শিশুদের শ্বাসকষ্টের লক্ষণ কী?
শীতের এই সময়ে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রচলিত হলো শ্বাসকষ্ট। তবে কিছু বিষয় মেনে চললে শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ করা সম্ভব। আজ ২৬ নভেম্বর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২১৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু বিভাগের পরামর্শক ডা. কবীর হোসেন।
প্রশ্ন : এ সময়ে শিশুদের ক্ষেত্রে কোন কোন রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়?
উত্তর : এ সময়ে শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগের পরিমাণ বেশি বেড়ে যায়। এর মধ্যে কয়েকটি রোগ রয়েছে, যাকে আমরা বলি ব্রঙ্কিউলাইটিস বা হুইজ। এর পর রয়েছে নিউমোনিয়া। আর অ্যাজমার কারণে শ্বাসকষ্ট।
প্রশ্ন : এই রোগগুলো বেড়ে যাওয়ার পেছনে কি কোনো কারণ রয়েছে?
উত্তর : হ্যাঁ, কারণ রয়েছে। এর মধ্যে যারা আগে থেকে অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টে ভুগছে, তাদের এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর অনেকে রয়েছে, অজ্ঞতার জন্য কিছু কিছু রোগে ভুগতে থাকে। তার ভেতরে ঠান্ডা পানি খাওয়া, ঠান্ডার ভেতর বাইরে বের হওয়া, ফ্যান ছেড়ে রাতে ঘুমানো ইত্যাদি। এসব কারণে বাচ্চারা শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য রোগে ভুগে থাকে।
প্রশ্ন : কী কী ধরনের লক্ষণ দেখলে বাবা-মা বুঝতে পারবে শিশুটি আসলে শ্বাসকষ্টে ভুগছে?
উত্তর : শ্বাসকষ্টজনিত রোগে প্রথমে বাবা-মা দেখবে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চা ঘন ঘন কাশি দিচ্ছে। নাক দিয়ে পানি পড়ছে। এসব লক্ষণ প্রচলিত ঠান্ডার সময় হয়। আর যেসব বাচ্চা আগে থেকে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভোগে, তাদের এ সময়ে অ্যাজমার পরিমাণ বেড়ে যাবে। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাবে। বুকের খাঁচার নিচের অংশটা ওঠানামা করবে এবং শ্বাস নেওয়ার চেয়ে তাদের ছাড়তে কষ্ট হবে।
প্রশ্ন : সাধারণত কোন বয়সের শিশুরা এ ধরনের সমস্যায় বেশি ভুগে থাকে?
উত্তর : ছয় মাস থেকে দুই বছরের বাচ্চারা একটু বেশি ভুগে থাকে, যেহেতু তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
প্রশ্ন : যেসব শিশু শ্বাসকষ্টের বাইরে রয়েছে তাদের সাধারণ ঠান্ডায় আর কী কী লক্ষণ প্রকাশ পাবে?
উত্তর : প্রাথমিকভাবে শ্বাসকষ্ট এবং কাশির রোগীদের আমরা সাধারণ ঠান্ডা হিসেবে চিকিৎসা করে থাকি। বাবা-মাকে পরামর্শ দিই, এই অসুখ থেকে কীভাবে দূরে থাকা যায়। প্রাথমিকভাবে আমরা যাকে বলি প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক। এর জন্য বাবা-মাকে প্রাথমিকভাবে খুব সাবধানে বাচ্চার যত্ন নিতে হবে, যেমন—বাচ্চাকে সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে না নিয়ে যাওয়া, বাচ্চাকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলা বেড়াতে না যাওয়া। আর যেসব বাচ্চার এ রকম প্রবণতা আছে, শীত এলে কাশি হয়, শ্বাসকষ্ট হয়, তাদের ঠান্ডা থেকে দূরে রাখতে হবে। এর মধ্যে খালি পায়ে বাচ্চাকে মেঝেতে হাঁটতে মানা করা। ঠান্ডা পানিতে গোসল না করা এবং ঠান্ডা পানি পান না করা। যাতে করে এ জাতীয় সমস্যা না হয়।
প্রশ্ন : আপনাদের কাছে একজন অভিভাবক যখন এই জাতীয় সমস্যা নিয়ে যায়, আপনারা তখন কীভাবে নিশ্চিত হোন আসলে বাচ্চাটি কোন সমস্যায় ভুগছে এবং চিকিৎসা কীভাবে শুরু করেন?
উত্তর : প্রাথমিকভাবে আমরা তার রোগের ইতিহাস আগে শুনি। আগে কোনো রোগ ছিল কি না বা এটা তার নতুন সৃষ্ট কি না। রোগের ইতিহাস আগে আমরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে জেনে নিই। জানার পর আমরা তাকে পরীক্ষা করি। তার ফুসফুস পরীক্ষা করি। রোগীর ইতিহাস নেই, তার জ্বর আছে কি না বা অন্য কোনো রোগ আছে কি না। কারণ, ভাইরাসের মাধ্যমেও জ্বর হয়, ব্যাকটেরিয়াতেও জ্বর হয়। এটি ভাইরাল নাকি ব্যাকটেরিয়া, সেটি একদিন-দুদিনের কাশিতে বোঝার কোনো উপায় নেই। তাকে আমরা শ্বাসকষ্ট বা কাশি এগুলো দিয়েই চিহ্নিত করি।
প্রশ্ন : এরপর ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত কি না বা ভাইরাসজনিত কি না, সেটি বোঝেন কীভাবে?
