কী কী রোগে পেটে পানি আসে?
বিভিন্ন রোগের কারণেই পেটে পানি আসতে পারে। পেটে পানি আসছে বুঝতে পারলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। নয়তো রোগ জটিল হয়ে যেতে পারে। আজ ২৪ এপ্রিল এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০১৫তম পর্বে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ।
প্রশ্ন : সাধারণত কোন কোন সমস্যার কারণে একজন মানুষের পেটে পানি আসতে পারে?
উত্তর : কারণ অনেকগুলো। আগে বলি পানি সাধারণত কোথায় আসতে পারে। পেটে আসতে পারে, পায়ে আসতে পারে, মুখে আসতে পারে। এগুলো প্রচলিত জায়গা। এ ছাড়া কখনো কখনো সারা শরীরে চলে আসতে পারে। যখন শুধু পেটে পানি আসে, আমরা ধরে নিই রোগটা পেটেই কেন্দ্রীভূত। যখন পেটের সাথে পা চলে আসছে, তখন কারণটা আরেকটু বেড়ে গেল। যখন মুখ যোগ হলো, তখন সাধারণত তা কিডনির দিকে চলে যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পেটে পানি আসার মূল বিষয়ের মধ্যে থাকে লিভারের রোগ। যেটাকে আমরা বলি লিভার সিরোসিস। আরেকটি বিষয় হলো টিবি বা যক্ষ্মা, বাংলাদেশে এটিও খুব প্রচলিত একটি রোগ। আমাদের সাধারণ ধারণা হলো যক্ষ্মা শুধুমাত্র ফুসফুসে হয়। তবে এটি শরীরের যেকোনো অংশে হতে পারে। যক্ষ্মা যখন পেটে হয়, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি নির্ণয় করা অনেক কঠিন এবং দেরিও হয়ে যায়। বিভিন্ন রকম জটিলতা তৈরি হওয়ার পর নির্ণয় করা যায়। পেটে যখন যক্ষ্মার কারণে পানি চলে আসছে তখন রোগী অনেক ক্ষেত্রে বোঝেও না।
এ ছাড়া হার্টে যদি কোনো সমস্যা থাকে তাহলেও পেটে পানি চলে আসতে পারে। আর একটি প্রচলিত এবং ভয়াবহ কারণ হলো ক্যানসার। যদি পেটে ক্যানসার হয়, সেটা লিভারের ক্যানসার হতে পারে, খাদ্যনালি বা বৃহদান্তে ক্যানসার হতে পারে- তাহলেও পানি আসতে পারে। অনেক সময় তীব্র ব্যথা হয়ে পেটে পানি আসতে পারে।
আর কিছু কিছু বিষয় আছে, শরীরে যদি অ্যালবুমিনের পরিমাণ কমে যায়। এটা কিডনির কারণে হতে পারে। আবার অনেক সময় পায়খানার রাস্তা দিয়ে অ্যালবুমিন চলে যায়। যেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলি প্রোটিন লুজিং এন্টেরোপ্যাথি। বেশ কিছু কারণ আছে যার ফলে অ্যালবুমিন কমে যায়। থাইরয়েডের সমস্যা হলে পেটে পানি আসতে পারে। প্যানক্রিয়াটাইটিস, পেটে তীব্র ব্যথা হয়ে পানি আসতে পারে। এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ কারণ তবে তেমন প্রচলিত নয়।
প্রশ্ন : কী কারণে পানি আসছে এটা কি পানি আসার অবস্থা দেখে ধারণা করা যায়?
