বাংলাদেশে মুখ ও দাঁতের চিকিৎসার অবস্থা কী?

আজ বিশ্ব ওরাল হেলথ ডে। বর্তমানে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে মুখ ও দাঁতের অনেক আধুনিক চিকিৎসা বের হয়েছে এবং অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ বিষয়ে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে মুখ ও দাঁতের চিকিৎসার অবস্থা কী, এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালের ডেন্টাল রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. পি সি মল্লিক ও রাজ ডেন্টাল ওয়ার্ল্ড ও রাজ ডেন্টাল সেন্টারের প্রধান পরামর্শক ডা. আশাফুজ্জোহা রাজ।
অনুষ্ঠানটি এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ৩৩৮২তম পর্বে প্রকাশিত হয়েছে।
এনটিভি : ওরাল হেলথ বলতে কী বোঝায়? আজকের দিনে এর প্রতিপাদ্য কী?
ডা. পি সি মল্লিক : প্রতিটি বিষয়ের ওপর একটি বিশেষ দিন রয়েছে। তেমনি এফডিআই ২০০৭ সালে ওরাল হেলথ নিয়ে মানুষের ভেতর সচেতনতা তৈরির জন্য এই নির্দিষ্ট দিনটি ধার্য করে। এটি যথারীতি চালু হয়ে যায়। ডব্লিউএইচও একে স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে আমরাও বাংলাদেশে ডেন্টাল সার্জনরা চেষ্টা করে যাচ্ছি দিবসটি পালন করার। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওরাল হেলথ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপিত হয়ে থাকে।
কারণ আমরা সকলেই বলি, ‘মাউথ ইজ দ্য গেট অব হেলথ’। মুখের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে, তাহলে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। এই কথা সামনে এনেই এই দিনটি উদযাপিত হয়। হওয়া দরকার ও হচ্ছে।
২০১৯ সালের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সে আহ্ অ্যান্ড টেক কেয়ার অব ইউর ওরাল হেলথ’। এর মানে হলো, আপনি হেসে, তৃপ্তি নিয়ে যদি ‘আহ্’ শব্দটি করতে পারেন, সকলের সামনে, তাহলে বোঝা যাবে আপনার মুখের স্বাস্থ্য ভালো রয়েছে।
এনটিভি : মুখের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য কী করণীয় রয়েছে?
ডা. আশাফুজ্জোহা রাজ : ডেন্টাল মানে কিন্তু এখনো মানুষ ভাবে শুধু দাঁত। কিন্তু সেটি নয়। এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। ডেন্টাল শব্দের প্রকৃত অর্থ দাঁত সম্পর্কীয়। এ ছাড়া আমাদের জিহ্বা, আমাদের মাড়ি, ঠোঁট, স্নায়ু সংযোগ, আমাদের লালা গ্রন্থি মিলে কিন্তু ডেন্টাল শব্দটি বোঝায়। সুতরাং পুরোটাকে সুস্থ রাখতে হবে। তো, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমরা মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, দাঁত দেখাচ্ছি, এর পেছনে কিন্তু মূল বিষয় হলো দাঁত সুস্থ রাখতে হবে। এই সুস্থটা রাখার জন্য একদম মূল পর্যায়ে যেন সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়, এ জন্য আজকের এই দিবস পালন করা।
আমাদের দেশে ৯৯ ভাগ লোক কোনো না কোনো মুখের সমস্যায় ভোগে। হয় দাঁত ক্ষয় বা মাড়ির সমস্যা। এই সচেতনতা যদি তৈরি হয়, তাহলে দেখা যায়, রোগের সিংহভাগই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এনটিভি : ওরাল হেলথ ডে-টা আপনারা কীভাবে পালন করে থাকেন?
