মুটিয়ে গেলে শরীরে কী সমস্যা হয়?
মুটিয়ে যাওয়া বিশ্বব্যাপী একটি বড় সমস্যা। কী কারণে মানুষ মুটিয়ে যাচ্ছে এবং এ থেকে শরীরের কী কী ক্ষতি হয়- এ বিষয়ে আজ ১৪ জানুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৬৬তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক কানিজ মাওলা। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : ওবেসিটি বা মুটিয়ে যাওয়া বলতে আমরা কী বুঝি? কখন একজন মানুষকে স্থূল বলা যাবে?
উত্তর : আসলে প্রতিটি মানুষেরই একটি স্বাভাবিক ওজন থাকে। বডি মাস ইনডেক্স বলে একটি শব্দ আছে, এর মাধ্যমে আমরা স্বাভাবিক ওজন কী হবে সেটি নির্ধারণ করি। তার আগে আমাকে একটু বলতে হবে বডি মাস ইনডেক্স কী? এটা পরিমাপ করা হয় একজন মানুষের উচ্চতা এবং তার ওজনের মাধ্যমে। ওজন কিলোগ্রামে, উচ্চতা মিটার স্কয়ার দিয়ে যদি ভাগ করা হয়, যে ফলটি আসে সেটি হলো বিএমআই। সাধারণত ১৯.৫ থেকে ২৪.৫ পর্যন্ত থাকে বিএমআই; এটা হচ্ছে স্বাভাবিক। তবে এশিয়ানদের জন্য আরেকটু কম। এশিয়ানদের যদি ২৩-এর ওপর চলে যায় তখন আমরা বলি একটু স্থূল হওয়ার দিকে চলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : আসলে এটি কখন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়?
উত্তর : ২৫ পার হয়ে গেলে বলি বাড়তি ওজন (ওভার ওয়েট), ২৫ থেকে ৩০ পার হয়ে গেলে বলি ওজনাধিক্য (ওবেজ)। এই ওজনাধিক্যের আবার অনেক গ্রেড রয়েছে। পৃথিবীজুড়ে এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন : এটি কেন এত বেড়ে যাচ্ছে?
উত্তর : একটি একটি করে বলি, যেমন : অনেক অসুখ রয়েছে হাইপারটেনশন। শরীরের সব জায়গায় এর ছাপ ফেলে; এটি ক্ষতিকর। ডায়াবেটিস শরীরের সব জায়গায় ছাপ ফেলে; ক্ষতিকর। তেমনি বাড়তি ওজনও সব জায়গায় তার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমে (হৃদযন্ত্রের পদ্ধতি) মেটাবলিক সিনড্রম বলে একটি লক্ষণ তৈরি করে, যেখানে উচ্চ রক্তচাপ হয়। টাইপটু ডায়াবেটিস হয়। রক্তে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং এর কারণে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, সবগুলো হতে থাকে। লিভারের মধ্যে চর্বি জমে। সেখান থেকে লিভার সিরোসিস হতে পারে। শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা হয়। রোগী একটুতেই হাঁপিয়ে যায়। রাতে নাক ডাকে। স্লিপ এপেনিয়া বা ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার সমস্যা হয়- এটি হতে পারে। প্রস্রাব ঝড়ে যায়। হাঁটুতে ব্যথা, অস্টিওআরথ্রাইটিস হয়, হাঁটতে চলতে পারে না। এগুলো ছাড়া আরো যেটি মারাত্মক, ওজনাধিক্যের কারণে কিছু হরমোন ঠিকমতো বিপাক ( মেটাবোলাইজড) হয় না। এতে ক্যানসারের হার অনেক বেড়ে যায়। তাতে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এগুলো ছাড়া তার মানসিক সমস্যাও কিন্তু হচ্ছে। মোটা মানুষের শরীরে বিভিন্ন ভাঁজে ঘাম জমে থাকে, ভেজা ভেজা থাকে। এগুলো থেকে ত্বকে সংক্রমণ হতে পারে। অনেক রোগের উৎস এই ওজনাধিক্য। বিভিন্ন রোগকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে এটি।
প্রশ্ন : কেন এই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে? তার পেছনের কারণগুলো কী?
