পুড়ে গেলে শুধু পানি ঢালুন
বিভিন্ন কারণে পোড়ার ঘটনা ঘটে। পুড়ে গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি। ১৩ ফেব্রুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৯৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. মো. আশরাফুজ্জামান। বর্তমানে তিনি মুগদা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে কর্মরত আছেন।
urgentPhoto
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়া অত্যন্ত প্রকোট একটি সমস্যা। নানাবিধ কারণে আমরা পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় আক্রান্ত হই। এটা খুব হৃদয়বিদারক। বাংলাদেশে সাধারণত কী কী কারণে একজন মানুষ পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় আক্রান্ত হয়?
উত্তর : বাংলাদেশে সাধাণত অগ্নিকাণ্ডে পোড়ার ঘটনা বেশি ঘটে। তারপর এখন শীতকালে গরম পানি দিয়ে পোড়ার সমস্যা হয়। এ ছাড়া গরম তেল দিয়ে পোড়ে। আরেকটি কারণ হচ্ছে ইলেকট্রিক বার্ন। আপাতত এসিড বার্ন কিছুটা কমে আসছে আমাদের দেশে। আগে এটি ব্যাপক ছিল। এখন অনেকটা কমে এসেছে। তবে ইলেকট্রিক বার্ন এখ্ন বেশি। সাথে আগুনে পোড়াটা বেশি হচ্ছে।
আর শীতকালে বেশি পাওয়া যায় গরম পানি দিয়ে পোড়া। গরম পানি নিতে যাচ্ছে। অসাবধণতাবশত হয়তো পড়ে যাচ্ছে, বাচ্চার গায়ে পড়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়া কষ্টকর একটি ব্যাপার। ক্ষতির বিবেচনায় কোনটাকে আপনারা বেশি মারাত্মক বলে থাকেন। পুড়ে যাওয়ার ধরনের মধ্যে কোনগুলো বেশি মারাত্মক?
উত্তর : আমাদের দেশে আমরা বলি, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ। শতাংশের একটি হিসাব করি। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ১০ ভাগ এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে ১৫ ভাগ। এর ওপরে হলেই এটা গুরুতর, বিপজ্জনক। এর ওপরে হলেই আমরা বলি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য।
প্রশ্ন : আর ধরন হিসেবে?
উত্তর : ধরন হিসেবে কয়েকটি ভাগ করা রয়েছে। সুপার ফেশিয়াল বার্ন, মিক্সড বার্ন এবং ডিপ বার্ন। সুপার ফেশিয়াল বার্ন হলো, শুধু চামড়ার উপরের অংশটি পুড়ে গেছে। এখানে যদি ১০ ভাগের নিচে হয় আমরা ড্রেসিং করে দিলে বাড়িতেই সে ভালো হয়ে যাবে। এবং চিকিৎসকের পরামর্শে থাকলে সে ভালো হয়ে যাবে। তবে আমাদের দেশে ৫০ থেকে ৬০ ভাগের ওপরে নিরাপদ হয়েছে।
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়ার কারণ যেগুলো বলছিলেন এগুলোর মধ্যে কোনটি প্রভাব বেশি এবং মৃত্যুর হার কোনটায় বেশি?
উত্তর : মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ইনহেলেশন বার্নে। মানে শ্বাসনালির পোড়ায়। শ্বাসনালি পুড়ে গেলে এটি চিকন হয়ে যাবে। ফুলে যাবে। এতে রোগী শ্বাস নিতে না পাড়লে অক্সিজেনও নিতে পারবে না। কার্বনডাই-অক্সাইডও বের করতে পারবে না। তার শরীরে সহজে ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীন হয়ে যাবে। এই পোড়ায় তো আমরা সহজেই শ্বাসনালির ভেতরে ঢুকতে পারছি না। তাই কেবল ওষুধে চিকিৎসা বা আইসিউউর সুবিধা দিয়েও অনেক সময় আমরা রোগীকে বাঁচাতে পারি না।
প্রশ্ন : শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে কখন?
উত্তর : একটি বদ্ধ ঘরের মধ্যে যদি আগুন লাগে, সে যদি বের হতে না পারে। ওই ধোঁয়া বা তাপটি যে ভেতরে প্রবেশ করে এবং সাধারণত সে অসচেতন হয়ে শ্বাস নিতে থাকে, তখনই শ্বাসনালি পুড়ে যায়। এটা মারাত্মক পরিস্থিতিতে ফেলে।
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়ার পর আমরা দেখি রোগীরা পুড়ে যাওয়ার স্থানে নানা রকম জিনিস দিয়ে প্রলেপ দেয়। কেউ তেল দেয়, ডিম ভেঙে দেয়, লবণ ছিটিয়ে দেয়। এগুলো কী লাভ করে? না কি ক্ষতি করে?
উত্তর : এর আসলে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। এগুলো দিয়ে জায়গাটি আরো সংক্রমিত হয়ে যায়। আমার প্রয়াত অধ্যাপক ছিলেন মো. শহীদুল্লাহ স্যার। উনি একটি কথাই বলতেন, প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর। সেই কথা অনুযায়ী আমরাও বলি পুড়ে গেলে স্থানটিতে পরিষ্কার পানি দেন। যতক্ষণ পর্যন্ত জ্বালা যন্ত্রণা না কমছে আপনি ওই জায়গায় ঠান্ডা পানি ঢালতে থাকেন। একেবারে বরফ দেবেন না, তবে ঠান্ডা পানি ঢালবেন। ঢাললে জায়গাটি পরিষ্কারও থাকবে, রোগীর ব্যথা, জ্বালাপোড়াটাও কমে যাবে। ত্বকের নিচের পর্যায়ের যে পোড়াটা সেটাও কমে যাবে। বিশেষ করে এসিড বার্নের ক্ষেত্রে আমরা এটা বলি। পানি দিতে থাকলে ভেতরে জিনিসটি যায় না। তবে ইলেকট্রিক বার্ন কিন্তু খারাপ জিনিস। সেটা একদম হাড়ের গভীর পর্যন্ত চলে যায়। সেই ক্ষেত্রে আমরা বলি, পানি দিয়ে যতটা পারেন গভীরতা কমিয়ে দেবেন। শুধু পানি ঢালতে বলি এবং দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে বলি। ওই সব জিনিস একদমই দেওয়া উচিত নয়।
প্রশ্ন : তাৎক্ষণিকভাবে কী কোনো মলম লাগাতে পারেন?
উত্তর : হ্যাঁ, সেগুলো দিতে পারেন। সিলভার সালফার ডায়েজিন। বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন নামে আছে। সিলভার সালফার ডায়েজিন প্রথমে দেন। তার সাথে জেসোকিন জেলিটা ব্যবহার করতে পারে জ্বালাপোড়া কমাবার জন্য। তাৎক্ষিকভাবে এই ব্যবস্থা নেওয়ার পর যতদ্রুত পারে চিকিৎসকের কাছে যেন চলে যায়।
প্রশ্ন : রোগী আসার পর আপনারা কী করেন?
উত্তর : আসার পর আমরা তার শতাংশটি হিসাব করি। একটি শরীরের ১০০ ভাগ হিসাব করা রয়েছে। সেই শতাংশ অনুযায়ী হিসাব করে দেখি, এটি যদি ১০ ভাগের কম হয়, তাহলে আমরা শুধু মুখে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে, ড্রেসিং করে, পরিষ্কার করে দেই।
আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ১০ ভাগের বেশি, আর বড়দের ক্ষেত্রে ১৫ ভাগের বেশি হলে আমরা তাকে ভর্তি করে তাকে দ্রুত ফ্লুইড দিতে হবে। আইভি দিতে হবে, স্যালাইন দিতে হবে। তার ফ্লুইড যে চলে যায়, একে পূর্ণ করার জন্য। এই ফ্লুইড হারিয়ে গেলে তার ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য হারাবে। এটি হলে সারা শরীরেরই ক্ষতি হয়ে যাবে।
অনেক সময় বাইরে থেকে রোগী আসে। কোনো কিছু না দিয়েই তারা চলে আসে। আমরা বাইরের চিকিৎসককে বলি কিছু করার দরকার নেই। শুধু রোগীকে পরিষ্কার করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। তাতে রোগীর উপকার হবে।
আর অনেকের ধারণা ঢাকায় শুধু একটাই বার্ন ইউনিট আছে। তবে এখন কিন্তু ঢাকায় তিনটি বার্ন ইউনিট রয়েছে সরকারিভাবে। মুগদা মেডিকেল কলেজে গত বছর একটি বার্ন ইউনিট করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের চাপ কমানোর জন্য সরকার এই দুটি জায়গায় বার্ন ইউনিট করেছে।
প্রশ্ন : পোড়া রোগীদের বেলায় পরে যে বিকৃতি হয়। এই বিষয়ে কী করণীয়?
উত্তর : বিকৃতি নির্ভর করে তার কোথায় কী হয়েছে এর ওপর। তবে এই বিষয়ে আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়। যদি হাতে পোড়ে, হয়তো হাত আর সোজা করতে পারে না। তখন আমরা যদি একটি স্প্লিন দিয়ে সোজা করে রাখি তাহলে আর সমস্যা হয় না। কারো হাতে হয়, পায়ে হয়, কারো ঘাড়ে এই সমস্যা হয়। ঢাকা শহরে অনেক ভিক্ষুক দেখবেন ঘাড় বাঁকা হয়ে আছে। আসলে প্রথম থেকে যদি ঘাড় কনট্রাকচার প্রতিরোধে দিতে পারতাম তাহলে এই সমস্যা হতো না। তারপরও আমাদের কিছু রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারি আছে, ফ্লাপ করার বিষয় আছে- এগুলো করি। কিছু স্কিন গ্রাফটিং করি। করলেও ১০০ ভাগ ঠিক করে কিন্তু আমরা দিতে পারব না। পৃথিবীর কোথাও ১০০ ভাগ ঠিক করে দিতে পারবে না। সামাজিকভাবে অনেকখানি কার্যক্রম করার জন্য তাকে ভালো করা সম্ভব।
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়ার মতো এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : পুড়ে যাওয়া প্রতিরোধে খেয়াল রাখতে হবে শিশুকে রান্নাঘরে যেতে দেবেন না। দেখবেন অনেক দুর্ঘটনা কমবে। রান্নাঘর থেকে গরম পানির পাতিল বাথরুমে না নিয়ে, আগে গরম পানি মগ দিয়ে বালতিতে ঢালুন। এরপর রান্নাঘরে নিন। গ্যাসের চুলা নিভিয়ে উপরের ক্যাবিনেট থেকে জিনিসপত্র নামান। সবচেয়ে বড় কথা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
ইলেকট্রিক বার্ন এখন আমাদের দেশে অনেক হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে ইলেকট্রিক জিনিস চুরি করছে। হুক লাগিয়ে ঘরের ভেতর আনতে গিয়ে হিটার চালায়। কিছু প্লাগ ব্যবহার করে তখন পুড়ে যায়। এমন অনেক রোগী রয়েছে তার চার হাত পা কেটে গেছে। সেই ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত।