উচ্চ রক্তচাপের জন্য কারা ঝুঁকিপ্রবণ?

উচ্চ রক্তচাপ খুব প্রচলিত একটি রোগ। উচ্চ রক্তচাপ যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে শরীরে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। আজ ৮ জানুয়ারি, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৬০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. এ কে এম শফিকুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগে কর্মরত আছেন।
urgentPhoto
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপার টেনশন অত্যন্ত প্রচলিত একটি বিষয়। তার পরও একটু বলেন, উচ্চ রক্তচাপ বিষয়টি কী? একজন মানুষকে কখন আপনারা উচ্চ রক্তচাপের রোগী বলেন?
উত্তর : এটা বোঝার জন্য প্রথমেই বুঝতে হবে রক্তের চাপ কী? তরল পদার্থকে যখন কোনো পাত্রে রাখা হয়, তখন সেটি সেই পদার্থের আকার ধারণ করে। এটি তরল পদার্থের গায়ে একটি পার্শ্বচাপ প্রয়োগ করে। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত একটি তরল পদার্থ। এটি যখন রক্তনালির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন রক্তনালির গায়ে পার্শ্বচাপ প্রয়োগ করে। সেটিই হচ্ছে রক্তচাপ। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ রক্তের চাপ থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিষয়টি আমরা সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। যেমন—সিটি করপোরেশনের একটি সুনির্দিষ্ট পাম্প থেকে, একটি নির্দিষ্ট সেন্টার থেকে একটি নির্দিষ্ট চাপে পানি সরবরাহ করা হয়। যাতে করে শহরের প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি বাসায় একটি নির্দিষ্ট চাপে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়। তেমনিভাবে সিটি করপোরেশনের পাম্পের সঙ্গে যদি আমরা আমাদের হৃৎপিণ্ডকে তুলনা করি, হৃৎপিণ্ডের সংকোচন প্রসারণের মধ্য দিয়ে আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে রক্ত একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছে যায়। এতে আমাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভালোভাবে কাজ করতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক রক্তের চাপ আমরা ধরে থাকি ১২০ মিলিমিটার মার্কারি বা ১২০ মিলিমিটার পারদ। এবং ডায়াস্টোলিক চাপ আমরা ধরে থাকি ৮০ মিলিমিটার মার্কারি বা পারদ।
তবে উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কিত যে আন্তর্জাতিক সংগঠন জয়েন্ট ন্যাশনাল কমিটি অব আমেরিকা, তাদের মতে, এটিকে আমরা আরো বেশি পর্যন্ত স্বাভাবিক ধরতে পারি। যেমন : ১২০ থেকে ১২৯ পর্যন্ত সিস্টোলিক চাপ যাদের থাকে, তাদের আমরা বলি স্বাভাবিক। আর ১২০ থেকে ১৮০ মিলিমিটার মার্কারি যাদের, তাদের বলি শ্রেষ্ঠ রক্তচাপ। ১২০ থেকে ১২৯ মিলিমিটার মার্কারি এবং ডায়াস্টোলিক ৮০ থেকে ৮৪ মিলিমিটার মার্কারিকে বলা হয় স্বাভাবিক। আর উচ্চ স্বাভাবিক বলে থাকি, যখন সিস্টোলিক রক্তচাপ ১৩০ থেকে ১৯০ মিলিমিটার মার্কারি হয় এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ৮৫ থেকে ৮৯ মিলিমিটার মার্কারি হয়। যখন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রক্তের চাপ ১৪০ মিলিমিটার মার্কারির বেশি সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক ৯০ মিলিমিটার মার্কারির বেশি থাকে, যদি বারবার বেশি থাকে, আমরা বলি কমপক্ষে দুই সপ্তাহের মধ্যে পরপর তিনবার মাপার পর যদি ১৪০ এবং ৯০ মিলিমিটার মার্কারির বেশি থাকে, তাহলে সে উচ্চ রক্তচাপের রোগী। তখন আমরা সেভাবে চিকিৎসা শুরুর প্রস্তাব করে থাকি।
প্রশ্ন : রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? কারা বেশি ঝুঁকিপ্রবণ?
উত্তর : ঝুঁকিপ্রবণ আসলে সবাই। এটি যে কারো ক্ষেত্রে হতে পারে। আমরা রক্তের চাপকে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করে থাকি। যেমন : আমরা বলি, এসেনশিয়াল বা প্রাইমারি হাইপারটেনশন। যেখানে আসলে কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কিছু কারণকে দায়ী করা হয়ে থাকে, যেমন : অতিরিক্ত মানসিক চাপ। যাঁদের শারীরিক কর্মদক্ষমতা কম, যাঁরা ধূমপান করেন, যাঁরা মদ্যপান করেন অথবা যাঁদের অতিরিক্ত শারীরিক ওজন থাকে—তাঁরা প্রাইমারি হাইপারটেনশনের জন্য ঝুঁকিপ্রবণ।
তা ছাড়া আরেকটি জিনিস রয়েছে, সেকেন্ডারি হাইপারটেনশনের। যেখানে আসলে প্রকৃত অর্থে আমরা কারণ খুঁজে পাই। সেখানে কিডনির কিছু রোগ, হরমোনাল কিছু রোগ, কিছু ওষুধ সেবনের কারণে বা অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার কারণে এ সমস্যা হয়ে থাকে।
প্রশ্ন : একজন মানুষের যদি অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তাহলে কী ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর : উচ্চ রক্তচাপ থেকে শরীরের যে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ রয়েছে, যেই অঙ্গগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমরা মূলত বেঁচে থাকি, তার প্রতিটির ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন : মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয়ে পক্ষাঘাত বরণ করতে হতে পারে। হঠাৎ করে রেটিনাতে রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধত্ব বরণ করতে হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের আকৃতি বড় হয়ে যেতে পারে। হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। কিডনি ফেইলিউর হতে পারে। এমনকি আমাদের যে ছোট রক্তনালি রয়েছে, সেগুলোও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
প্রশ্ন : উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে কী কী করতে হবে?