উত্তর : সেটা বোঝা যাবে তার যদি অতিরিক্ত মাত্রায় জ্বর থাকে, জ্বরটা যদি চার-পাঁচ দিন থাকে। তাহলে আমরা সতর্কভাবে অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্য কিছু চিন্তা করব, তবে পরে। সাধারণত প্রাথমিকভাবে দুই বা তিন দিনের জ্বরে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করব না।
প্রশ্ন : তখন আপনাদের চিকিৎসা কী থাকে?
উত্তর : প্রাথমিকভাবে চিকিৎসায় তার শ্বাসকষ্টের যে রাস্তা আছে, মুখগহ্বর, নাকের ছিদ্র—এ দুটো শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রধান জায়গা। আমরা প্রাথমিকভাবে এই দুটো জায়গাকে পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি। তার জন্য নাক পরিষ্কারের যে ড্রপ রয়েছে, এটি দিয়ে নাক পরিষ্কার রাখার জন্য বাবা-মাকে বলব এবং কুসুম গরম পানি খেয়ে গলাকে পরিষ্কার করার কথা বলব, যাতে করে বাচ্চার শ্বাস নিতে সুবিধা হয়। যে দুটো প্রধান রাস্তা, সেটি খোলার জন্য নিশ্চিত করতে হবে। নাক পরিষ্কারের জন্য ড্রপ দিতে হবে। আর গলা সুদিং (প্রশমিত) করতে গরম পানি, লেবু চা, গরম দুধ খাওয়াতে হবে।
প্রশ্ন : আসলে লেবু চা তো এই জন্য খুব উপকারী তাই না?
উত্তর : অবশ্যই দরকার এবং এগুলো বইতেও লেখা আছে।
প্রশ্ন : শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার সঙ্গে একটি শিশুর পারিবারিক কোনো সম্পর্ক আছে কি? পরিবার থেকেই শ্বাসকষ্ট আসে কি না?
উত্তর : যখন বাচ্চার রোগের ইতিহাস নিই, তার ভেতর পারিবারিক ইতিহাস নেওয়া হয়। অনেকের পারিবারিক ইতিহাসে অ্যাজমা থাকলে তখন শিশুদের অ্যাজমার প্রকোপ শরীরে অনেক সময় থেকে থাকে। সেটাকে বলা হয় পারিবারিক কারণ। এটি থেকে অনেক বাচ্চা শ্বাসকষ্টে ভুগে থাকে।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে তো করার কিছু নেই। তখন হয়ে গেলে কী করবে?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। শ্বাসকষ্ট হলে তাকে আমরা নেবুলাইজেশন দেব। আর অন্যান্য সমস্যা হলে তার জন্য ওষুধ দেব। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল দেব।
প্রশ্ন : সবার মধ্যে একটি ধারণা থাকে, শ্বাসকষ্টের সমস্যা সারা জীবন একটি মানুষের মধ্যে থেকে যায়। একটি শিশু যখন শ্বাসকষ্ট নিয়ে জন্ম হয়, সেটি বাড়তেই থাকে, কমবে না। আসলে এটি কতখানি সঠিক?
উত্তর : আসলে আপনি ঠিক বলেছেন। এ রকম বিষয় নিয়ে অনেক অভিভাবকই উদ্বিগ্ন থাকেন। এ জন্য চিকিৎসার অংশ হিসেবে রোগীকে বোঝানো যায়, যাকে আমরা বলি কাউন্সেলিং। চিকিৎসকদের প্রয়োজন যেসব বাচ্চা এসব পারিবারিকভাবে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছে, তাদের বাবা-মাকে আগে কাউন্সেলিং করা। আসলে শ্বাসকষ্ট স্থায়ী রোগ নয়। ফুসফুস খুব স্পর্শকাতর জায়গা, যেকোনো অ্যালার্জেন উপাদানও যদি ফুসফুসে যায়, এটি আর নিতে পারে না। হাঁচি বা কাশি দিয়ে আমরা একে বের করার চেষ্টা করি। শ্বাসকষ্টও তাই। আপনি জানেন যে শ্বাসকষ্টের মধ্যে অনেক ভাগ আছে। ঋতুগত বলি, অ্যালার্জেন বলি ইত্যাদি অনেক কারণে হয়। আর জন্মগত কারণ তার মধ্যে একটি। এসব থেকে দূরে থাকা গেলে শ্বাসকষ্টকে প্রতিরোধ করতে পারি। এটি থেকে ভালো থাকতে পারি। প্রতিরোধটা জরুরি। তবে যখন ওষুধের প্রয়োজন, তখন এটি দিয়েই আমরা প্রতিরোধ করি।
প্রশ্ন : ইনহেলারের ভূমিকা কতটুকু এখানে?
উত্তর : শ্বাসকষ্ট রোধে ইনহেলারের ভূমিকা অনেক। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে অনেকেই চান না ইনহেলার ব্যবহার করতে। একবার বোধ হয় ইনহেলার নিলে সারা জীবনই নিতে হবে। শিশুদের ওপর শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় একটি গাইডলাইন আছে। আমরা পর্যায়ক্রমে অ্যাজমা ব্যবস্থাপনা করব এবং যখন যেটি প্রয়োজন, সেটি করব।