হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয়

হৃদরোগ অত্যন্ত প্রচলিত একটি বিষয়। আমরা জানি, বাংলাদেশ এবং সারা পৃথিবীতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কিছু কারণ রয়েছে যেটি এর ঝুঁকি বাড়ায়। আমরা যদি নিজেদের এগুলো থেকে সরিয়ে রাখতে পারি তবে রোগটি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আজ ৭ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০২৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কার্ডিওলোজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও অধ্যাপক ডা. এম এ রশিদ।
প্রশ্ন : শুরুতে একটু বলুন প্রচলিত হৃদরোগগুলো কী?
উত্তর : হৃদরোগকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন : জন্মগত হৃদরোগ, জন্মের পর হৃদরোগ। সাধারণত জন্মগত হৃদরোগ যেগুলো আছে, এগুলো গর্ভাবস্থায় মা যদি কোনো ওষুধপত্র বা কোনো ধরনের বাজে অবস্থার মুখোমুখি হন, তাহলে গর্ভাবস্থা থেকে শিশুটি হুদরোগ নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। আর একটি রয়েছে যেটি বাচ্চা বয়সে হয়। যেমন, রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ, সংক্ষেপে যেটিকে বাতজ্বর বলে। এটার প্রকোপ এখন অনেক কমে গেছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং সচেতনতার ফলে বাতজ্বর অনেক কমে গেছে। এটি হার্টের ভাল্বগুলোকে আক্রান্ত করে।urgentPhoto
হার্ট মূলত একটি পাম্প মেশিন, এই পাম্পকে পরিচালনা করার জন্য করনারি আর্টারি নামে একটি ধমনি আছে। সেই ধমনির মাধ্যমে হার্টে রক্তসঞ্চালন হয়। মানুষ যখন পূর্ণ বয়স্ক হয়, এই করনারি আর্টারিগুলোর ভিতর চর্বি জাতীয় একটি প্রলেপের মতো পড়ে এগুলো বন্ধ করে দেয়। তখনই ঠিক হার্ট অ্যাটাকের উদ্ভব হয়। এই হার্ট অ্যাটাকে সারা দুনিয়াতে প্রচুর লোক মারা যাচ্ছে। এমনকি ২৫ শতাংশ হাসপাতাল পৌঁছানোর আগে মারা যাচ্ছে। হার্ট যদি হঠাৎ ব্লক হয়ে যায়, অর্থাৎ রক্তনালি যদি বন্ধ হয়ে যায় এবং হার্ট যদি পাম্প না করে তখন সারা শরীরে কোথাও রক্ত যাবে না। প্রকৃতগতভাবে তখন অবধারিত মৃত্যু। এটি একটি ভয়ানক ব্যাপার।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন অনেক ধরনের হৃদরোগে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। করনারি আর্টারিজনিত হৃদরোগের প্রধান কারণগুলো কী? কী কী বিষয় আমাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়?
উত্তর : করনারি আর্টারি-জনিত হৃদরোগের প্রধান কিছু কারণ রয়েছে। অনেকের বংশগত কারণে এটি হয়। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তিটির পরিবারে হৃদরোগ রয়েছে। তখন খুব অল্প বয়সে তাদের করনারি আর্টারি বন্ধ হয়ে যায়। বংশগত কারণে যাদের হৃদরোগ হয়, তাদের রক্তে কোলেস্টেরলও বেশি থাকে। কোলেস্টেরলের কারণে রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায়। এটি একটি কারণ। আর কিছু কারণ রয়েছে। যেমন : যারা ধূমপান করে, যাদের ডায়াবেটিস আছে, ব্লাড প্রেশার আছে, যারা খায় বেশি, পরিশ্রম করে কম, যারা খুব চাপযুক্ত জীবন যাপন করে। এধরনের অবস্থার লোকদের হার্ট অ্যাটাকে ঝুঁকির প্রবণতা বেশি বাড়ে। এগুলো করনারি আর্টারিতে ব্লক তৈরি করার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রশ্ন : আপনি খাবারের কথা বললেন। কী ধরনের খাবার হৃদরোগ বাড়ায়? কেন বাড়ায়? আরেকটি বিষয় রয়েছে লবণ নিয়ে। ধারণা রয়েছে, লবণ খেলে হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে। এ জন্য অনেকে এটিকে কাঁচা না খেয়ে ভেজে নেয় বা তরকারিতে বেশি দেয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
উত্তর : খাবারের সঙ্গে যে অতিরিক্ত লবণ নেওয়া হয়, এটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কেননা আমাদের শরীরে যে লবণের চাহিদা আছে তা বিভিন্ন খাবারের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে যে লবণ রয়েছে তা থেকে পেয়ে যাই। কারণ এ থেকে উচ্চ রক্তচাপ বাড়ার প্রবণতা থাকে। শরীরে পানি আটকে যায়। অনেক সময় যাদের হার্ট ফেইলিউর বা হৃদরোগ আছে তাদের জন্য এই লবণ ক্ষতিকারক। কোনো খাবার রান্নার সময় যে লবণ দেওয়া হচ্ছে সেটিই যথেষ্ট। তরকারিতে স্বাদের জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা দিতে হবে। কিন্তু বাড়তি যে লবণ সেটা আমরা এড়িয়ে যেতে বলছি।