ডা. পি সি মল্লিক : আজকাল মানুষ অনেক সচেতন হয়ে গেছে। ডেন্টাল ডক্টর মানে দাঁতের চিকিৎসক তা নয়, তারপরও এটি আরো ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন, আমি মনে করি। একজন মানুষ বুঝবে ওরাল ক্যাভেটি সম্পর্কিত সব বিষয়ই তার চিকিৎসার আওতায়।
আমাদের যেমন এখন ম্যাক্সোলোফেসিয়াল সার্জন রয়েছে, অর্থপেডিক্সরা রয়েছে, কনজারভেটিভ দিক রয়েছে। ম্যাক্সোলোফেসিয়াল যে ইউনিট আমাদের, তারা তো এখন মাথা ও ঘাড়সহ সবকিছুতে জড়িয়ে গেছে।
আপনি ধারণা করতে পারবেন না, আমাদের সারা দেশে মুখগহ্বরের ক্যানসার, সড়ক দুর্ঘটনার রোগী বাড়ছে। আমাদের মুখগহ্বরের জটিল রোগগুলো হয়ই অসচেতনতার জন্য। যেমন, একটি প্রধান বিষয় হলো মুখগহ্ববরের ক্যানসার। যেসব লোক ভাঙা দাঁত নিয়ে অবস্থান করছেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন না বা ধারালো দাঁত নিয়ে রয়েছেন, তখন খাওয়া-দাওয়া করতে, কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে, জিহ্বা দিন দিন কেটে যাচ্ছে। কয়েকদিন একটু জ্বালা-যন্ত্রণা বোধ করবে। কয়েক দিন একটু ব্যথাও হয়তো করবে। চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন না, অবহেলা করছেন, করে দেখা গেল, জিহ্বায় দেখা গেল, নিয়মিত সমস্যা হয়ে ওখানে একটি আলসার হয়ে যাচ্ছে, তামাকজাতীয় দ্রব্য বারবার দেওয়ার কারণে তার অনুভূতি কাজ করছে না।
ডা. আশাফুজ্জোহা রাজ : দেখা যায়, প্রথম পর্যায়ে, তারা একটু ওষুধের দোকানে যায়। ওষুধ কিনে খাচ্ছে, ব্যথা একটু কমে থাকা, আরাম পাওয়ার জন্য। আরেকটু বেশি হলে দেখা যায় চিকিৎসক নির্বাচনে একটি বড় সমস্যায় ভুগছে। তখন দেখা যায়, তারা অনুমোদনহীন একজন চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে। অপচিকিৎসার শিকার হয়ে এমন জটিলতা তৈরি করছে যে বলার বাইরে। এ জন্য আমরা বারবার বলি, শুরুতে যদি কোনো ডেন্টাল সার্জনের পরামর্শ নেয়, তাহলে কিন্তু বড় ধরনের জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
ডা. পি সি মল্লিক : এ ধরনের রোগীরা যখন আমাদের কাছে আসে, তখন আসলে আমরা ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু তারা ভয় পায় না। রোগের ব্যাপ্তি সম্পর্কে জানে না, মানতেও চায় না। যখন রোগ নির্ণয় হয়, তখন তো বড় চিকিৎসায় যেতে হয়, তখন তার করণীয় কিছু নেই। আমরা চাই, মুখগহ্বরের যেকোনো সমস্যা, জিহ্বার ঘা বলেন, মুখগহ্বরের যেকোনো অংশে ঘা বলেন, টিউমার বলেন, সিস্ট বলেন, যেকোনো ম্যালিগনেন্সি বা ক্যানসার বলেন এগুলোর ক্ষেত্রে ডেন্টাল সার্জনের কাছে চিকিৎসার জন্য যেতে হবে।
এনটিভি : ডেন্টালের ভেতরে অনেক ধরনের বিশেষ বিশেষ বিষয় চলে এসেছে। এখন প্রতিটা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এসেছেন। আমরা ওই আলাদা আলাদা বিভাগ সম্পর্কে একটু জানতে চাই?
