ঘুমের সমস্যা হলে
ভালো একটি ঘুম শরীর ও মনের ভালো থাকার জন্য খুবই প্রয়োজন। কেননা দিনের সমস্ত শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি ও ক্ষয় কাটিয়ে পরের দিনটির জন্য নিজেকে প্রাণবন্তভাবে ফিরে পেতে ভালো ঘুমের বিকল্প নেই। তবে কখনো কখনো ঘুম যেন ধরা দিতে চায় না। ছোটবেলার ‘ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো, খাট নেই পালংক নেই, সোনার চোখের পাতায় বসো’ গানটির সাথে আমরা প্রায় সবাই পরিচিত। ছোটবেলায় ঘুমের গান শুনে ঘুমাতে পারলেও এখন ঘুম ঠিকমতো হতে চায় না। অনেক চেষ্টার পরও ঘুম না এলে যে কী যন্ত্রণা, তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। আবার যাঁদের অতিরিক্ত ঘুম, তাঁদের যন্ত্রণাও কম না। আসুন জানি ঘুমের সমস্যা কেন হয়।
ঘুম কী
সংক্ষেপে ঘুম হলো একটি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। যেখানে ব্যক্তির :
- শরীর ও মন শিথিল হয়ে যায়।
- চেতনা প্রায় সম্পূর্ণ চলে যায় বা আংশিকভাবে কমে যায়।
- শরীরের ঐচ্ছিক নড়াচড়া থাকে না।
- কোনো উদ্দীপকের প্রতি স্বাভাবিক সাড়া থাকে না।
- শরীরের নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষগুলোর পুনর্গঠন ঘটে।
ঘুমের যত সমস্যা
নাক ডাকা থেকে শুরু করে একেবারেই ঘুম না, এমনকি অতিরিক্ত ঘুমানো সবগুলোই স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ।
নাক ডাকা
এটি খুব গুরুতর সমস্যা নয়। তবে রুমমেট বা বেড পার্টনারের জন্য এটি ভীষণ বিরক্তিকর। সুতরাং এটি নিজের ও অন্যের জন্য ক্ষতিকর।
পেরিওডিক লিম্ব মুভমেন্ট
এটিতে ব্যক্তি ঘুমের মধ্যে নিয়মিত বিরতিতে হাত-পা নাড়াতে থাকে। এতে ব্যক্তির নিজের ও অন্যদের ঘুমের ব্যাঘাত হয়।
রেস্টলেস লেগ সিনড্রম
এই ক্ষেত্রে ব্যক্তির ঘুমের মধ্যে পায়ের নড়াচড়া করে যা তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ব্যক্তির পায়ে অস্বস্তিদায়ক অনুভূতি হয়। ফলে তিনি পা না নাড়িয়ে পারেন না।
প্যারাসোমনিয়া
এটিতে ঘুম পূর্ণ হওয়ার আগেই (অর্থাৎ র্যাপিড আই মুভমেন্ট পর্বে) ভেঙে যায়। ফলে ঘুম থেকে উঠে শান্তি পাওয়া যায় না।
দুঃস্বপ্ন
ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন আমরা প্রায় সবাই দেখি। কিন্তু যদি সেটি প্রায়ই ঘটে তবে তা আমাদের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ঘুমের মধ্যে হাঁটা
এটি সবচেয়ে প্রচলিত ঘুমের সমস্যা। নাটক-সিনেমার বদৌলতে আমরা এ সমস্যা সম্পর্কে অনেকেই জানি। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় বেশির ভাগ সময় তা মনে করতে পারে না।
নারকোলেপসি
এর কারণে অসময়ে হঠাৎ করে অপ্রতিরোধ্য ঘুম পায়।
দাঁতে পিষা/শব্দ করা
অনেকেই ঘুমের মধ্যে দাঁতে দাঁত পিষে শব্দ করে। তবে যদি তা প্রায়ই হতে থাকে, তখন তা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
সারকাডিয়ান রিদমে সমস্যা
অনেক সময়ে ঘুমের পরিমাণ ও তৃপ্তি থাকলেও ঘুমটি হয় অসময়ে। ঘুম আসার সময় অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক এগিয়ে আসে বা পিছিয়ে যায়। স্থানীয় সময়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য এমন দেশে ভ্রমণের সময়ও মানুষের এ ধরনের অভিজ্ঞতা হতে পারে। যেমন বাংলাদেশে যখন দিন, তখন আমেরিকায় রাত। ফলে আমেরিকায় গেলে প্রথম কিছুদিন দিনে প্রচণ্ড ঘুম পেতে পারে ও রাত নির্ঘুম কাটতে পারে।
কেন ঘুমের সমস্যা
ঘুমের সমস্যার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : শারীরিক কোনো ব্যথা বা রোগ, মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা, সিদ্ধান্তহীনতা, মানসিক রোগ, বয়স, কোনো কোনো ওষুধ, জীবনযাপনের ধরন ও পরিবেশগত কারণ।
চিকিৎসা
ঘুমের সমস্যার কারণ অনুযায়ী চিকিৎসার ধরন নির্ধারণ করা হয়। যেমন : শারীরিক বা মানসিক কোনো রোগ থাকলে কিংবা কোনো ব্যথা থাকলে প্রথমে তা চিকিৎসা করাতে হয়। ঘুমের সমস্যাজনিত চিকিৎসাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় : বায়োলজিক্যাল চিকিৎসা (ওষুধের মাধ্যমে) ও সাইকোলজিক্যাল (মানসিক চিকিৎসা)।
বায়োলজিক্যাল চিকিৎসা
বায়োলজিক্যাল চিকিৎসায় মূলত ওষুধ ব্যবহার করা হয়। শুধুমাত্র নিবন্ধিত ডাক্তারের পরামর্শেই ঘুমের ওষুধ সেবন করা উচিত। চিকিৎসকরা অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি, অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টি-হিস্টামিন ও হিপ্নোটিক জাতীয় ওষুধ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত আরো অনেক নতুন ধরনের ওষুধ চলে আসছে যেগুলোতে আসক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎস্যা
মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসায় সাইকোলজিস্টরা মূলত দুই ধরনের বিষয় ব্যবহার করে থাকেন।
ক) স্লিপ হাইজিন, রিল্যাক্সেশন ও স্লিপ শিডিউলিং
খ) কগনিটিভ বিহ্যাভিয়ার থেরাপি
ক) স্লিপ হাইজিন, রিল্যাক্সেশন ও স্লিপ শিডিউলিং- এ দুই ধরনের বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। একটি হলো শোবার ঘর সংক্রান্ত ও অন্যটি জীবনধারা সংক্রান্ত।
শোবার ঘর সংক্রান্ত
- হঠাৎ করে শব্দ হলে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। তাই যতটা সম্ভব শব্দহীন কক্ষে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। তবে মাঝে কোনো শব্দকে যদি এড়ানো না যায় তবে ঘুমানোর আগে নিজেকে বলতে হবে ‘মাঝখানে এই শব্দটা হতে পারে তবে আমি ঘুমিয়েই থাকবো, যদি ঘুম ভেঙেই যায় আবার ঘুমিয়ে পড়ব।’
- রুমের তাপমাত্রা বেশি বা অতিরিক্ত কম হলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। তাই রুমের তাপমাত্রা যতটা সম্ভব আরামদায়ক করার ব্যবস্থা করতে হবে। তাপমাত্রা বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য আলাদা হতে পারে। তবে বেশির ভাগ মানুষের জন্য ১৮-২০ সেলসিয়াস বা এর আশপাশের তাপমাত্রা আরামদায়ক।
- শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা কমালে ঘুম ভালো হয়। ঘুমের দুই ঘণ্টা আগে গোসল বা এক ঘণ্টা আগে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নিলে ঘুম ভালো হয়।
- ঘরের আলো তীব্র হলে ঘুমের সমস্যা হয়। অনেকে খুব অন্ধকার ঘরেও ঘুমাতে পারে না। বেশির ভাগ মানুষের জন্য হালকা আলো ঘুমের জন্য ভালো।
- বিছানা ও বালিশ আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত হলে ঘুম ভালো হয়।
জীবনধারণ সংক্রান্ত
- যাদের ঘুমের সমস্যা রয়েছে তাদের বিকেলের পর থেকে ক্যাফেইনযুক্ত খাবার (চা, কফি, চকলেট, কোক ইত্যাদি) ত্যাগ করতে বলা হয়। কেননা ক্যাফেইন ঘুমকে বাধা দেয়।
- যেহেতু ধূমপানও ঘুমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সেহেতু বিকেলের পর থেকে ধূমপান এড়িয়ে চলতে হবে।
- মদ্যপান রাতের ঘুমকে নষ্ট করে দিতে পারে, বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তাই মদ্যপানসহ যেকোনো নেশাদ্রব্য পরিহার করতে হবে।
- খালি পেটে ঘুম নাও আসতে পারে বা ক্ষুধার কারণে ঘুম ভেঙে যেতে পারে। আবার খুব ভরা পেটও ঘুমের জন্য ভালো নয়। তাই খাবারের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
