গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপে কী করবেন?

গর্ভাব্স্থায় অনেকেরই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা হয়। নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে না থাকলে অবস্থা জটিল হয়ে যেতে পারে। ২৬ ডিসেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৪৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগের অধ্যাপক ডা. নাহরিন আক্তার।
urgentPhoto
প্রশ্ন : হাইপার টেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ— এই সমস্যাটিতে বিপুল মানুষ আক্রান্ত। মায়েদের বেলায় উচ্চ রক্তচাপ গর্ভাবস্থার আগেও থাকতে পারে, আবার গর্ভাবতী হওয়ার পর সেই সমস্যা বাড়তে পারে বা নতুন করেও হতে পারে। গর্ভাবস্থায় নতুন করে হাইপার টেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ হয় কেন?
উত্তর : গর্ভাবস্থায় যে রক্তচাপ হয় একে আমরা বলি প্রি একলামসিয়া। যারা প্রথম মা হয় তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় এটি বেশি হচ্ছে। যাদের পারিবারিক ইতিহাস থাকে, মা-বাবার উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তাদেরও হচ্ছে। যারা মোটা থাকে, তাদের হচ্ছে। তবে আবার অনেক ক্ষেত্রেই এর কারণ পাওয়া যায় না। বলা হয়, প্রি একলামসিয়ার কারণ হলো ফুলে। ফুল ঠিকমতো গঠন না হলে প্রি একলামসিয়া হতে পারে।
প্রশ্ন : যাঁরা নিয়মিত চেকআপে আসবেন তাঁরা বুঝবেন এ সমস্যা তাদের হচ্ছে। তবে যারা নিয়মিত চেকআপ করছেন না তাদের বোঝার উপায় কী?
উত্তর : তারা হয়তো হঠাৎ করে দেখবে শরীর ফুলে গেছে, চোখে ঝাপসা দেখছে। অনেক সময় দেখা যায়, রোগীরা খিঁচুনি নিয়ে চলে আসে। এসব জটিলতা নিয়ে রোগীরা আসে। যারা চেকআপে থাকে না তারা অনেক সময় প্রেশারের জটিলতা নিয়ে আসে। অনেক সময় দেখা যায়, কিডনিতে প্রভাব ফেলে। প্রস্রাব কমে যাচ্ছে, অলিগুরিয়া বলে। সেই জটিলতা নিয়ে আসে। অনেক সময় দেখা যায় রক্তপাত নিয়ে আসে। অতিরিক্ত প্রেশারের কারণে ফুল থেকে রক্তপাত হয়। যারা চেকআপে থাকে না তারা এ রকম বিভিন্ন রকম সমস্যা নিয়ে আসে।
প্রশ্ন : চেকআপ করার পর আপনারা যখন দেখেন গর্ভবতী মায়ের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তখন আপনারা কী করেন?
উত্তর : গর্ভাব্স্থায় উচ্চ রক্তচাপ বলছি, সিস্টোলিক ১৪০ বা তার উপরে গেলে, আর ডায়েস্টোলিক ৯০ বা তার উপরে গেলে। ধরেন এখন প্রেশার পেলাম ১৪০/ ৯০, সেই ক্ষেত্রে ওদের কিছু উপদেশ দেই। তখনই ওষুধ দেই যখন ১৫০/১০০ হয়। তার আগ পর্যন্ত তাদের বলি, চর্বি জাতীয় খাবার কম খাবেন। ঘুম যেন ঠিকমতো হয়, উদ্বেগ যেন কম করে। আর নিয়মিত যেন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে থাকে। যেন বেশি হলে আমরা আগেই ওষুধ দিতে পারি।
প্রশ্ন : এই উচ্চ রক্তচাপের খাদ্যতালিকায় টেবিল সল্ট কোনো ভূমিকা রাখে কি?
উত্তর : আগে বলত বাড়তি টেবিল সল্ট না খেতে। তবে এখন বলে বাড়তি টেবিল সল্ট খেতে পারে।
প্রশ্ন : গর্ভবতী মায়েরা ওষুধ খেতে অনেক ভয়ে থাকেন যে ওষুধ গর্ভজাত সন্তানের ক্ষতি করবে কি না। এই ওষুধ আসলেই ক্ষতি করতে পারে কি?
উত্তর : হ্যাঁ, করতে পারে। তবে আমরা যেসব ওষুধ গর্ভাবস্থায় দেই, সেগুলো কোনো বাচ্চার সমস্যা করে না। আমরা এমন হাইপারটেনসিভ ওষুধ দেই যেগুলো বাচ্চার কোনো সমস্যা করে না। হয়তো উচ্চ রক্তচাপের কারণে সমস্যা হবে, তবে ওষুধের কারণে সমস্যা হবে না।
প্রশ্ন : যাঁরা আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন এবং মা হতে চান— তাদের কী আগে থেকেই কিছু করণীয় রয়েছে?