আরেকটি বিষয় বললেন, খাবারের ঝুঁকি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করার দরকার আছে। অনেক সময় আমরা সুষম খাদ্যের বদলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ খাবার খেয়ে ফেলি। যেটার প্রয়োজন না, সেটি বেশি খেয়ে ফেলি। যেমন : কাবোর্হাইড্রেট আমরা বেশি গ্রহণ করি। যার ফলে আমাদের ওজন বাড়ার একটা আশঙ্কা থাকে। কাবোর্হাইড্রেট মানে শর্করা, যা আমরা ভাত বা মিষ্টি জাতীয় খাবার থেকে পাই। এগুলো পরিমিত খাওয়া উচিত। এর পাশাপাশি আঁশ জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। যেমন : শাকসবজি, ফলমূল। এতে ওজনও বাড়ে না এবং দেহের প্রয়োজনীয় ভিটামিনগুলো পাই। কাবোর্হাইড্রেট, প্রোটিন শরীরে প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেগুলো পরিমিত।
প্রশ্ন : প্রোটিনের বেলায় বলবেন কী কোন মাংস বেশি ক্ষতি করে। কোন মাংস কম ক্ষতি করে?
উত্তর : প্রোটিনও শরীরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেগুলো লাল মাংস, যেমন: গরু, খাসি ইত্যাদি। এগুলোতে স্যাচুরেটেট ফ্যাট থাকে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। যাদের হৃদরোগ হওয়ার প্রবণতা রয়েছে তাদের এসব খাবার খুব ক্ষতি করে। আর প্রোটিনের অন্য ভালো উৎসের মধ্যে রয়েছে মুরগির মাংস, মাছ। এ ছাড়া ডিমের সাদা অংশও প্রোটিন। এমনকি এখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডিমের হলুদ অংশও খাওয়া যায়। অনেক গুণাগুণ রয়েছে এর ভেতরেও। মাঝেমধ্যে খাওয়া যায়।
প্রশ্ন : এখনকার জীবন যাত্রায় আমরা ফ্রাস্ট ফুডের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ি এবং কোমল পানীয় গ্রহণ করি। এগুলো হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায় কি না?
উত্তর : অবশ্যই বাড়ায়। জীবনযাত্রার ধরনের পরিবর্তন এবং খাদ্যাভ্যাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। আপনি যদি ডায়েটের সঙ্গে সঙ্গে ব্যায়াম না করেন তবে শরীরে ফিটনেস থাকে না। পাশাপাশি নানা ধরনের রোগব্যাধি হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। আর যারা হাঁটা-চলা করে তাদের মূল রক্তনালির পাশে যে ছোট ছোট শাখা তৈরি হয়, একটু বুঝিয়ে বলি, নদীর মাঝখানে যদি কোনো চর পড়ে আর পানির প্রবাহ যদি বেশি থাকে তবে সেই চর পড়ার কোনো সুযোগ পাবে না। কোনো না কোনোভাবে নদী প্রবাহিত হবেই। তেমনি হাঁটা চলার মাধ্যমে আমরা যদি হার্টের শক্তিকে বাড়াই তখন ছোট রক্তনালিগুলো যেগুলো সুপ্ত অবস্থায় আছে, সেগুলো ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়। একটি মানুষের হার্ট অ্যাটকের সময় যদি রক্তনালিগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন এগুলো দিয়ে সে বেঁচে থাকতে পারে। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করে, যারা অ্যাথলেটস তাঁদের এই বিষয়গুলো বেশি বৃদ্ধি পায়।
প্রশ্ন : আপনি শুরুতে বলছিলেন যাদের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, ডায়াবেটিস থাকে, পাশাপাশি যদি ধূমপায়ী হয় তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাদের ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : ডায়াবেটিস একাই হৃদরোগ তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। এর ওপরে সে যদি ধূমপায়ী হয়, তার যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে, রক্তে যদি কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে, সে যদি কম হাঁটাচলা করে, তার পারিবারিক ইতিহাসে যদি হৃদরোগের প্রবণতা থাকে, তাহলে সে উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এই রোগের জন্য। তাকে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এসব বিষয়। তাকে আরো সচেতন হতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং ধূমপান অবশ্যই ছাড়তে হবে।