মস্তিষ্ক ও স্মৃতিশক্তিতে লবণের প্রভাব ভয়াবহ
অতিমাত্রায় লবণ খাওয়া উচ্চ রক্তচাপের একটি অন্যতম কারণ- এ ধারণা প্রচলিত রয়েছে অনেক বছর ধরেই। তবে কিছু গবেষণায় আরো বলা হয়, লবণ বেশি মাত্রায় খাওয়া মস্তিষ্কের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ লবণযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে স্মৃতি ও চিন্তার সমস্যার সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণাটি করা হয় কিছু ইঁদুরের ওপর। মানুষের ওপর করা প্রাথমিক অবস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ লবণযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে।
লবণের ভয়াবহ প্রভাবের বিষয়ে এ ধরনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট ওয়েবএমডিতে।
নতুন গবেষণায় গবেষকরা ইঁদুরের খাবারে আট থেকে ১৬ গুণ লবণ মেশান। আট থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায়, ইঁদুরদের স্মৃতি ও চিন্তার সমস্যা হচ্ছে- তাদের নতুন ও পরিচিত বস্তুগুলো আলাদা করতে সমস্যা হয়, বাসা তৈরি করতে সমস্যা হয়। এই আচরণগত সমস্যাগুলো বিশ্বের সব ইঁদুরের মধ্যে হতে পারে।
আর বেশি লবণ খেলে, মানুষের মধ্যে স্মৃতিশক্তির সমস্যা, চেনার সমস্যা, কাপড় পরা, রান্না, বিল দেওয়া ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজের অসুবিধা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
গবেষণাটির প্রধান এবং নিউইয়র্ক সিটির উইল করনেল মেডিকেল কলেজের নিউরোলজি ও নিউরোসাইন্সের প্রফেসর কসটেনটিনো ল্যাডেকোলা জানান, তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা ইঁদুরকে অনেক বেশি লবণ খাইয়েছিলেন। এটি স্বাভাবিক যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যাভ্যাসের প্রায় পাঁচ থেকে ছয় গুণ।
কেউ জানে না যুক্তরাষ্টের লোকেরা আসলে কী পরিমাণ লবণ খায় জানিয়ে ল্যাডেকোলা বলেন, ‘কারণ, বেশির ভাগ লবণ প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং রেস্টুরেন্টের খাবারের মধ্যে লুকায়িত অবস্থায় থাকে।’
আমেরিকান একাডেমি অব নিউরোলজির ফ্যালো পিংকি আগারওয়াল বলেন, গবেষণা পরিবর্তিত হতে পারে, রোগীদের খাদ্যাভ্যাসের ওপর।’
‘চিকিৎসকরা যখন লবণ ও রোগীর স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করেন, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের সমস্যা ও স্ট্রোকের ক্ষেত্রে’- তিনি বলেন।
‘একটি রোগীর যদি উচ্চ রক্তচাপ না থাকে, তার সঙ্গে সাধারণত আমরা লবণের বিষয়ে কথা বলি না। গবেষণাটি আমাদের একটি ভালো বিষয় দিয়েছে রোগীদের সঙ্গে লবণের বিষয়ে কথা বলার’- আগারওয়াল যোগ করেন।
লবণ কীভাবে কাজ করে
ইঁদুররা গবেষকদের দেওয়া খাবার খাওয়ার সময় দেখা যায় বাড়তি লবণ তাদের ক্ষুদ্রান্ত গিয়ে উদ্দীপনা তৈরি করে। এটি বেশি মাত্রায় টিএইচ১৭ উৎপন্ন করে। এটি শ্বেত রক্তকণিকার একটি ধরন। এটি ইমিউন সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত। এর কারণে ইমিউন সিস্টেমের আরেকটি উপাদানের মাত্রা বাড়ে। আর সেটি হলো আইএল-১৭ নামের একটি প্রোটিন।
আমাদের খাদ্যাভ্যাসের ওপর মস্তিষ্কের কার্যক্রমের উন্নতি নির্ভর করে। বেশি মাত্রায় আইএল উৎপাদন হলে মস্তিষ্ক নাইট্রিক অক্সাইড নামক রাসায়নিক পদার্থ সরবরাহ করতে পারে না। নাইট্রিক অক্সাইডের পরিমাণ কমে গেলে রক্তনালিগুলো শিথিল হতে পারে না। এতে মস্তিষ্কে কম রক্ত পরিবহন হয়। মস্তিষ্কের কাজকে ভালো রাখতে নাইট্রিক অক্সাইড প্রয়োজন।
নিউরোলজিস্ট ডেভিড হাফলার বলেন, ‘এই কারণে লবণ স্মৃতি ও চিন্তার সমস্যা তৈরি করে।’
বেশি লবণ, বেশি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়
২০১৩ সালে নিউরোলজিস্ট ডেভিড হাফলারের একটি গবেষণায় তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা দেখেন, বেশি লবণ টিএইচ১৭-এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় । এতে মাল্টিপল স্কেলেরোসিসের আশঙ্কা বাড়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন অটোইমিউন রোগ হয়। যেমন, সোরিয়াসিস, আইবিএস বা ইনফ্লেমেটোরি বাউয়েল ডিজিজ, রিউমাটোয়েড আরথ্রাইটিস ইত্যাদি।
‘আসলে লবণের ক্ষতিকর প্রভাব বেশ নাটকীয়’ – বলেন হাফলার ।
গবেষক ল্যাডেকোলা জানায়, ‘স্ট্রোক ও ডিমেনসিয়া বা স্মৃতিভ্রম হওয়ার একটি অন্যতম কারণ অতিরিক্ত লবণ খাওয়া।’
পিংকি আগারওয়াল বলেন, ‘রোগীরা কতটুকু লবণ খাচ্ছে, সেটি চিকিৎসকদের পরীক্ষা করা প্রয়োজন। বেশির ভাগ খাবার লবণ কেবল নিজেদের রান্না করা খাবার থেকে আসে না। লবণ থাকে প্রক্রিয়াজাত খাবার ও রেস্টুরেন্টের খাবারের মধ্যেও। তাই এটি গণনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।’
গবেষক ল্যাডেকোলা জানান, প্রতিদিন একজন ব্যক্তির ৫০০ মিলিগ্রাম লবণ প্রয়োজন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিক এর তুলনায় ছয়গুণ বেশি লবণ খায়।
বেশি লবণযুক্ত খাবার এড়িয়ে সমস্যার সমাধান
‘তবে বেশি লবণযুক্ত খাবার এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়’- বলেন আগারওয়াল।
গবেষক ল্যাডেকোলার পরামর্শ, মস্তিষ্কের রক্ত পরিবহন ঠিকমতো না হলে বা মস্তিষ্কের রক্তনালি ঠিকমতো কাজ না করলে, কতটুকু লবণ খাচ্ছেন সেই বিষয়ে সচেতন হোন। এটি হতে পারে ডিমেনসিয়া (স্মৃতিভ্রম) প্রতিরোধের প্রথম ধাপ।