শীতে ত্বকের সমস্যা বাড়ে কেন?
শীতে ত্বকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়। এ জন্য এ সময় ত্বকের বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়। আজ ২৮ নভেম্বর, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২১৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. কবীর চৌধুরী।
প্রশ্ন : শীত চলে এসেছে। এ সময়ে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা আমরা প্রায়ই খেয়াল করি। এর কারণ কী?
উত্তর : মানুষের শরীরে ত্বক হলো একটি বৃহত্তম অঙ্গ। এবং পরিবেশের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ত্বকের। আবহাওয়ার পরিবর্তন, জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশের পরিবর্তনের সঙ্গে এই ত্বক খুব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এখন শীতকালে যেটা হয়, এ সময় আমাদের দেশের আবহাওয়াটা শুষ্ক থাকে। আর্দ্রতা কম থাকে, পানির পরিমাণ কম থাকে। তাতে দেখা যাচ্ছে, যেসব রোগ শুষ্ক ত্বকের জন্য হয়, সেগুলো বেড়ে যায়।
সবচেয়ে প্রথমে আসে শিশুদের রোগ। শিশুদের অ্যাটোপিক অ্যালার্জি নামে একটি রোগ হয়, যেটা শিশুকালেই শুরু হয়। ছয় মাস বয়সেই শুরু হয়। ত্বক যখন শুষ্ক থাকে, চুলকানো বেড়ে যায়। এর প্রকোপ অনেক বেড়ে যায়।
প্রশ্ন : কেবল কি চুলকানো থাকে, নাকি আরো কোনো উপসর্গ হয়?
উত্তর : চুলকানি হয়, হাঁচি থাকে, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কারণ, এই অ্যাটোপিক অ্যালার্জির সঙ্গে শ্বাসকষ্টের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ঠান্ডা বেশি হলে অ্যাটোপিক অ্যালার্জি বা ডার্মাটাইটিসটা অ্যাজমা আকারে ধারণ করতে পারে। এখানে যদি আমি চিন্তা করি, তাই শীত আসার আগেই সাবধান হতে হবে। এই বাচ্চাকে ইমোলিয়েন্ট ব্যবহার করতে হবে। যেমন : ইমোলিয়েন্ট বলতে সাধারণভাবে অলিভ অয়েল খুব ভালো একটি ইমোলিয়েন্ট, অর্থাৎ ত্বককে শুষ্কতা থেকে আলাদা করে রাখতে হবে। আজকাল অনেক ক্রিম বেরিয়েছে, যেটা লাগানোর কারণে ত্বকের মধ্যে শুষ্কতা কম হয়। জলীয়বাষ্প পানিকে ধরে রাখে। ব্যাকটেরিয়া যাতে না ঢুকতে পারে, সে প্রতিরোধ করে ক্রিম। এভাবে প্রতিরোধ করা যায়। ত্বককে আর্দ্র রাখতে হবে ময়েশ্চারাইজার দিয়ে।
প্রশ্ন : ত্বক শুষ্ক হয় কেন? সেটির সঙ্গে কি বংশগত কোনো বিষয় জড়িয়ে আছে?
উত্তর : ত্বককে আর্দ্র রাখার জন্য এর যে দুটো স্তর রয়েছে, বহিস্তর ও অন্তস্তর—এই স্তরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে যাদের জলীয়বাষ্প বেরিয়ে যায়, শুষ্ক হয়। এটি অনেকটি বংশগত। মা বা বাবার ত্বক শিশুটি পাবে। যদি শুষ্ক হয় তাদের ত্বক, তবে শিশুটি শুষ্ক পাবে, মিশ্র হলে সেটি পাবে, তৈলাক্ত হলে সেটি পাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এতে কমবেশি তারতম্য হয়। এর সঙ্গে বংশের অনেক সম্পর্ক আছে। তাই সেই শিশুটির মা-বাবার উচিত হবে শুরু থেকেই সতর্ক থাকা। তাই শীত আসার আগেই, ত্বক শুষ্ক হওয়ার আগেই তাকে আর্দ্র করে রাখতে হবে, ময়েশ্চারাইজার দিতে হবে।urgentPhoto
প্রশ্ন : আর কী কী সমস্যা হতে পারে ত্বকে এ সময়?