উত্তর : কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। যেমন : লিভার সিরোসিস, অনেক সময় এই রোগীগুলোর জন্ডিস হওয়ার ইতিহাস থাকতে পারে। যেমন বি ভাইরাস বা সি ভাইরাস। অথবা সে হয়তো জানেই না। পানি আসা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে চলে আসতে পারে।
লিভারের কারণে যদি পেটে পানি আসে, তাহলে শরীরের মাংসপেশি ক্ষয় হয়ে যায়। মুখ শুকিয়ে যায়, পেটটা বড় হয়ে যায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে অনেক সময় মেয়েদের মতো ব্রেস্ট বড় হয়ে যায়। শরীরের ভেতরে চুল যেগুলো থাকে তা পড়ে যেতে পারে। কিছুটা জন্ডিস চলে আসতে পারে। শরীরে লাল লাল দাগের মতো হতে পারে। পাশাপাশি সেকেন্ডারি সেক্সুয়াল বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হার্টে যদি পানি আসে, সেখানে রোগী বলতে পারে বুকে ব্যথা। অথবা আগে থেকে তার ভাল্বে কোনো সমস্যা ছিল, সে জন্য তার শ্বাসকষ্ট হতে পারে। একটু পরিশ্রম করলে সে হাঁপিয়ে যাবে। এছাড়া হার্টের বাম দিক যদি আক্রান্ত হয়, তখন বিছানায় শুলেই সে বলবে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। যখন অনেক পানি পেটে চলে আসে, তখন শ্বাস কষ্ট হয়।
যক্ষ্মায় আমরা ভাবি জ্বর থাকে। তবে পেটের যক্ষ্মায় জ্বর নাও থাকতে পারে। পেটের যক্ষ্মা যদি পায়খানার রাস্তার ভেতর পর্যন্ত হয়, তখন পাতলা পায়খানা হতে পারে। অথবা পায়খানার সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। এই লক্ষণগুলো নিয়ে রোগী ডাক্তারের কাছে আসতে পারে।
এ ছাড়া সবচেয়ে ভয়ের যেটা বললাম, ম্যালিগনেন্সি। এই রোগীগুলোর হঠাৎ করে খাদ্যমন্দা হয়, অরুচি হয়, হঠাৎ করে দেখা যায় শরীরের ওজন কমে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : যক্ষ্মার অন্যান্য বিষয়গুলোতে কি একই লক্ষণ দেখা যায়?
উত্তর : পেটের টিবিকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করি। পেটের ভেতরে লিভার থেকে শুরু করে অনেকগুলো গ্ল্যান্ড আছে। সেগুলোর সমস্যা হতে পারে। অথবা খাদ্যনালির মধ্যে হতে পারে। অথবা পেরিটোনিয়াম বলি এখানে আসতে পারে। যখন পেরিটোনিয়াম হয়, তখন পানি চলে আসে। তখন পেট ধীরে ধীরে ফুলে যেতে থাকবে। নাভি তখন সাধারণত বাইরের দিকে চলে আসে। আবার মেয়েরা যখন গর্ভবতী হয়, তখন পেটের চামড়াগুলো ফেটে যায়। ছেলেদেরও যখন পেটে পানি আসে, তখন চামড়া ফেটে যেতে পারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা কেন পানি আসছে তা নির্ণয় করে থাকি।
প্রশ্ন : ফুসফুসের টিবির তুলনায় পেটের টিবির চিকিৎসার ধরনে কি পার্থক্য থাকে সাধারণত?
উত্তর : ফুসফুসের জন্য যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, পেটের জন্য এসব কিছুই প্রযোজ্য নয়। ফ্লুইডকে দুই ভাগে ভাগ করি। এক্সুডিটিভ, ট্রানজুডেটিভ। যদি এক্সুডেটিভ হয়ে থাকে, তাহলে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকবে। ট্রানজুডেটিভ হলে প্রোটিনের পরিমাণ কম থাকবে।
যদি পেটে নিডেল দিয়ে পরীক্ষা করি, তাহলে ক্যানসার হলে দেখব পানির রং লাল। টিবিতে কখনো কখনো লাল হতেও পারে। আবার যদি সিরোসিস মনে করি, তাহলে সাধারণত অন্য রং থাকবে। অ্যালবুমিন দেখতে হবে।
আরেকটা পরীক্ষা করা যেতে পারে, এডিএ। টিবির নির্ধারণের জন্য ভালো পরীক্ষা হলো বায়োপসি। সেটা যদি করতেই হয়, তাহলে করতে হবে ল্যাপারোস্কপি। এটি করলে ছোট্ট মাংস সাগুদানার মতো পরীক্ষা করলেই সমস্যাটি ধরা পড়ে। তবে আমাদের দেশে কোনো রোগীরাই এটি করতে চান না। এখানে সাধারণত ফুসফুসের যক্ষ্মার মতো ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
প্রশ্ন : কখনো কি সার্জারির প্রয়োজন হয়?
উত্তর : অনেক সময় টিবি যখন ভালো হয়ে যায়, তখন ফাইব্রোসিস তৈরি হয়। ফাইব্রোসিস তৈরি হলে পায়খানার রাস্তায় তো আছে খাদ্যনালিগুলো, এগুলো চিকন হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে সার্জারি করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে চিকিৎসকই সেটা নির্ধারণ করবেন।