- বিকেলের ব্যায়াম ঘুমের জন্য সহায়ক। তবে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভারী ব্যায়াম করলে ঘুমের অসুবিধা হতে পারে। তাই ব্যায়াম করলে অন্তত দুই ঘণ্টা আগে করতে হবে।
- নিজের জন্য প্রয়োজনীয় ঘুমের সময় ঠিক করুন। এর সঙ্গে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান ও নির্দিষ্ট সময়ে উঠুন। এমনকি ছুটির দিনেও তা মেনে চলুন।
- রাতের ঘুমে অসুবিধা থাকলে দিনে ঘুমাবেন না। দিনের ঘুম রাতের ঘুমকে ব্যাহত করে। কিছুদিন পর রাতের ঘুম ঠিক হয়ে গেলে দিনে ঘুমানোর জন্য অতটা চাপ অনুভূত হবে না।
- ঘুমানোর অন্তত একঘণ্টা আগে থেকে ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিন। কারণ হঠাৎ করেই ঘুমাতে গেলে ঘুম আসতে চায় না। তবে প্রস্তুতি নিতে থাকলে (যেমন : ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়া, বিছানা করা, সবকিছু চেক করা, ঘুমের পোশাক পরা ইত্যাদির সাথে নিজেকে বলা আমি এক ঘণ্টা পর অর্থাৎ এতটার সময়ে ঘুমাতে যাব) ঘুম ভালো হয়।
- একেবারে সতেজ অবস্থায় ঘুমানোর চেষ্টা না করে একটু ঘুম ঘুম ভাব এলে ঘুমানো সহজ হয়।
- শৈথিল্য আনুন সবকিছুতে। ভাবনা ও শরীর শিথিল বা নির্ভার করে ঘুমানোর চেষ্টা করলে ঘুম আসতে সাহায্য করে।
- আপনার যদি ঘুমের অসুবিধা থাকে তবে বিছানায় ঘুম ও যৌনক্রিয়া ছাড়া আর কোনো কিছু করবেন না। যেমন টিভি দেখা, সারা দিন পড়া, ফেসবুকিং করা, পিসি বা মোবাইলে গেম খেলা ইত্যাদি কোনো কিছুই করবেন না। এতে করে শরীর ও মন আস্তে আস্তে শিখে যাবে যে ‘বিছানায় যাওয়া মানেই ঘুম’। তখন শুলেই ঘুম আসার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
- আনুমানিক ১৫ মিনিটের মধ্যে ঘুম না এলে উঠে পড়ুন। ১৫ মিনিট হলো কি না, তা দেখার জন্য ঘড়ি দেখবেন না। এরপর এটাসেটা করে আবার ঘুমাতে যান। তবে কম্পিউটারে বা মোবাইলে গেম খেলা, সিনেমা দেখা, ফেসবুকিং ইত্যাদি করা যাবে না। কেননা এগুলো আপনাকে উদ্দীপিত করে দিতে পারে। ঘুমের জন্য উদ্দীপনা নয়, শান্ত ও স্নিগ্ধ অনুভূতি সহায়ক। তাই শরীরকে উদ্দীপিত করে রাখে এমন কিছু করবেন না।
খ) কগনিটিভ বিহ্যাভিয়র থেরাপি
অনেক সময় ‘ঘুম আসছে না কেন?’ এই দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না। নানাবিধ সমস্যার কারণে মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা ও সিদ্ধান্তহীনতা আসতে পারে। যেগুলোর প্রত্যেকটিই ঘুমকে প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত করে। এসব কারণে ঘুম না এলে কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছ থেকে সাইকোথেরাপি নিতে হয়। সাইকোলজিস্ট ব্যক্তির ঘুম না আসার সমস্ত কারণগুলো খুঁজে বের করতে সাহায্য করেন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যাল কৌশল ব্যবহার করে কারণগুলো থেকে ব্যক্তিকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করেন। কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে রিল্যাক্সেশন, থট চ্যালেঞ্জ, কগনিটিভ রিস্ট্রাক্চারিং, মাইন্ডফুলনেস ইত্যাদি। এ ছাড়া কিছু কিছু বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধিরও প্রয়োজন হয়। যেমন : মানসিক চাপ মোকাবিলা, অ্যাসারটিভনেস, সমস্যা সমাধান ও দ্বন্দ্ব নিরসন দক্ষতা। এসব দক্ষতা ব্যক্তিকে চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত হতে সাহায্য করে। এসব চিকিৎসার ফলে ব্যক্তির ঘুম আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে।
তানজির আহম্মদ তুষার : ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়