সুস্থ থেকে হজ পালন
‘কাবার পথে সবার আগে’ স্লোগান নিয়ে ১৬ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ বিমানের হজ যাত্রা ফ্লাইট। এবার ৪৫ হাজার বাংলাদেশি যাচ্ছেন পবিত্র হজ পালন করতে। আমাদের দেশের সাথে সৌদি আরবের আবহাওয়ার বেশ পার্থক্যের কারণে হাজিরা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন। সেখানে ডায়রিয়া, হিটস্ট্রোক ও ইনফ্লুয়েঞ্জার সমস্যা দেখা দেয় বেশি। এবার এর সাথে যুক্ত হয়েছে মার্স করোনা ভাইরাস। তবে সচেতন থাকলে এসব সমস্যার থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা সম্ভব।
হজ একটি কঠোর পরিশ্রমের কাজ। সাঈ করা, আরাফাত থেকে মিনা ময়দানে যাওয়া,তাওয়াফ করাসহ বেশির ভাগ কাজই করতে হয় হেঁটে। তাই আগে থেকে হাঁটার অভ্যাস না থাকলে যে কেউই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। হজে যাওয়ার আগে প্রতিদিন একটু একটু করে হাঁটার অভ্যাস করে তুলুন এবং প্রতিদিন হাঁটার সময় বাড়িয়ে দিন। পায়ে যেন কোনোভাবে ক্ষত সৃষ্টি না হয়, সেজন্য সচেতন থাকতে হয়। এ জন্য পায়ে লোশন ব্যবহার করতে পারেন।
এবার দেখা দিয়েছে মার্স করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। এটি বেশ মারাত্মক। আক্রান্তের প্রায় অর্ধেকই কিডনি বিকল ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাই সাবধান হতে হবে। যারা বেশি বয়স্ক, শিশু, গর্ভবতী, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সারে আক্রান্ত বা এমন ওষুধ খাচ্ছেন যেটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। তবে আশার কথা হলো, এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না, আবার আক্রান্ত হতে হলে অনেক সংখ্যক ভাইরাসের প্রয়োজন পড়ে। এটি প্রতিরোধে মেনে চলুন স্বাস্থ্যবিধি। প্রতিদিন কয়েকবার হাত ধুতে হবে। নোংরা হাত নাক-মুখ-চোখে লাগাবেন না। অন্যের ব্যবহৃত তোয়ালে, গামছা বা অন্যান্য ব্যবহার্য ব্যবহার থেকে বিরত হোন। বাইরে বেরোলে মাস্ক ব্যবহার করতে ভুলবেন না। কেউ আক্রান্ত হলে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
হজে এক রুমে বেশ কয়েকজন থাকতে হয়। এ ছাড়া আরাফাত ময়দান ও মিনায় খোলা আকাশে রাত্রি যাপন করতে হয়। এখানে বাথরুমের ব্যবস্থা অপ্রতুল। অনেক সময় তা অস্বাস্থ্যকর। তাই এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। রাস্তার খোলা খাবার খাবেন না। এগুলো থেকে হতে পারে ডায়রিয়া। মক্কা ও মদিনায় ওজু করার স্থানে ওজু করার পাত্রে করে জমজমের পানি অনেকই পান করেন। পানের জন্য একবার ব্যবহার করা যায়, এমন পাত্র ব্যবহার করুন।
অনেকক্ষণ ধরে বিমানে বসে থাকার ফলে পায়ে পানি জমে যেতে পারে বা পা ফুলে যেতে পারে। এ সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য বিমানে ভ্রমণের সময় পায়ে চাপ দেয় রাবারের তৈরি এমন কিছু পরতে পারেন। ঢিলেঢালা জামা পরুন ও বিমানে প্রচুর পানি পান করুন। প্রতি ঘণ্টায় বিমানে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ান এবং হাত-পা নড়াচড়া করুন। পায়ের উপর পা তুলে বসবেন না।
