আবহাওয়া বদলে শিশুদের রোগব্যধি

শীত থেকে গরম আসছে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনে শিশুদের নানা রকম রোগব্যাধি হয়। আজ ৬ মার্চ এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৯৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাঈদা আনোয়ার।
প্রশ্ন : গরম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সাধারণত কী কী রোগের প্রকোপ বাড়ছে?
উত্তর : আবহাওয়া শীত থেকে ধীরে ধীরে গরমের দিকে যাচ্ছে। গরম হওয়ায় বাচ্চাদের অত্যন্ত ঘাম হচ্ছে। ঘামের জন্য পানিশূন্যতা হচ্ছে, ডায়ারিয়া হচ্ছে। পানিশূন্যতার জন্য যত্রতত্র পানি খেয়ে ফেলছে। এর ফলে টাইফয়েড বা পানিবাহিত রোগ হচ্ছে। পাশাপাশি ঠাণ্ডা-কাশি তো লেগেই আছে।
প্রশ্ন : শিশুদের সর্দি-কাশি বা ফ্লু টা খুব ঘন ঘন হচ্ছে এ সময়, এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের কী করণীয়।
উত্তর : এ ক্ষেত্রে বাচ্চাগুলোকে খোলামেলা জায়গায় রাখতে হবে। যেখানে এতটু গরম কম, সেদিকে ফ্যানটা চালিয়ে দেওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় রাখা। বেশি কাপড়চোপড় পরিয়ে না রাখা; এর ফলে বেশি ঘেমে যায়, ঘামটা শুকিয়ে গেলে আরো বেশি ঠান্ডা লাগে। সুতির কাপড় পরাতে হবে।
প্রশ্ন : দূষিত পানির কারণে কী কী রোগ হচ্ছে। এবং কীভাবে এটি প্রকাশ পাচ্ছে?
উত্তর : পাতলা পায়খানা হচ্ছে, পাশাপাশি রক্তও যাচ্ছে। এসব বিষয় মায়েদের খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় পেটের সমস্যার কারণে বাচ্চারা বমি করে। আবার যদি বিষাক্ত কিছু ঢোকে, যেমন ফুড পয়জনিং এর মতো হয়, তাহলে কিন্তু জ্বরও আসতে পারে।
প্রশ্ন : ফুড পয়জনিং এ জ্বর আসার পাশাপাশি আর কী কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : পাতলা পায়খানা হবে। অথবা পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাবে। বমি করবে। হঠাৎ করে লক্ষণগুলো শুরু হবে।
প্রশ্ন : আর টাইফয়েডে...
উত্তর : টাইফয়েডে অনেক জ্বর হয়। ১০৩ বা ১০৪ জ্বর থাকবে। পেট ফুলে যাবে। অনেক সময় শক্ত পায়খানা হতে পারে, আবার হয়তো পাতলা পায়খানা হবে।
প্রশ্ন : ডায়ারিয়ার ফলে পানিশূন্যতা যেটি বলছিলেন, রোগটি হয়তো খুব সাধারণ কিন্তু না জানার ফলে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। শিশুটিকে পানিশূন্যতা থেকে মুক্ত রাখতে হলে কী করতে হবে?
উত্তর : ছয় মাস বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের খুব ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাসের পর থেকে পানিশূন্যতা হলে, পাতলা পায়খানা হলে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ৫০ থেকে ১০০ এমএল স্যালাইন খাওয়াতে হবে। সাদা পানি বেশি খাওয়ালে আরো বেশি রক্তের স্বল্পতা হবে। তাই সাদা পানির চেয়ে যদি স্যালাইন খাওয়ানো যায়, তাহলে লবণের ঘাটতি পূরণ হবে।
প্রশ্ন : স্যালাইনটা কতক্ষণ খাওয়ানো উচিত?
উত্তর : প্রতিবার পাতলা পায়খানা করার পরে দুই বছর পর্যন্ত ৫০ থেকে ১০০ এম এল খাওয়াতে হবে। আর দুই বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ১০০ থেকে ২০০ এমএল। আর ১০ বছরের পর যত ইচ্ছা তত খেতে পারবে।
প্রশ্ন : ডায়ারিয়ার কারণে দুই বছরের নিচের বাচ্চাকে হয়তো স্যালাইন খাওয়াচ্ছে। কিন্তু বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার কী পরামর্শ?
উত্তর : স্যালাইন তো খাবার না। এটি শুধু যে পানিটি পাতলা পায়খানার পর শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তা পূরণ করে। ইলেকট্রোলাইট শরীর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সেটি পূরণ করছে। কিন্তু পাশাপাশি খাবার খেতে হবে। যারা মায়ের দুধ খাচ্ছে, তারা কোনোভাবেই যেন খাবার বন্ধ না করে। মায়ের দুধ বন্ধ করলে আরো বেশি সমস্যা হবে।
প্রশ্ন : ডায়ারিয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রে মায়েরা খাবার-দাবার কমিয়ে দেয় যাতে বেশি পায়খানা না হয় বাচ্চার...
উত্তর : এটা উচিত নয়। এর ফলে বাচ্চার অপুষ্টি হতে পারে। এতে শিশু সুস্থ হবে না। এই সময় তো আসলে মস্তিষ্কের গঠন হয়, সে জন্য খাবার সঠিক পরিমাণে রাখা উচিত। তার স্বাভাবিক খাবার চলবে সাথে করে স্যালাইন চালাতে হবে।
প্রশ্ন : এর ফলে কী কী ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে?
উত্তর : স্যালাইন যদি ঠিকমতো না খাওয়ায় তাহলে কিন্তু প্রস্রাবে চাপ পড়বে। প্রস্রাব কমে যাবে। এটি কমে গেলে কিডনির সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া শরীরে পটাশিয়ামের স্বল্পতা হবে; পেট ফুলে যাবে। দেহে সোডিয়ামের স্বল্পতা হলে দুর্বল হয়ে যাবে, এমনকি বাচ্চার খিঁচুনিও হতে পারে। পানি না পেয়ে একসময় বাচ্চা নিস্তেজ হয়ে যাবে, কোনো পালস দেখা যাবে না। রক্তচাপ নাও থাকতে পারে। বাচ্চার স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে বেশ খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। তবে মায়েরা এখন সচেতন হয়ে গেছে ডায়ারিয়া হলে বাচ্চাকে স্যালাইন বা বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে।
প্রশ্ন : একটু টাইফয়েডে যাই। জ্বরটা যখন আসে, তখন কী করণীয় এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে কখন যাওয়া উচিত বলে মনে করের আপনি?
উত্তর : আসলে জ্বরটা যখন হয় ভাইরাল ফিভার, সেটা তিন থেকে সাতদিনের মধ্যে কমতে শুরু করে। তখন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া অত বেশি প্রয়োজন পড়ে না। তবে শিশুদের যেহেতু রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, একটু ভাইরাল ফিভার হলে দেখা যায়, সেটাই ব্যাকটেরিয়ান ইনফেকশনে রূপ নিয়ে নিয়েছে। হয়তো নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কলাইটিস হয়ে গেছে। সেজন্য মায়েদের বলব, এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই বিষেশজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
আবার সাতদিনের বেশি যদি জ্বর থাকে, যদি ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে জ্বর ওপরে উঠে যায়, তখন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : গরমে এই জাতীয় সমস্যা যেন না হয় সেজন্য প্রতিরোধের কী কী উপায় রয়েছে?
উত্তর : তাজা খাবার রান্না করে দিতে হবে। বাচ্চার খাবার যদি অনেকক্ষণ বাইরে পড়ে থাকে, তাহলে গরমে নষ্ট হয়ে যাবে। খাবারে যেন মাছি না বসে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাচ্চা যখন স্কুলে যাবে, তখন সাথে পানি দিয়ে দিতে হবে। আরেকটি বিষয়, টাইফয়েডের ভ্যাকসিন দিয়েও প্রতিরোধ করা যায়। দুই বছর বয়সের পর থেকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয় সেটিও নিতে পারে।