উত্তর : হ্যাঁ, করণীয় রয়েছে। গর্ভাবস্থার আগেই যাদের প্রেশার হয়, তাদের বলি ক্রনিক হাইপারটেনশন। এই মা যখন গর্ভধারণের জন্য পরিকল্পনা করবেন, তখন চিকিৎসক দেখবেন তার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কি না। দেখেন তিনি কী ওষুধ খাচ্ছিলেন। যে ওষুধ খেলে বাচ্চার সমস্যা হবে সেই ওষুধ আমরা ব্ন্ধ করে দেই। কিছু কিছু অ্যান্টিহাইপারটেনশিভ ওষুধ থাকে যেগুলো বাচ্চার সমস্যা করতে পারে। তখন যদি সেই রকম ওষুধ খেয়ে থাকে সেগুলো আমরা বন্ধ করে দেই। বন্ধ করার পর গর্ভাবস্থায় যেসব ওষুধ নিরাপদ সেই ওষুধ দেওয়া শুরু করি। এরপর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখি।
পাশাপাশি দেখি এই রক্তচাপের কারণে কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়িয়ে পড়ছে কি না। অর্থাৎ তার কিডনি ফাংশন ঠিক আছে কি না, লিভার ঠিক আছে কি না- এগুলো সব ঠিক থাকলে আমরা বলি আপনি গর্ভধারণ করতে পারেন। গর্ভধারণের পর তাকে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্ন : গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে সাধারণত সন্তান প্রসবের পর এটি ভালো হয়ে যায়। গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপের বেলায় বিষয়টি কী হয়?
উত্তর : গর্ভাবস্থায় যেই রক্তচাপ হয় একে আমরা বলি, প্রি একলামসিয়া। প্রধানত ফুলের কারণে প্রি একলামসিয়া হয়, এটা আমরা বলি। সাধারণত দেখা যায় ডেলিভারি হওয়ার পর উচ্চরক্তচাপ স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে। তবে ৫ থেকে ১০ ভাগ ক্ষেত্রে সেটি থেকে যায়। সেই ক্ষেত্রে আমরা বলি নিশ্চয়ই এই রক্তচাপ আগে থেকে ছিল তাই রয়ে গেছে। এর মানে সে ক্রনিক হাইপার টেনশনের রোগী বা দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিল। সাধারণত প্রসবের পর প্রি একলামসিয়া স্বাভাবিক হয়ে যায়।
প্রশ্ন : প্রি একলামসিয়া কী? এটি কখন একলামসিয়ায় রূপান্তরিত হয়?
উত্তর : প্রি একলামসিয়া হলো গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপ। আর সাথে যদি ইউরিন যায়। এটাকে আমরা প্রি একলামসিয়া বলি। হয়তো তার উচ্চ রক্তচাপ আছে তবে ইউরিনে প্রোটিন যাচ্ছে না, তবে অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গের সমস্যা রয়েছে। হয়তো কিডনির সিরাম ক্রিয়েটিনিন বেড়ে গেল বা প্লাটিলেট কমে গেল, চোখে সে কম দেখছে বা ঝাপসা দেখছে বা মাথা ব্যথা থাকছে এই সমস্যা থাকলেও আমরা একে প্রি একলামসিয়া বলি। আর যখন প্রি একলামসিয়ার সাথে খিঁচুনি হয়, তখন একে একলামসিয়া বলি। আর স্বাভাবিক গর্ভাবস্থায়ও যদি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তার হাতে পায়ে পানি আসতে পারে, ইডিমা হতে পারে। সেজন্য ইডিমাকে এর সাথে ধরি না।
প্রশ্ন : একজন গর্ভবতী মায়ের যখন খিঁচুনি শুরু হলো তখন আপনারা কী করেন?
উত্তর : যখন ফুলের কারণে এটা হচ্ছে তখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো প্রসব। একলামসিয়া হওয়ার পর রোগী ভর্তি হলে প্রথমে খিঁচুনির প্রকোপটা কমাই। রোগী যখন ঠিকঠাক হয়। পরবর্তী পদক্ষেপ হলো প্রসব। যতক্ষণ প্রসব না করানো হচ্ছে খিঁচুনি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। আর খিঁচুনি মানে মস্তিস্কে ক্ষতি।
প্রশ্ন : গর্ভবতী মায়েদের বেলায় উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন কীভাবে করা দরকার?
উত্তর : জীবনযাপনের পরিবর্তনের মধ্যে চর্বি জাতীয় খাবার কম খাবে। আধা ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়াম করতে পারে। নিয়মিত খাবার খাবে এবং বিশ্রাম নেবে। দুপুরে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেবে। রাতে আট ঘণ্টা বিশ্রাম নেবে। এই জিনিসগুলো সে মেনে চলবে। এরপরও এটি যদি না হয়, চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখবে।