বিশ্ব হার্ট ডে : হার্ট ভালো রাখবেন কীভাবে?

বিশ্ব হার্ট দিবস আজ। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটি ভালো রাখতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা জরুরি। হার্ট কীভাবে ভালো রাখা যায়, এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক।
বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্ডিওলজি বিভাগের হার্ট ফেইলিউর ডিভিশনের প্রধান হিসেবে কর্মরত। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ৩৫৬০তম পর্বে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : হার্ট দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য কী?
উত্তর : আমরা প্রতিবছর এ দিনটি প্রতিপালন করি। প্রতিবছরই আমাদের একটি থিম থাকে। এবার বলা হয়েছে, বি এ হার্ট হিরো। মানে, তুমি নিজেই তোমার হার্টের সেনানায়ক হও। অর্থাৎ যদি আমার হার্টকে ভালো রাখতে হয়, চেষ্টাটা আমারই মূলত করতে হবে।
কোনো ওষুধ বা অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসে আমার হার্টকে রক্ষা করতে পারবে না। এই চিন্তা থেকে এটি এসেছে। আমরা বলছি, মেক এ প্রমিজ। একটি শপথ গ্রহণ করুন। কী শপথ গ্রহণ করতে হবে? হার্টকে ভালো রাখতে হবে। হার্টকে ভালো রাখার জন্য আমরা কতগুলো ধাপের কথা বলে থাকি। এরপর সামাজিক একটি সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে। বলা হয়েছে, তোমার হার্ট, আমার হার্ট। আমার হার্টের প্রতি যত্ন নেওয়া আমার দায়িত্ব। এই যে আমরা কথা বলছি, এটাও ছড়িয়ে দেওয়া, এটাও বিশ্ব হার্ট দিবসের একটি বিরাট প্রতিপাদ্য।
একটা সময় ছিল পৃথিবীতে দুর্ঘটনা এক নম্বরে ছিল। এখন আবার ঘুরেফিরে হৃদরোগ প্রধান হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন কারণে এ হৃদরোগের পরিমাণ বাড়ছে।
প্রশ্ন : তরুণদের মধ্যেও হার্ট অ্যাটাকের বিষয়টি দেখছি। এটি কেন?
উত্তর : আমরা যখন ছাত্রজীবনে এমবিবিএস পড়তাম, তখন নর-নারী বিভেদ বলা হতো। নারীরা যাঁরা বাচ্চা দান করতে সক্ষম, সেই বয়সে তাঁদের হৃদরোগ হয় কম। মেনোপজ হয়ে যাওয়ার পর তখন ভাববে হৃদরোগ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এ ধারণা এখন পাল্টাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে নর-নারী সমান।
এর পর কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছে, বয়স কোনো বিষয় নয়। ১৮ বছর বয়সেও হৃদরোগ হতে পারে। আট বছরেও তোমার হৃদরোগ হতে পারে। আট বছরের বাচ্চারও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। চার বছরের বাচ্চারও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। বুকের ব্যথা যদি থাকে, হার্ট অ্যাটাক নিয়ে ভাবতে হবে। আরো ভয়ংকর বিষয় হলো, আমরা বলি প্রচ্ছন্ন হৃদরোগ। গোপনে গোপনে হয়তো হার্ট অ্যাটাক হয়ে আছে, কেউ টের পায়নি। যেমন : ডায়াবেটিস রোগী যাঁরা, তিনি হয়তো এটি নিয়ন্ত্রণই করছেন, উনার যে হৃদরোগ হয়ে রয়েছে তিনি জানতেন না।
অথবা দেখা গেল, তিনি ক্যানসারের চিকিৎসা পাচ্ছেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে আছেন, জানেন না। এর কারণগুলো আমরা বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়াব। যার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তার অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টিতে দুটো জিনিস ভাবতে হবে। একটি হলো, আমরা স্থির করে দিই, ওপরের প্রেশারটা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকতে হবে এবং নিচের প্রেশারটা আরেকটি মাত্রায় থাকতে হবে। যথোপযুক্ত ওষুধটা যথোপযুক্ত মানুষকে দেওয়া হচ্ছে কি না, তার অন্য রোগ রয়েছে কি না, সেটির উপকার করবে কি না, সব ভেবে ওষুধ দিতে হবে। আর রোগীর দায়িত্ব হলো ফলোআপে ঠিকমতো যাওয়া। উনি ভেবেছিলেন, উনি ভালো আছেন। এতে এটুকু জিনিস মনে রাখতে হবে।
প্রশ্ন : কত দিন পর পর ফলোআপ জরুরি?
