্যথাটা কমে যায়, তখন হার্টের সমস্যা হয়েছে বোঝা যাবে। লক্ষণ দেখে রোগ নির্ণয় করা অনেকটাই সম্ভব। এরপরও যদি আমরা লক্ষণ দেখে রোগ না ধরতে পারি, সেই ক্ষেত্রে আমরা ইসিজি করি। ইকোকার্ডিওগ্রাম করা হয়। এরপর রক্তের কিছু পরীক্ষা করি। ইটিটি করি, এনজিওগ্রাম করা যায়। এ ছাড়া আরো কিছু পরীক্ষা করা যায়। এই ধরনের পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি ব্লক আছে কি না।
প্রশ্ন : যখন আপনারা নিশ্চিত হোন আসলেই ব্লক আছে এবং এর শতাংশ আপনারা বুঝতে পারেন তখন আপনাদের রোগীদের প্রতি কী পরামর্শ থাকে।
উত্তর : হার্টের রোগে অনেক ঝুঁকি আছে। যেমন এর মধ্যে ধূমপান খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি- এগুলো ঝুঁকি। তবে এই ঝুঁকিগুলো আমরা পরিবর্তন করতে পারি। তাকে ধূমপান বন্ধ করতে বলতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। ওজন বেশি থাকলে কমিয়ে আনতে হবে। মানসিক চাপ বেশি থাকলে, সেটি কমাতে হবে। এই কাজগুলোর পাশাপাশি রোগীকে কিছু ওষুধ দিতে হবে। আমরা কিছু ওষুধ দেই যেগুলো প্রয়োগ করার পর বুকে ব্যথা চলে যায়। কিছু ওষুধ আছে জিহ্বার নিচে দিচ্ছি। কিছু ওষুধ আছে খাওয়ার জন্য বলছি। খাওয়ার পর দেখা যায় ব্যথা কমে। এখন যদি ব্যথা বেশি থাকে তবে দেখা যায় ওষুধে কাজ হচ্ছে না। ওষুধ খাচ্ছে তবু ব্যথাও আছে। সেইক্ষেত্রে এনজিওগ্রাম করে হয়তো দেখা গেল ব্লক আছে। ব্লক যদি বেশি থাকে তখন ভালো করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্লক সারানোর জন্য রিং পরা যায়। আবার বাইপাস অস্ত্রোপচার করা যায়। যেখানে রিং পরানো যাচ্ছে না, খুব জটিল ব্লক সে ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইপাস অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে। এইভাবে চিকিৎসা করা হয়।
প্রশ্ন : আপনি এনজিওগ্রাম করার কথা বললেন রোগ নির্ণয়ের জন্য। এটি করার জন্য কিন্তু অনেকের ভেতরে ভীতি কাজ করে। এটি করা আসলে কতখানি জরুরি এবং আসলে কী ভয়ের কোনো বিষয় আছে?
উত্তর : এনজিওগ্রাম করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। কোন রোগীকে আমরা এনজিওগ্রাম করাব আর কাকে করাব না বলা রয়েছে। যেমন একটা রোগীর বুকে ব্যথা হচ্ছে, সে ওষুধপত্র খাচ্ছে তার কোনো সমস্যা নেই। তার এনজিওগ্রামের প্রয়োজন নেই। আর যদি কোনো রোগী ওষুধ খাচ্ছে তবুও ব্যথা কমছে না। ইটিটি করছে পজিটিভ দেখা যাচ্ছে। ইকোকার্ডিওগ্রাম করার পর দেখা যাচ্ছে ফাংশন কমে যাচ্ছে। ঝুঁকির কারণগুলো তার অনেক বেশি। এসব ক্ষেত্রে এনজিওগ্রাম করতে হবে।
এনজিওগ্রাম আসলে একটি এক্স-রে। হার্টের রক্তনালির এক্স-রেকে বলা হয় এনজিওগ্রাম। হার্টের রক্তনালিতো সাধারণ এক্স-রেতে দেখা যাবে না। এ জন্য রক্তনালির ভেতরে কিছু ডাই দেওয়া হয়। এটা দিলে আর্টারিগুলো খুব সুন্দর দেখা যায়। এই এক্স-রেতে রক্তনালির ছবিগুলো সুন্দর দেখা যাবে। যেসব জায়গায় ব্লক আছে এগুলো ভালো দেখা যাবে।
এটাকে অনেকে খুব জটিলভাবে নেয়। রোগীরা ভাবে বিশাল কিছু। বর্তমানে যন্ত্রপাতি ভালো থাকার জন্য এবং বিশেষজ্ঞ থাকার জন্য এনজিওগ্রাম খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ না। এই ক্ষেত্রে ভয় পাওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। এনজিওগ্রাম করলে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন কতটুকু ব্লক আছে। কতগুলো ব্লক আছে এবং কী করা উচিত। সুনির্দিষ্টভাবে চিকিৎসা নির্ধারণ করার জন্য এনজিওগ্রাম অবশ্যই প্রয়োজন।
প্রশ্ন : এনজিওগ্রামের পর যদি দেখা যায় অস্ত্রোপচার জরুরি, এটা কীভাবে করেন? বাংলাদেশে এটা কীভাবে করছেন, কতটুকু করছেন? সেটি জানতে চাচ্ছিলাম।
উত্তর : যদি একটি রোগীর সাধারণ একটি ব্লক থাকে এটার জন্য অস্ত্রোপচারের কথা বলি না। যেমন দুটি ব্লক আছে এগুলো স্ট্যান্ট করার মতো। যদি কম বয়সে দুটি ব্লক হয় তখন তাকে স্ট্যান্ট করতে বলি। আবার যাদের অনেক ব্লক থাকে তাদের স্ট্যান্ট করতে বলি। এটা করলে রোগী খুব দ্রুত বাড়িতে চলে যেতে পারে, দুই দিনের মধ্যে।
আজকালের সবাই খুব সক্রিয়। সবারই সময়ের অনেক মূল্য আছে। একটা রোগীর যদি এক মাস বাড়িতে বিশ্রামে থাকা লাগে তার কাজেরও তো সমস্যা হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে রক্তনালিতে এটা করা উচিত। এখন অনেক ভালো ভালো স্ট্যান্ট পাওয়া যায়। তবে এটা একটু ব্যয়বহুল । তবে যদি সামর্থ থাকে এটাই করানো উচিত।
আরেকটি হচ্ছে হয়তো ব্লকগুলো এমন যে স্ট্যান্ট লাগানো যাচ্ছে না। অর্থাৎ ব্লকগুলো এমনভাবে রয়েছে যে স্ট্যান্ট করা যায় না। আবার যদি ব্লকের সমস্যার সাথে ভালভের সমস্যা থাকে। তাহলে সাধারণত বাইপাস করা হয়। বাংলাদেশে এটা খুব সফলভাবেই করা হচ্ছে।