উত্তর : প্রথম কারণ যদি বলতে চাই, পরিবেশগত কারণ, প্রধানত দায়ী। পরিবেশ বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আমাদের অনেক ধরনের পরিবেশের পরিবর্তন হয়েছে। এখন মানুষ অনেক আথির্কভাবে স্বচ্ছল হচ্ছে সারাদেশেই। তাতে অনেক ধরনের খাবার খাচ্ছে, এনার্জি ইনটেক (শক্তি গ্রহণ) বেশি হচ্ছে এবং খরচ কমে যাচ্ছে। যেমন : ব্যাংকে যদি টাকা ডিপোজিট করা হয়, আর খরচ না করা হয়, টাকা তো জমতেই থাকবে। সেই রকমভাবে এনার্জি (শক্তি) নিচ্ছি আমরা। ফাস্ট ফুড, সফট ড্রিংকস এগুলো তো আগে ছিল না। এখন সবাই খাচ্ছে। সব দেশেই খাচ্ছে। তবে খরচ হচ্ছে না। কারণ কায়িক পরিশ্রম তো কমে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েরা আগে যে দলবেঁধে স্কুলে যেত সেটি কিন্তু এখন আর দেখা যায় না। মহিলারা আগে ঘরের কাজ করত, কাপড় ধুইতো বাসন মাজতো- এসব আর করা লাগে না। সবই মেশিন করে দিচ্ছে। তা ছাড়া কম্পিউটার, ফেসবুক, টেলিভিশন, সিরিয়াল- এগুলোও মানুষকে বাধ্য করছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখতে। এতে শরীরের কোনো শক্তি খরচ হচ্ছে না। কাজেই ব্যাংকে শুধু জমছেই, খরচ হচ্ছে না। এটি একটি কারণ।
তা ছাড়া কিছু অসুখ রয়েছে। এসব অসুখের কারণেও স্থূলতা হতে পারে। তার মধ্যে হরমোনাল অসুখ রয়েছে। এডিনাল গ্ল্যান্ডের অসুখ, থাইরোয়েড গ্রন্থির অসুখ হলে এ রকম হতে পারে। মস্তিস্কে থেলামাস বলে একটি অঙ্গ রয়েছে সেটিতে যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলেও হতে পারে। কিছু ওষুধ রয়েছে, যেমন : যান্ত্রিক কারণে মানুষের অনেক সময় মানসিক সমস্যা হয়। এর জন্য যেসব ওষুধ খায় এর কারণেও হতে পারে।
তা ছাড়া একটি প্রচলিত রোগ ডায়াবেটিস, সেই ডায়াবেটিসের যে ওষুধ সালফোলিন ইউরিয়া- এটাও মোটা করে। এমনকি ইনসুলিনের জন্যও সমস্যা হতে পারে। এ রকম অনেক ওষুধ আছে, অনেক অসুখ আছে, সবকিছুর কারণে হতে পারে। তার সঙ্গে আরো একটি বিষয় না বললেই নয়, জেনেটিক্যাল কারণও রয়েছে। তবে স্থূল হতে এটি কতটুকু প্রভাব ফেলে এটি সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন : যখন আপনাদের কাছে আসে রোগীরা তখন কী অভিযোগ করে এবং আপনারা বিষয়টি কীভাবে ব্যবস্থাপনা করেন?
উত্তর : এখানে যেটা অভিযোগ করে, ওজন বেড়ে যাচ্ছে। আমি খুব কম খাই, তবে ওজন বেড়ে যাচ্ছে। কথাটা কতটুকু সঠিক সে বিষয়ে অবশ্য প্রশ্ন থেকে যায়।
আমি যেটা করি, যদি একজন বয়স্ক মানুষ এসে বলল, ‘আগের মতো তো খাই না, তাও ওজন বাড়ছে।’ কথা ঠিক না। আগের মতো খাচ্ছেন তিনি ঠিকই, তবে সেভাবে পরিশ্রম করছেন না। কারণ তাঁর বয়স হয়ে গেছে। তাঁর কাজ এখন হয়তো ভাগ হয়ে গেছে। অন্যরা হয়তো করছে তাঁর কাজগুলো। কাজেই পরিশ্রম কম হচ্ছে, শক্তির খরচ কম হচ্ছে।
আর যখন মোটা হতে থাকে, তারা দেখিয়ে অথবা না দেখিয়ে খেতে থাকে। না খেয়ে মোটা কিন্তু খুব কম হয়। দুই একটা অসুখ ছাড়া সাধাণত না খেয়ে মোটা হয় না। কাজেই কিছু প্রাথমিক পরীক্ষা করতেই হয়, যে তার অসুখ আছে কি না। অসুখের কারণে মোটা হচ্ছে কি না, ওষুধের কারণে মোটা হচ্ছে কি না। এজন্য কিছু পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : কী কী ধরনের পরীক্ষা করেন?