উত্তর : আমরা বলি, স্বাভাবিক একজন মানুষেরও ফলোআপ দরকার। যদি আমি ধরে নিই উনার ডায়াবেটিস নেই, তাহলে উনি বছরে দুবার ফলোআপ করবেন, ছয় মাস পর পর। আর যদি ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে করতে হবে তিন মাস পর পর। তাহলে অনেক রোগ থেকে মানুষ মুক্তি পায়।
আরেকটি বিষয় হলো, এখন হৃদরোগ কেন বেশি হয়। অনেক কারণ এখানে বলা রয়েছে। আমি যদি বংশগতি বিদ্যা বাদ দিই, যাদের হওয়ার কথা তাদের হতেই পারে। বিভিন্ন কারণে।
সেই পরিবেশটা দুভাবে হতে পারে। একটি হতে পারে স্ট্রেস থেকে। স্ট্রেসটুকু সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়। দ্বিতীয় হলো, খাদ্যাভ্যাস। খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কথায় কথায় লবণকে দোষ দিতাম। লবণ এখনো দায়ী। এটা খাওয়া কমাতে হবে। প্রক্রিয়াজাত করলেও লবণ একই রকম থাকে।
এখন কিন্তু লবণ সম্পর্কে আরেকটি তথ্য রয়েছে। লবণ শুধু হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট ফেইলিউর এটিই করে না—সে ভয়ানক ক্যানসার রোগেরও অন্যতম প্রধান কারণ। আজকের বার্তা হলো, লবণ শুধু হৃদরোগই তৈরি করে না, ক্যানসারও করে।
প্রশ্ন : লবণ কতটুকু খাওয়া উচিত?
উত্তর : কোনোক্রমেই চা চামচের এক চামচের বেশি নয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনার জন্য নিরাপদ হলো অর্ধেক চা চামচ, পৌনে এক চা চামচ, বড়জোর এক চা চামচ। কিছু কিছু এলাকায় প্রচুর লবণ খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে।
এর পর দ্বিতীয়ত আমরা আসি শর্করা, কার্বোহাইড্রেট। কার্বোহাইড্রেট নিয়ে পৃথিবীতে আবার অন্য রকম একটি কথা শুরু হয়েছে। শর্করাজাতীয় খাবার আমাদের সেটুকুই দরকার, যা তার দরকার কাজের জন্য। আমরা বলি, শক্তি তৈরির জন্য। তাহলে একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য এক হাজার ২০০ কিলোক্যালরি থেকে বড়জোর দুই হাজার কিলোক্যালরি প্রয়োজন। এর জন্য দুই কাপ ভাত খেলেই হলো। কিন্তু আমরা খেতে বসলে মোটামুটিভাবে কনুই চুবিয়ে খাই।
খাবারের ক্ষেত্রে আমরা সবাইকে বলি, দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা অনুচিত। আমরা বলি যে, আপনার সারা দিন যতটুকু কিলোক্যালরি খেতে হবে, একে মনে মনে ভাগ করে নিন। দিনের পাঁচটি ভাগে ভাগ করুন। অফিসে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের আমরা বলতে পারি, দুই ঘণ্টা পর পর কিছু একটা খান। আমাদের শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয়। যখন গ্লুকোজ বা শর্করাজাতীয় খাবার খাই, তখন এক বা দুই ইউনিট করে গ্লুকোজ তৈরি হয়। আমরা চাই, সেই ইনসুলিনটা সব সময় তৈরি হতে থাকুক। এতে আমি হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলাম না।
প্রথমত, চা-কফি যা-ই খান, এর মধ্যে চিনি বাদ দিয়ে দিন। এরপর মিষ্টিজাতীয় জিনিস বর্জন করুন। এরপর ভাত খাওয়া কমিয়ে দিন। একবারে কমানো সম্ভব নয়। অনেকের ভাতের নেশা হয়ে থাকে। এ জন্য আমরা বলি যে আপনি একটি কাজ করুন, শুধু একবেলা ভাত খান। দুইবেলা রুটি। এর পর বলি এখন যা খাচ্ছেন, আস্তে আস্তে বা ১৫ দিন পরে অর্ধেকে নামিয়ে আনুন।
আমি বলি, দুই বাটি সবজি খেলে পেট একেবারে ভর্তি হয়ে যায়। তাহলে এক বাটি শাকসবজি যদি খেতে পারেন, তাহলে খুবই উপকার হলো। কয়েকভাবে উপকার পেলেন। পেট ভরা থাকল, ভাতের প্রয়োজনীয়তাও কমে এলো। আপনার কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমে আসবে। এরপর মলদ্বারে ক্যানসারের আশঙ্কাও কমে আসবে। এটা আমাদের বাড়তি লাভ।
আরেকটি বিষয় হলো, শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে। পটাশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যদি খাই, তাহলে উচ্চ রক্তচাপ কমে আসে। তাহলে আমরা পাঁচটি বিষয় থেকে বাঁচতে পারি। এরপর দুই নম্বর বলি হাঁটা। হাঁটার বিষয়ে কথা রয়েছে। কতক্ষণ হাঁটতে হবে?
হাঁটার জন্য ভালো সময় হলো বিকেলবেলা। সকালবেলায় রক্তকণিকায় কিছু অনুচক্রিকা থাকে, তারা সমস্যা করে। আর স্ট্রেস হরমোন সকালে বেশি বের হয়। তখন বুক ধড়ফড় করে। আমরা দেখি সকালে হাঁটতে গিয়ে অনেকে পড়ে যায়। কারণ, সকালবেলা স্ট্রেস হরমোন বেশি থাকে। তাই হাঁটার জন্য ভালো সময় বিকেলবেলা। সেখানেও নিয়ম রয়েছে। ভরপেটে হাঁটা যাবে না। এক কাপ চা খেলেন, দুটো বিস্কুট খেলেন। পেট খালি। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটুন।
গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁট থেকে ছয় কিলোমিটার ঘণ্টায় এমন গতিতে যদি হাঁটে, সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। কারণ, হাঁটলে এলডিএল কোলেস্টেরল কমে আসে। আর এইচডিএল কোলেস্টেরল যেটি উপকারী, সেটি বেড়ে যায়।
প্রশ্ন : হার্ট অ্যাটাক হলে কোথায় যাবে?
উত্তর : হার্ট অ্যাটাক হলে ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। এসপিরিন জাতীয় ওষুধ বাজারে থাকে, অনেক সচেতন লোক ঘরের মধ্যে রেখে দেন।
প্রথম কাজ হবে, চারটি ৭৫ মিলিগ্রামের এসপিরিন ট্যাবলেট একত্রে খাইয়ে দিন। এর ক্লোপিডোজরেল আরেকটি ভালো ওষুধ, চারটি খাইয়ে দিন। এরপর ধারের কাছের হাসপাতালে নিয়ে যান। দেখা গেছে, ৩০ ভাগ রোগী ওই চারটি ট্যাবলেটে অনেক ধাক্কা সামলে ফেলে।
যিনি উপজেলায় থাকেন, তিনি তো আর হুট করে ঢাকায় আসতে পারবেন না। তাঁরা উপজেলা হাসপাতালে যাবেন। সেখানে গেলেও অনেকটা সামলে যাবে।
পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। কার্বোহাইড্রেট কোলেস্টেরল তৈরি করে। এই ট্রাইগ্লিসারাইড শুধু শর্করা থেকে তৈরি হয়। এ ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি রয়েছে বলে এ এলাকার লোকদের সমস্যা হচ্ছে। এটা গবেষণায় বলা হয়। আমরা ভেতো বাঙালি। আমাদের ভাত খাওয়া কমাতে হবে। হাঁটতে হবে।
প্রতিরোধের কথা আমরা বললাম। প্রতিরোধ দুই ধরনের। প্রাথমিক প্রতিরোধ; আরেকটি হলো সেকেন্ডারি প্রতিরোধ। হৃদরোগ হয়ে গেছে, আর যেন অ্যাটাক না হয়।
প্রশ্ন : এখন নতুন কিছু খাবার এসেছে, যেগুলো হৃদরোগীদের জন্য ভালো। সেগুলো কী?
উত্তর : আমরা এত দিন শুনে এসেছি শুধু অলিভ অয়েল খেতে হবে। এটি তার জায়গাতেই রয়েছে। কোনো আপত্তি নেই। ক্যানোলা অয়েলের কথা চালু হয়েছে। এটি হতে পারে। আমাদের দেশে ক্যানোলা হয় না। তবে মাস্টার্ড অয়েল হয়। সরিষার তেল আবার জায়গায় চলে এসেছে।
আগে আমাদের একটি ধারণা ছিল, নারকেল তেলের কোনো উপকার নেই, খালি ক্ষতি করে। নারকেল তেল সপ্তাহে একবার বা দুবার খাওয়া গেলে উপকার হবে। কী উপকার? এটি মস্তিষ্কের খুব উপকার করে। নার্ভের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই ধারণা আমাদের ছিল না। এটা নতুন এসেছে।
প্রশ্ন : যাদের এর মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে কী পরামর্শ?
উত্তর : প্রথম কথা হলো, ওষুধ খেলেই হৃদরোগী ভালো থাকে। তাহলে ওষুধ খাওয়াটা ছাড়া যাবে না। কাউকে হয়তো দুটো ওষুধ খেতে দিই। কারো যদি রিং বসানো হয়, তখন অনেক ওষুধ খেতে দিই। ওষুধ না খেলে কিন্তু আরেকটি ব্লক হয়ে যাবে। তারা যদি সঠিক চিকিৎসা পান, একদম হার্ট আগের মতো কাজ করতে শুরু করে। আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো ওষুধ এখন বের হয়েছে।
তবে এর সঙ্গে কিছু রোগ রয়েছে, সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ যদি থাকে, তাহলে সঠিক ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যদি ডায়াবেটিস থাকে, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এরপর একটি জীবনযাত্রায় চলে আসতে হবে; শৃঙ্খলিত জীবনযাত্রা। আরেকটি বিষয় হলো, ৩০ বা ৪০ মিনিট যদি দিনে একটু ঘুমান, তাহলে শরীরে একটি চনমনে ভাব আসে।