উত্তর : ইকতায়োসিস নামে একটি রোগ আছে। যেখানে ত্বকটি মাছের আঁশের মতো হয়ে যায়; শুষ্ক হয়ে যায়। মনে হয়, মাছের যে আঁশ থাকে, সে রকম হচ্ছে। শীতকাল এলেই এটি বেড়ে যায়। সুতরাং যাদের ইকতায়োসিস থাকে, তাদের আমরা বলি শীত আসার আগেই বিভিন্ন ধরনের ক্রিম ব্যবহার করবেন। ওদের জন্য সবচেয়ে ভালো হয় পেট্রোলিয়াম জেলি বা ভ্যাসলিন ব্যবহার করলে। ভ্যাসলিন, অলিভ অয়েল ও গ্লিসারিন যদি লাগান, তবে এদের অবস্থা অনেক ভালো থাকে। এদের অথবা সোরিয়াসিস রোগী যারা আছে, তাদের পা ফেটে যায় শীতকাল এলে। স্কেলের মতো হয়ে যায়। একে ক্র্যাকসোল বলা হয়। এ থেকে অনেক সময় রক্তক্ষরণ হতে পারে। ব্যথা হতে পারে। এ জন্য শীত আসার আগেই পায়ের যত্ন নিতে হবে। অর্থাৎ গরম পানিতে পা চুবিয়ে ভিজিয়ে মোছার পর আর্দ্র অবস্থায় সেখানে সাদা ভ্যাসলিন অথবা সেলিসেলিক এসিড লাগাবেন। অথবা গ্লিসারিন, ভ্যাসলিন লাগাবেন। তাতে এই ত্বকটা ভবিষ্যতে ফেটে যাওয়া থেকে অনেক ভালো থাকবে। তবে শুরু করতে হবে রোগ হওয়ার আগেই। কারণ, বৃষ্টি আসার আগেই ছাতা ধরতে হবে, নয়তো ভিজে যাবে।
প্রশ্ন : আমরা বাজারে এক ধরনের অয়েল জেল দেখতে পাই। সেটি কি আসলে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে?
উত্তর : অয়েল জেল মানে হলো যে তেলটিতে সবচেয়ে বেশি পানি থাকে। তেলের মধ্যে বেশির ভাগ তেল ও পানি থাকে। পানি দিয়ে জেল করা হয়। এর সুবিধা হলো দুটো যে জেলটি থাকে এটি পানি, এটি ওপরের ভাগকে আর্দ্র রাখবে। আর তেলটি করবে কি, ভেতর থেকে পানি যাতে বের না হয়, তাতে সাহায্য করবে। এটা ভালো জিনিস।
প্রশ্ন : সোরিয়াসিস এ সময়ে বেড়ে যায়। যদি আগে থেকে সতর্কতা অবলম্বন না করে সে ক্ষেত্রে?
উত্তর : অ্যাটোপিক যেমন বলছিলাম, এই বাচ্চাটির শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সারা গায়ে চামড়া উঠতে পারে, বাচ্চারা খিটখিট করবে। শরীর ভালো লাগবে না, জ্বর আসতে পারে। সংক্রমণ হতে পারে। প্রদাহ হতে পারে। এটি শিশুর ব্যাপার। অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিসের ক্ষেত্রে। বড়দেরও সমস্যাটি হয়, তবে কম। যেমন ইকতায়োসিস, এত বেশি চামড়া উঠবে যে হাত সে মুঠো করতে পারছে না, শুষ্ক হওয়ার কারণে। এবং হাতের যে দাগ, সেগুলো ফেটে যাচ্ছে।
সোরিয়াসিস রোগীর স্কেল ওঠে। যদি দেখা যায়, একে সে ঠিকমতো আর্দ্র না রাখে, তাহলে স্কেল বা চামড়া উঠে রক্তক্ষরণ হতে পারে। গিট ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। যদি শীতকাল আসার আগেই ঠিকমতো যত্ন না করা হয়, তখন এক্সফোলিয়েট ডার্মাটাইটিস হতে পারে।
প্রশ্ন : আপনাদের কাছে যখন এ জাতীয় সমস্যা নিয়ে রোগীরা যায়, তখন আপনারা কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : যদি এই রোগী আগে কোনো চিকিৎসকের কাছে না যায়, চিকিৎসা না নেয়, তখন আমরা চেষ্টা করি রোগ নির্ণয় করার জন্য, তখন পরীক্ষা করি। যেমন অ্যাটোপিক নির্ণয়ের জন্য আমরা আইজিই লেভেল পরীক্ষা করি, একটা রক্তের পরীক্ষা। আর সোরিয়াসিস, ইকতায়োসিসের ক্ষেত্রে আমরা বায়োপসি করে রোগ নির্ণয় করি। আর শারীরিক অন্যান্য পরীক্ষা করা হয়। যেমন এই রোগের সঙ্গে ভেতরের রোগের সম্পর্ক থাকতে পারে। সেগুলো আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। তার পর যে ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন হয়, সেটি দিই। যদি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার প্রয়োজন হয়, সেটি দিই। চুলকানির জন্য অ্যান্টিহিসটামিন দেওয়া হয়। সোরিয়াসিস প্রকট আকারে হলে সেই ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। যেন এই রোগ দমন করে রাখা যায় বা নিরাময় করা হয়।
প্রশ্ন : অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস শিশুদের কত বছর ধরে সমস্যা করে থাকে?
