কম্পিউটার আই সিনড্রম রোগ কেন হয়

বর্তমান যুগে কম্পিউটার ব্যবহার করেন না, এমন লোকের সংখ্যা কমই আছে। তবে দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে, যাকে বলা হয় কম্পিউটার আই সিনড্রম। আজ ২২ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৪৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অকুনোভা আই হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ডা. মো. সিদ্দিকুর রহমান।
প্রশ্ন : চোখের অনেক সমস্যার কথা আমরা জানি। কিন্তু কম্পিউটার আই সিনড্রম বিষয়টির সঙ্গে এখনো পরিচিত হয়নি সাধারণ মানুষ। আপনি কি একটু বলবেন কম্পিউটার আই সিনড্রম রোগটি আসলে কী?
উত্তর : কম্পিউটার আই সিনড্রমকে অনেকে কম্পিউটার আই ডিজিজ বলে। এটা কম্পিউটার সম্পর্কিত একটি রোগ। তবে এটি কম্পিউটার থেকে হতে পারে, ল্যাপটপ ব্যবহারের জন্য হতে পারে, অনেকক্ষণ টিভি দেখার কারণেও হতে পারে। অনেকগুলো উপসর্গের লক্ষণকে বলছি কম্পিউটার আই সিনড্রম। এখন তো কম্পিউটারের যুগ, ডিজিটাল যুগ। বাচ্চারা থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত প্রায় সবাই কম্পিউটার নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। দিন দিন কম্পিউটারের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে মানুষ। এর ফলে চোখে কিছু সমস্যা হয়। রোগীরা অনেক ধরনের অভিযোগ করেন। প্রথম সমস্যা হচ্ছে, আপনি হয়তো কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে আছেন, তখন চোখ জ্বালাপোড়া করতে পারে, চোখ লাল হতে পারে, চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে, চোখে ব্যথা হতে পারে, মাথাব্যথা হতে পারে, ঘাড় ব্যথা হতে পারে।
প্রশ্ন : এটি কীভাবে হয়?
উত্তর : প্রথমে বলি দৃষ্টি কীভাবে আসে। ধরেন, আপনার ঘরে পর্যাপ্ত আলো লাগবে। আলো যখন আপনার ওপরে পড়বে তখন আমার চোখে প্রতিফলিত হয়ে আমি দেখব। এটা যদি কম হয়, কম দেখব। বেশি হলে, বেশি দেখব। একটি আলোর পরিমাণ আছে যাতে দেখলে আমরা আরাম অনুভব করি। এটি সাধারণত ১০০ থেকে ২০০ ওয়াট। কম্পিউটার অথবা মোবাইল অথবা ল্যাপটপ এগুলোর যে ব্যাকগ্রাউন্ড ইলুমিনিশনটা (পেছনের আলোকসজ্জাটা), অর্থাৎ আলোর ওপরে যে ছবিটা আসছে সেটা অনেক বেশি। এটা এক হাজার ওয়াট থেকে দুই হাজার ওয়াট পর্যন্ত। অনেক সময় দেখা যায়, তিন হাজার ওয়াটেও চলে যায়। তাতে কী হয়? তাতে যদি আলো আপনার চোখে বেশি পড়ে, আপনি হাত দিয়ে চোখটা ঢাকেন সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে। তো সুস্থ অবস্থায় চোখকে সতেজ রাখতে গেলে আমার ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ ইলুমিনিশন বা আলোকসজ্জাটা লাগবে। না হলে হবে না। এখন যদি কোনো কারণে আমার ইলুমিনিশন প্রভাবটা অনেক বেড়ে যায়। তাতে কী হবে আমার চোখটা এর মধ্যে পড়ছে, চোখের মধ্যে পানি রয়েছে যা চোখকে সতেজ রাখে, যদি কোনো কারণে চোখের পানিটা কমে যায় তাহলে উপসর্গগুলো দেখা দেবে।
এটা গেল একটা দিক। যখন আপনি দূরে তাকাচ্ছেন, তখন চোখ দুটো সঠিক অবস্থান এবং বিশ্রামে থাকে। মানে চোখের ভেতর তো অনেকগুলো চোখের পেশি থাকে, ওপরে দেখার জন্য একরকম, নিচে দেখার জন্য আরেক রকম, পাশে দেখার জন্য একরকম, নাকের দিকে আরেক রকম। যখন আপনি সোজা দূরে তাকাচ্ছেন তখন চোখে চাপ পড়ে না, চোখে ব্যথাও হয় না। কিন্তু যখন আপনি কাছে তাকাচ্ছেন তিনটি জিনিস হয়। এক হলো, আপনি মাথাটাকে নিচু করছেন। যখন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইলের দিকে তাকানো হচ্ছে তখন মাথা নিচু করতে হচ্ছে। তাহলে ঘাড়, ঘাড়ের কাছের মাংস এবং হারে প্রভাব পড়ছে।
