পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুরোধে আপনি কী করবেন?

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে গতকালের (২৪ মে) পর্বে আলোচনা করা হয়েছিল। আজকের আলোচনা এর প্রতিরোধে আরো কী করণীয় সে বিষয় নিয়ে। আলোচনা করেছেন সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুর রহমান। আজ ২৫ মে এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৪৫তম পর্বে প্রচারিত হয়েছে এই আলোচনা।
প্রশ্ন : গতকাল আপনি পানিতে ডুবে শিশুমৃতুর কারণ, এ সম্বন্ধে করা জরিপ নিয়ে কথা বলেছিলেন। আজ একটু আবার ছোট্ট করে বলেন প্রধানত কী কী কারণে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটছে এ দেশে?
প্রশ্ন : আমরা গতকালও বলেছিলাম বাংলাদেশ প্রায় ১৮ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। বেশির ভাগই মারা যায় বাড়ির কাছের ডোবা, পুকুর বা নালায়। বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যেই হয়তো মারা যায়। বেশির ভাগ শিশু মারা যায় দিনের সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে। মারা যায় কারণ তাকে বাড়িতে দেখে রাখার কেউ নেই। অর্থাৎ দেখে রাখার অভাবের কারণে তারা মারা যাচ্ছে।urgentPhoto
চার বছরের বাইরে যেই শিশুগুলো মারা যাচ্ছে এ রকম শিশুর সংখ্যা পাঁচ হাজার, সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো বাচ্চা মারা যাচ্ছে। এই বাচ্চাগুলো যে মারা যাচ্ছে তাদের একটি বড় কারণ হলো সাঁতার না জানা। কাজেই এই দুটো বিষয়ের আমরা যদি সমন্বয় করতে পারি, তাহলে আমরা এই বাচ্চাগুলোকে পানিতে ডোবা থেকে বাঁচাতে পারি।
প্রশ্ন : একটি শিশু রোগে ভুগে মারা গেল, এটি দুঃখজনক। কিন্তু তার চেয়ে বেশি কষ্টদায়ক হয়তো পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। সুস্থ-সবল, সুন্দর একটা বাচ্চা সে হয়তো একটু আগেও খেলছিল, সে পানিতে ডুবে মারা গেল। আপনি বলছিলেন, এক থেকে চার বছরের বাচ্চারা বেশি মারা যায়। তাদের তো সাঁতার সেখানো সম্ভব নয়। সেই ক্ষেত্রে প্রতিরোধের ব্যবস্থা কী?
উত্তর : যদি আমরা বাচ্চাগুলোকে দেখেশুনে রাখতে পারি। অর্থাৎ তাকে তত্ত্বাবধান করা একটি বড় প্রতিরোধের উপায়। কীভাবে এটা করব, এ ক্ষেত্রে মাকে সচেতন করতে হবে। কেননা সচেতনতা একটি বড় বিষয় এ ক্ষেত্রে। সারা বাংলাদেশের সব মানুষকেই পানিতে ডোবা প্রতিরোধে সচেতন করতে হবে। আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করছেন, সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিশাল একটি ভূমিকা রাখছেন। এ ছাড়া এই সচেতনতা রোধে একটি প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা হতে পারে। যেটা আমরা করেছি আমাদের সেন্টার থেকে। আমাদের সেন্টার থেকে প্রায ১০ বছর ধরে এই সমস্যাটির সচেতনতার জন্য সামাজিকভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি। এটা তো এমন নয় যে আপনি বাইরে গিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন আর সমস্যাটি ভালো হয়ে গেল। আমাদের মতো করে, আমাদের সংস্কৃতিতে যে বিষয়টি খাটে সেই রকম একটি সমাধান আমাদের বের করতে হবে।
আমরা ইউনিসেফ এবং ডিজিএইচএস একসাথে প্রিসাইজ নামে একটি গবেষণা প্রোগ্রামের মাধ্যমে এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছি। সেখানে আমরা আঁচল নামে একটি প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধান সেন্টার করেছি।
এটা অনেকটা ডে কেয়ার সেন্টারের মতো, যেটা বাইরের দেশে আছে। এখানে আমরা শিশুদের ৯টা থেকে ১টা- এই সময়ের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করলাম। সেখানেও একজন মা তাদের দেখাশোনা করে। এই সময় তারা পানিতে ডুববে না, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবে না, বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে পারি। আমরা গ্রামে গেলাম। একবার ভাবলাম যে গ্রামের বোধ হয় এইটা সম্ভব না। কিন্তু দেখা গেল এটা সম্ভব। গ্রামেই মায়েদের সাথে কথা বললাম, গ্রামের যারা মুরুব্বি তাদের সঙ্গে কথা বললাম, স্কুলশিক্ষকদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা বলল ঠিক আছে। তখন ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত একটা ঘরকে তারা দিতে রাজি হলো। আমরা ঘরটাকে উপযুক্ত করে দিলাম যেন বাচ্চাগুলো থাকতে পারে। এরপর ওই গ্রাম থেকেই একজন মা নির্বাচন করলাম যে মেট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে এবং এই কাজটি করতে উৎসাহী। তাকে নিয়ে এলাম এবং প্রশিক্ষণ দিলাম। আমরা দেখলাম এটি আরেকটি সুযোগ শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের জন্য। শিশুদের যদি এক থেকে দুই তিন বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো করা যায়, তার বিকাশের জন্য তাহলে সে বড় হয়ে একটি ভালো মানুষ হতে পারে। এই সেন্টারটাকে আমরা সেই সুযোগ হিসেবে নিলাম যাকে টিকে থাকা এবং বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা যায়।
এখানে আমরা ২৫টা বাচ্চাকে একসঙ্গে রাখার জন্য ব্যবস্থা করেছি। এখন আমাদের সারা দেশে তিন হাজার ২০০-এর মতো আঁচল সেন্টার রয়েছে।
প্রশ্ন : এখানে যারা বাচ্চাদের রাখতে চায়, তাদের কি কোনো খরচ দিতে হয়?
উত্তর : না কোনো খরচ দিতে হয় না। একদম ফ্রি। পাশাপাশি আমরা মায়েদের প্রশিক্ষণ দিই। কীভাবে আসবে, কীভাবে নেবে। এমনকি বাড়িতে যাওয়ার পরও কীভাবে দেখেশুনে রাখবে এ বিষয়ে তাদের সচেতন করে তুলি। মায়েরাও খুব আগ্রহী হয়। কারণে আঁচল থেকে যাওয়ার পর শিশুটি সালাম দেয়, গল্প বলতে চেষ্টা করে, ছড়া শোনায় তখন মা খুব খুশি হয়। আর মায়েরও একটা লাভ সে যখন জানছে বাচ্চাটা নিরাপদে আছে তখন কাজে মনোযোগ দিতে পারে।
এর মাধ্যমে দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমানো যাচ্ছে এবং শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে এটি সহায়তা করছে।