উত্তর : দুটো বিষয়। অ্যাটোপিককে বলা হয় ব্লেসিং ও ডিজগাইজ। ডিজগাইজ হলো এটি অনেক কষ্ট দেয়, শ্বাসকষ্ট হয়, জ্বর আসে। বাচ্চা খিটখিট করে। ত্বক দেখে মা-বাবার অনেক মন খারাপ লাগে। কান্নাকাটি করেন। এটি হলো ডিজগাইজ। তবে খুশির খবর হলো, এটি একটি বয়সের পর চলে যায়। বলা হয়, তিন, ছয়, নয়, বারো—এই বয়সের মধ্যে চলে যায়। তবে চলে যাওয়ার জন্য নিয়মিত চিকিৎসা করতে হবে। চিকিৎসা না করলে জটিলতা দেখা দেয়। আর্দ্র রাখতে হবে শরীরকে।
প্রশ্ন : শুরুটা কীভাবে হতে পারে শরীরে?
উত্তর : শিশুদের যখন একেবারের ছোটবেলায় হয়, তখন গাল লাল হয়। বাচ্চা দেখা যাচ্ছে নিজে নিজে চুলকাচ্ছে। গায়ে হাত দিচ্ছে, চোখে হাত দিচ্ছে, গালে হাত দিচ্ছে ও খামচি দিচ্ছে। তখন বুঝতে হবে, অ্যাটোপিক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গালটা লাল হবে, এটা প্রথম লক্ষণ। পরবর্তীকালে আরেকটু পরে হাতের ভাঁজ, হাঁটুর পেছনে এটি বেশি দেখা যায়। চুলকানো বেশি হয় এবং শুষ্ক হয়ে যায়।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন যে ১২ বছর পর্যন্ত বেশির ভাগ থাকে। এর পরবর্তীকালে আসলে কি থাকার কোনো আশঙ্কা রয়েছে?
উত্তর : প্রাপ্তবয়স্ক হলে খুব কমই থাকে। ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে হয়তো প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় থাকতে পারে। তবে এর শঙ্কা খুব কম। তবে এই বাচ্চাগুলোর বুদ্ধি প্রকোট থাকে, প্রতিভাবান থাকে। এদের স্মরণশক্তি ভালো হয়, বুঝে ভালো। অনেক পৃথিবীতে নেতা আছেন, যারা ছোটবেলায় অ্যাটোপিক ছিলেন। এদের মেধা অনেক বেশি হয়। তবে মেধার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক, গবেষণায় এটা জানা যায়নি। এমনকি আমিও দেখেছি, এরা অনেক মেধাবী হয়। তবে এদের রাগ বেশি থাকে, জেদ বেশি থাকে। সব মিলিয়ে ক্ষতির চেয়ে ভালোটা বেশি থাকে। তবে রোগটি নিয়ে সাবধান থাকলে রোগী অনেক ভালো থাকে। আর কেউ যদি মনে করেন এটি তো থাকবেই, আমার চিকিৎসা করার প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন : শীতে ত্বকের যত্নে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
উত্তর : প্রথমত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। শীতকালে ধুলাবালি বেশি থাকে। আবহাওয়ার মধ্যে অনেক ধুলাবালি থাকে। শুষ্ক আবহাওয়া থাকে। সে জন্য হাত-মুখ ঠান্ডা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ধোবেন, মুছবেন। চুল অবিন্যস্ত রাখবেন না। চুলে ধুলাবালি লাগতে পারে। স্কাল্পে অনেক যত্নের দরকার আছে। স্কাল্পের যত্ন না নিয়ে চুলের যত্ন হবে না। হাত-মুখ ধুতে কম ক্ষারজাতীয় সাবান ব্যবহার করতে হবে। আর অনেকে মেকআপ ব্যবহার করে। শীতকালে যদি ঘুমিয়ে পড়ে মেকআপ নিয়ে, এতে পরে অ্যালার্জি হতে পারে। সে জন্য ভালো করে মুখে অলিভ অয়েল লাগাবেন। হালকা সাবান দিয়ে পরিষ্কার করবেন। কিছু না লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। আর হাতে-পায়ে ময়েশ্চারাইজার লাগাবেন।
এ ছাড়া পায়ের তালুর যত্ন করতে হবে। পেডিকিউর, মেনিকিউর করতে হবে। যত্ন নিতে হবে।