দ্বিতীয়ত, কম্পিউটারের মনিটরে তাকাতে গেলে চোখ দুটোকে নিচে আনতে হবে এবং নাকের দিকে আনতে হবে। এই কাজগুলোর সমন্বয়ে আপনি দেখছেন। আরেকটি হলো যে ফ্ন্টগুলোতে কাজ করছেন সেগুলো স্বাভাবিকের থেকে ছোট, অনেকে আবার বড় করে কাজ করেন। যদি ফ্ন্ট ছোট থাকে তবে চোখে চাপ পড়ে।
এগুলোর ফলে যা হচ্ছে আপনি হয়তো এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা ভালো থাকছেন। এরপরেই আপনার সমস্যাগুলো দেখা দেয়। একটি উদাহরণ দিই, আপনি হয়তো আপনার হাতটা ঝুলিয়ে রাখলেন ১০ মিনিট, দেখেন কেমন লাগে। হাতটা ভারী হয়ে যাচ্ছে। ছেড়ে দেন আরাম বোধ হবে। আর এই ক্ষেত্রে একটি চলমান চাপ পড়ছে চোখের ওপর এবং আলোর প্রতিফলনটা হচ্ছে। এতে ঘাড়ের যে হাড় আছে সেটাতে চাপ দিচ্ছেন। এই চাপের ফলে চোখে ব্যথা হবে, পাশাপাশি মাথার ব্যথা হবে। আর আলো বেশি আসার জন্য যেটা হয় চোখের পানি শুকিয়ে যায়। এই শুকিয়ে হয়ে যাওয়ার ফলে চোখটা লাল হয়ে যাচ্ছে। এতে চোখ জ্বালাপোড়া করবে, চোখ ব্যথা করবে, দৃষ্টি ঝাপসা হবে।
প্রশ্ন : অনেক সময় এই অভিযোগটা শোনা যায় অনেকক্ষণ ধরে মোবাইল বা কম্পিউটার দেখার পর একটা সময় সে আর ভালো করে দেখতে পারছে না, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। আপনাদের কাছে যখন এই ধরনের অভিযোগ নিয়ে আসে, তখন কীভাবে এটি ঠিক করেন?
উত্তর : প্রথমে আমরা তার বয়স দেখি। বাচ্চার ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত, তাদের কাছে দেখার ক্ষমতা অনেক বেশি। ওরা দুই-তিন ঘণ্টা অনায়াসে কাজ করতে পারে। এরপর যতই বয়স বাড়বে ২৫, ৩০, ৩৫ তখন এরা দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারবে। কিন্তু যাদের বয়স ৪০-এর ওপরে তাদের কাছের জিনিস দেখার ক্ষমতা এমনিতেই কমে আসে। এতে কী হয়, আমি আমার কার্যক্ষমতার বাইরে কাজ করতে যাচ্ছি। একটি চাপ তৈরি করছি। তখন উপসর্গগুলো দেখা দেবে। আপনার কম্পিউটার বা ল্যাপটপ, মোবাইলে কাজ করবেন তখন আপনার চোখই আপনাকে বলবে চোখ জ্বালাপোড়া করছে। চোখ ভারী ভারী লাগবে, চোখে ব্যথা হবে। তখন তাকে বলতে হবে প্রতি এক থেকে দেড় ঘণ্টা পড়ে বিশ্রাম নেন। কী রকম করে? আপনি চোখটা ঘুরিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলেন। যদি আপনি চোখটাকে বন্ধ রাখেন তবে চোখটা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে এটি নিচ থেকে ওপরের দিকে চলে আসবে। নাক থেকে সরে সোজা হয়ে যাবে। যেহেতু আলোর জন্য চোখ শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে, তাই পানি দিয়ে চোখটা ধুয়ে ফেলুন। ধোয়ার সময় চোখটা ম্যাসাজ করুন। এটা যদি দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পরপর করতে পারেন, সবচেয়ে ভালো। এটা যেকোনো বয়সের ক্ষেত্রে। যাদের বয়স বেশি তাঁরা একটু ঘন ঘন করলে আরো ভালো হয়।
আরেকটি হচ্ছে মাথাটা একটু ঘোরাবেন তাহলে ঘাড়টিতে আরাম দেওয়া যায়। কাজ করতে করতে যখন আপনার খারাপ লাগছে বা ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে, তখন এই কাজগুলো করতে পারেন। এতে চোখটা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে যাচ্ছে। আর যদি এতে না হয় তখন তাকে কৃত্রিম চোখের পানি বা আর্টিফিশিয়াল টিয়ার ব্যবহার করতে বলি।
প্রশ্ন : এর সাথে কি চশমা নেওয়ার কোনো দরকার আছে?
উত্তর : এখন অ্যান্টি রিফ্লেকশন চশমা দেওয়া যায়। এটাতে রে-টা প্রতিফলন করে। কিন্তু আপনি যাই করেন না কেন আলোর একটি প্রভাব থাকছে। এটা শুধু চোখের জন্য না। চোখ, মাথা থেকে ঘাড় পর্যন্ত সব জায়গায় থাকছে। তাই আমরা বলি আপনাকে একটু বিশ্রাম নিতেই হবে।