উত্তর : নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রথমে তাঁর জীবনাচরণের পরিবর্তন করতে হবে। তাঁর জীবনকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। যেমন : আমরা রোগীকে বলি, আপনি প্রতিদিন হাঁটুন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট করে হাঁটবেন। এমনভাবে হাঁটবেন যেন শরীর থেকে ঘাম হয়। অতি দ্রুতগতিতে হাঁটবেন না। কারণ, খুব দ্রুতগতিতে হাঁটলে রক্তের চাপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার খুব ধীরগতিতেও হাঁটবেন না। তাহলে এই হাঁটা কাজে আসবে না। হাঁটার সময় শুরুর দিকে ধীরে ধীরে হাঁটবেন। এরপর একটু একটু করে গতি বাড়াবেন। এবং সবশেষে যখন শেষ করবেন, তখন দ্রুতগতি থেকে আবার গতি কমিয়ে আনবেন।
দ্বিতীয় হলো, খাবারে অতিরিক্ত লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একটি খাবার তৈরি করতে গেলে স্বাভাবিক অবস্থায় যতটুকু লবণ লাগে, এটুকু খেতে পারবেন। বাড়তি লবণ নেওয়া যাবে না। কাঁচা লবণ, ভাজা লবণ যা-ই হোক না কেন, লবণ লবণই। বাড়তি লবণ দেওয়া যাবে না। তাঁকে চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। ধূমপান এড়িয়ে যেতে হবে।
মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হবে। মানসিক চাপ কমাতে হবে। সর্বোপরি তিনি যদি উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, তাহলে তাঁকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। পাশাপাশি তাঁকে নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে। নিয়মিত রক্তের চাপ রেকর্ড করে ওষুধের ডোজ বাড়াতে বা কমাতে হবে।
প্রশ্ন : কিছুদিন ওষুধ খাওয়ার পর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে রোগী যদি মনে করেন ওষুধ বন্ধ করে দেবেন, সেটি কি করা উচিত হবে?
উত্তর : আমাদের মধ্যে খুব ভ্রান্ত একটি ধারণা রয়েছে যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ একবার শুরু করলে সারা জীবন আর ছাড়া যাবে না। এই কথা পুরোপুরি ভুল। কারণ, আমি যদি জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন করি, আমি যদি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে চলে আসি, রক্তের চাপ একসময় স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে। তখন আমরা ওষুধের ডোজ কমাতে কমাতে একসময় বন্ধ করতে পারি। তবে সেটি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে হতে হবে। নিজে নিজে কখনো বন্ধ করে দিতে পারবে না।
উচ্চ রক্তচাপকে আমরা একটি পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করি। আপনি যখন পাগলা ঘোড়াকে লাগাম দিয়ে রাখবেন, সেটি আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যখন লাগাম ছেড়ে দেবেন, তখন পাগলা ঘোড়ার মতো ক্ষ্যাপাটে আচরণ করবে। তাই উচ্চ রক্তচাপের বেলায় ওষুধ হচ্ছে পাগলা ঘোড়ার লাগাম। ছেড়ে দিলে সেটি অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে পাগলা ঘোড়াও মাঝেমধ্যে স্বাভাবিক আচরণ শুরু করে, যখন সে পাগলা অবস্থা থেকে ভালো অবস্থায় চলে যায়। সে জন্য ওষুধ বন্ধ করা যাবে, তবে সেটা অবশ্যই কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী। এবং তাঁকে নিশ্চিত হতে হবে, ওষুধ বন্ধ করে দিলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তাঁকে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে সব সময় থাকতে হবে। তাঁকে ফলোআপে থাকতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ আবার চলে এলো কি না দেখতে হবে।
প্রশ্ন : একজন মানুষ, হয়তো উচ্চ রক্তচাপের রোগী, ওষুধও খাচ্ছেন নিয়মিত, তবে হঠাৎ করে তাঁর একদিন রক্তচাপ বেড়ে গেল। ওই অবস্থায় তিনি কী করবেন?
উত্তর : আসলে অনেক সময় আমাদের রক্তের চাপ সুনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকার পরও বেড়ে যেতে পারে। যাঁদের রক্তের চাপ এ রকম নিয়মিত তরঙ্গায়িত হয়, তাঁদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বাসায় দু-একটি ওষুধ রেখে দিতে হবে। তাঁকে রক্তের চাপ মাপা খুব ভালোভাবে শিখিয়ে দিতে হবে। যদি দেখা যায় পরিমাপ করতে পারেন, তখনই চিকিৎসক তাঁর ওপরে বিশ্বাস রাখবেন। যদি ওই সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া সম্ভব হয়, ওষুধ খাবেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কিছু করবেন না।