উত্তর : যেমন থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের যদি সমস্যা থাকে হরমোন টেস্ট করে দেখতে হবে। এডিনাল গ্ল্যান্ডের সমস্যা দেখতে হয়। ডায়াবেটিস আছে কি না দেখতে হয়। খুব ভালো করে ইতিহাস নিতে হয়। কী ধরনের ওষুধ খাচ্ছে তার ইতিহাস নিতে হবে।
প্রশ্ন : ইতিহাস নেওয়ার পর রোগীদের কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : রোগীদের ডায়েটিং করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একজন স্থূল রোগীর জন্য যে কারণেই হোক, যদি আমি জানি হরমোনের জন্য হচ্ছে, স্টেরয়েডের জন্য হচ্ছে, তাহলে সেগুলোকে বন্ধ করে দেব। অথবা পাল্টে দিয়ে অন্য দলের ওষুধে যেতে হবে। যার মানসিক রোগ তার তো ওষুধ বন্ধ করে দিতে পারব না। তাঁকে অন্য দলের ওষুধে যেতে হবে। তবে ডায়েটিং অবশ্যই করতে হবে। ডায়েটিং ও ব্যায়াম দুটোই করতে হবে। শরীরের ক্যালোরি ঝড়াতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
প্রশ্ন : অনেকে আবার বলে, ওষুধ দিয়েই কমানো যায় কি না?
উত্তর : ওষুধ আছে কিছু। যারা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন, ডায়েটিং ও ব্যায়াম দিয়ে, তবে এরপরও ওজন কমছে না। তাদের জন্য হয়তো কিছু ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। তবে এই ওষুধ কিন্তু বাজারে খুব একটা নেই। কারণ, সব ওষুধেরই এত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে দেখা গেছে যে এগুলো আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়। একটি-দুটি ওষুধের হয়তো গ্রহণযোগ্যতা আছে।
প্রশ্ন : মুটিয়ে যাওয়ায় কী কী জটিলতা হতে পারে?
উত্তর : যেমন বললাম, হার্টের অ্যাটাক থেকে শুরু করে, সব কিছুই সমস্যা করতে পারে। হার্টের অ্যাটাক, মেটাবোলিক সিনড্রম, ডায়বেটিস, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, স্লিপ এপেনিয়া এধরনের সমস্যা হয়।
এমনকি এমনও হতে পারে, স্লিপ এপেনিয়া হয়ে ঘুমের মধ্যে মারাও যেতে পারে।
প্রশ্ন : এই সমস্যা থেকে দূরে থাকার জন্য আপনার দর্শকদের জন্য কিছু পরামর্শ আছে কী?
উত্তর : মোটা হওয়াটা একদম ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়ে যায়। মা-বাবা ছোটোবেলা থেকে আদর করে খাওয়াতে থাকে। নাদুস-নুদুস বাচ্চা দেখতে ভালোবাসে। মা-বাবার উদ্দেশে বলব, এতটা স্থূলতা আপনি কখনো পছন্দ করবেন না। বাচ্চা যাতে সুস্থ থাকে স্বাভাবিক থাকে তার জন্য তাকে পরিমিত খাবার দেবেন। খেলাধুলায় উৎসাহ দেবেন। সারাক্ষণ ফেসবুক আর টেলিভিশন নিয়ে যেন বসে না থাকে সেদিকে সচেষ্ট হব%E