গরমের মধ্যে আপনার ত্বকে বিভিন্ন ধরনের র্যাশ হতে পারে। এর প্রতিরোধে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগাতে পারেন। রোদে পোড়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে সানস্ত্রিন ব্যবহার করুন। রোদে গেলে সানগ্লাস ব্যবহার করুন। পাওয়ার যুক্ত চশমা পরলে তা অটোসান করে নিন। বাইরে বেরোলে মাথা স্কার্ফ জাতীয় লম্বা কাপড় দিয়ে ঢেকে নিন। সুতি ঢিলেঢালা কাপড় পরুন। ওখানে রাতে শীত পড়ে বেশ, তাই শীতের কাপড় নিতে ভুলবেন না।
হজের সময় সরচেয়ে যে সমস্যা বেশি দেখা দেয় তা হলো শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন। এ ক্ষেত্রে জ্বর, কাশি,গলায় খুশখুশ, গলায় ক্ষত, নাক দিয়ে পানি ঝরা, শরীর ব্যথা, শ্বাসকষ্ট। এ সমস্যা সমাধানে প্রচুর পানি পান করুন। জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, লবণ দিয়ে গরম পানি গড়গড়া ও গরম পানি পান করুন। হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখুন। বাইরে থেকে এসেই হাত-মুখ ধুয়ে ফেলুন।
ডায়াবেটিস রোগীরা হজে যাওয়ার আগে আপনার চিকিৎকসকের পরামর্শ নিন। আপনি ওষুধ বা ইনসুলিন নিলে তার ডোজ পরিবর্তন করতে হবে কি না জেনে নিন। হজে থাকার সময়ও নিয়ম করে ওষুধ সেবন করুন বা ইনসুলিন নিন। সব সময় মধু বা মিষ্টি জাতীয় খাবার সাথে রাখুন। যদি আপনার অতিরিক্ত দুর্বলতা, অতিরিক্ত ঘাম, প্যালপিটিশন বা অতিরিক্ত হৃদস্পন্দন হয় তাহলে দ্রুত মিষ্টি জাতীয় খাবার খান।
হজের সময় হাজিরা হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। হিটস্ট্রোকের উপসর্গ দেখা দেওয়া মাত্রই আক্রান্ত ব্যক্তিকে রোদ থেকে সরিয়ে ঠান্ডা জায়গায় নিতে হবে। শরীরের কাপড় যতটুকু সম্ভব খুলে ফেলে শরীরে ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে, তবে বরফ শীতল পানি ঢালা যাবে না। রোগীকে বাতাস করতে হবে। কুচকি ও বোগলের নিচে আইস প্যাক রাখলে তাপমাত্রা দ্রুত কমে আসবে। হিটস্ট্রোক থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটানা শারীরিক পরিশ্রম করবেন না, লম্বা সময়ের জন্য হাঁটবেন না। হজের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মাঝে সময় পেলেই ঠান্ডা জায়গায় বসে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করুন। রোদে বেরুলে অবশ্যই ছাতা নেবেন। সবসময় বেশি বেশি করে পানি, শরবত, স্যালাইন ও ফলের জুস পান করতে হবে। ভিড়ের মধ্যে যাবেন না। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের সময় তাড়াহুড়া করবেন না। হিটস্ট্রোকের উপসর্গ দেখা দিলে ভিড় থেকে সরে যান।
সঙ্গে রাখুন কাশির ওষুধ, খাবার স্যালাইন, দরকারি অ্যান্টিবায়োটিক, এন্টিবায়োটিক ওয়েন্টমেন্ট, কাটাছেড়ার জন্য পভিডন আয়োডিন, স্যাভলন, ব্যান্ডেজ, তুলা, প্যারাসিটামল ও কিছু ব্যথানাশক ওষুধ। যেমন : ডাইক্লোফেনাক, কিটোরোলাক, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ওমিপ্রাজল। আপনি যেসব ওষুধ নিয়মিত সেবন করেন, সেগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশ থেকে নিয়ে যান। সাথে আপনার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র রাখুন। কোনো সমস্যা হলে হজ এজেন্ট ও সৌদি মেডিকেল সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করুন।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