ডা. আশাফুজ্জোহা রাজ : আমাদের ডেন্টালে এখন নির্দিষ্টভাবে পাঁচটি বিভাগ আলাদা হয়ে গেছে। প্রথমে বলি এক ধরনের চিকিৎসক রয়েছে, যাদের আমরা এনডোডোনটিক্স বলি। এরা দাঁত সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে কাজ করে। যেমন : দাঁতের গর্ত হলে একে ফিলিং করতে হবে। গর্ত হয়ে রোগীরা যখন দেরি করে আসেন, সেখানে মজ্জায় সংক্রমণ চলে যায়, একে রুট ক্যানেল করতে হবে। এই যে বিষয়গুলো এগুলো এনডোডোনটিক্সরা করে, দাঁত সংরক্ষণের জন্য।
এরপর আসে ওরাল সার্জন। ওরাল ক্যানসার, সড়ক দুর্ঘটনা যেখানে সার্জারির প্রয়োজন হয়, সেখানে আমাদের সার্জনরা খুব সফলভাবে ওই কাজটি করে। আরেকটি বিভাগ রয়েছে, প্রোসথোডোনটিক্স বলি আমরা। যেমন : যদি কোনো দাঁত ফেলে দিতে হয়, সেখানে যদি নতুন দাঁত প্রতিস্থাপন করতে হয়, এটি নিয়ে এরা কাজ করে। যেমন : ব্রিজ বলি আমরা অথবা ইমপ্ল্যান্ট বলি। এটি আমাদের দেশে আধুনিক হচ্ছে। যেখানে দাঁত নেই, সেখানে এক ধরনের ধাতব বস্তু বসিয়ে আমরা লাগিয়ে দিতে পারি। এটা কিন্তু করছেন প্রোসথোডোনটিক্সরা। পরে আসছে পেডিয়োডোনটিক্স। এ রকম চিকিৎসক বাংলাদেশে তৈরি হয়ে গেছে, তারা শুধু ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করবে।
পাশাপাশি ফাঁকা দাঁত, উঁচু-নিচু দাঁত, এই দাঁতগুলোর যারা চিকিৎসা করে তাদের বলা হয় অর্থোডোন্টিক্স। বাংলাদেশে কিন্তু এখন সফল উন্নতমানের চিকিৎসা হচ্ছে।
এনটিভি : এখন যদি কেউ বলেন, এত জায়গায় যাওয়া কি সম্ভব? নাকি প্রাথমিক অবস্থায় ওরাল সার্জনদের কাছে গেলে চলবে?
ডা. পি সি মল্লিক : ধরুন, দাঁতের ক্ষয়ের চিকিৎসা দেওয়া, এই ক্ষেত্রে তো সকল ডেন্টাল সার্জনকেই অভিজ্ঞ বলা চলবে। কিন্তু কোনো বিশেষ দাঁতকে সুরক্ষা দেওয়া, দাঁতের গঠন ঠিক করা এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়। সে অনুযায়ী সে অন্য কারো কাছে পাঠাবে। মেক্সোলোফেসিয়াল সার্জনরা অনেক ধরনের কাজ করছেন।
ডা. আশাফুজ্জোহা রাজ : আমরা মুখের মধ্যে যদি রোগগুলো পুষে রাখি, যেটি মাড়ির রোগ, দাঁতের রোগ, এই রোগ কিন্তু সহজে আমাদের রক্ত বাহিকায় ছড়িয়ে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দাঁতের মাড়ির রোগ থেকে, আমাদের হার্ট বলি, লিভার বলি, মস্তিষ্ক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা কিন্তু তৈরি হচ্ছে মুখ থেকে।
ডায়াবেটিস এখন খুব প্রচলিত রোগ। গবেষণায় এটাও দেখা গেছে, যাদের দীর্ঘ মেয়াদে মাড়ির রোগ রয়েছে, এসব রোগী যদি ইনসুলিন নেয়, তাহলে এসব রোগ তাদের ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অপরিণত শিশু জন্মের জন্য ১৭ থেকে ২০ ভাগ দায়ী হলো গর্ভাবস্থায় মায়েদের মাড়ির রোগ।