ডেঙ্গু জ্বর ও করণীয়
বর্ষাকালের মৌসুম হওয়ায় ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাই জনসচেতনতা ও বিভিন্ন মিডিয়ার প্রচারের মাধ্যমে ডেঙ্গুকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ডেঙ্গু একটি ভাইরাসঘটিত রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাসের মোট চারিটি প্রজাতি রয়েছে। ডেনভি –১ , ডেনভি–২, ডেনভি–৩ ও ডেনভি–৪। এডিস মশা এ রোগের বাহক। কোনো মানুষকে ডেঙ্গু আক্রান্ত মশা কামড়ানোর ৩ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ শুরু হয়। অর্থাৎ মানুষের শরীরের জীবাণু প্রবেশের পর সাধারণত ৩ থেকে ১৪ দিন পরে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।
ডেঙ্গু জ্বর হলে শরীরে যে সমস্যা হয়
প্রথমত ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমণের ফলে মানবদেহে রক্তবাহী শিরা ও ধমনিগুলো ভেতরের প্রলেপ বা পর্দাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে রক্তবাহী নালি থেকে রক্ত রস বেরিয়ে যায়। ফলে ব্লাড প্রেসার কমে যায় এবং আস্তে আস্তে শরীরে রক্ত প্রবাহের বিঘ্ন ঘটে, যেটাকে মেডিকেলের ভাষায় শক বলা হয়।
দ্বিতীয়ত
প্লাটিলেট এবং শরীরের রক্ত জমাট বাধার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ এ রোগের মূল সমস্যা দুইটি। যথা-
১. শরীরের রক্ত রস কমে গিয়ে ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়া।
২. প্লাটিলেট ও রক্ত জমাট বাধার উপকরণগুলো কমে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়া।
আবার রোগের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গু জ্বরকে বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়-
১. সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর : জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা ও চোখের পিছনে ব্যথা এ রোগের অন্যতম লক্ষণ।
২. ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার : এ অবস্থায় রোগীর রক্তরস রক্তনালী থেকে বের হয়ে যায়। ফলে উপরোক্ত লক্ষণের সঙ্গে রোগীর ব্লাড প্রেসার কমে যায়।
৩. ডেঙ্গু শক সিনড্রোম : এ অবস্থাটি ডেঙ্গু হামরিজিক ফিভারের একটি ভয়াবহ রূপ। এখানে রোগীর ব্লাড প্রেসার এতটাই কমে যায় যে রোগীর শরীরের কোষগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্ন ঘটে।
৪. এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম : এটি ডেঙ্গু জ্বরের এর সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ। এখানে মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, লিভার, কিডনি সবকিছুই ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ধাপ রয়েছে : ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত দুই থেকে সাত দিন স্থায়ী হয়। এ সময় শরীরে লাল লাল দাগ, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা থাকে।
ক্রিটিক্যাল ফেজ : এই ফেজটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এই ফেজটি সাধারণত শুরু হয় জ্বরের চতুর্থ অথবা পঞ্চমতম দিন থেকে এবং জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
রিকভারি ফেজ : ক্রিটিক্যাল ফেজ শেষ হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই রোগী আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে যায় এই সময়কে রিকভারি ফেজ বলে।
ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষাসমূহ
ডেঙ্গু জ্বরে কী কী পরীক্ষা করবেন এবং কোন দিন কী পরীক্ষা করবেন এটা জানা খুবই প্রয়োজন। এ সম্পর্কে না বুঝে পরীক্ষা করলে অনেক সময় পরীক্ষার রেজাল্ট নেগেটিভ হয় ফলে রোগ নির্ণয় কঠিন হয়ে যায়। ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণত নিম্ন বর্ণিত পরীক্ষাগুলো করা হয়। যথা-
এনএস ১, আইজিএম, আইজিজি, ব্লাড কাউন্ট বা সিবিসি, প্লাটিলেট কাউন্ট, এসজিপিটি ও এসজিওটি
এনএস ১ : এটা সাধারণত জ্বর আরম্ভ হওয়ার দিন থেকে শুরু করে প্রথম তিন দিন পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত পজিটিভ হতে পারে।
আইজিএম : এই পরীক্ষাটি জ্বর শুরুর পাঁচ দিন পর অর্থাৎ জ্বরের ষষ্ঠ দিনে থেকে শুরু করে প্রায় মাসাধিক পজেটিভ থাকে।
আইজিজি : এই পরীক্ষাটি পজিটিভ হলে বর্তমানে নয় বরং পূর্বে কখন ডেঙ্গু হয়েছিল এটার ইঙ্গিত বহন করে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে জ্বরের প্রথম তিনদিন এনএস ১ পজিটিভ অথবা ষষ্ঠ দিন থেকে আইজিএম পজিটিভ হবে কিন্তু জ্বরের চতুর্থ এবং পঞ্চম দিনের মধ্যে এনএস ১ এবং আইজিএম দুইটি টেস্ট নেগেটিভ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। তাই এ সময়ে পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কঠিন হয়ে যায়।
মনে রাখতে হবে উপরোক্ত পরীক্ষাগুলো নেগেটিভ হলেই ডেঙ্গু হয় নাই এটি শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ কোনো পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্তকরণে ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করে না।
সিভিসি : ডেঙ্গু জ্বরে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্টের পাশাপাশি সিভিসিতে টোটাল কাউন্ট, নিউট্রোফিল কাউন্ট, প্লাটিলেট কাউন্ট এবং হেমাটোক্রিট দেখেই সাধারণত রোগীর অবস্থা কেমন আছে তা বিবেচনা করা হয়।
সিভিসি রিপোর্টে হেমাটোক্রিট বেড়ে গেলে, ডব্লিবিসি কাউন্ট, নিউট্রোফিল কাউন্ট ও প্ল্যাটলেট কাউন্ট কমে গেলে অথবা এসজিপিটি এবং এসজিওটি পরিমাণ বেড়ে গেলে রোগীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে বলে বিবেচনা করা হয়। আবার রিপোর্টে এর বিপরীত চিত্র হলে রোগীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে বিবেচনা করা হয়।
ডেঙ্গু রোগীর ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট বা শারীরিক মূল্যায়ন
ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট বলতে বোঝানো হয় ল্যাব পরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসকরা রোগীদের শারীরিক অবস্থা দেখে রোগী সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করে থাকেন তাকেই ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট বলে। সব রোগের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ। তবে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে তাই শুধু ল্যাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডেঙ্গু রোগী ভালো আছে এটি বলার অবকাশ নেই।
ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট করার সময় নিম্নের বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
১. রোগীর শারীরিক অনুভূতি কেমন বা শারীরিকভাবে কেমন অনুভব করছেন বিশেষভাবে রোগীর অস্থিরতা আছে কিনা।
২. ব্লাড প্রেসার কেমন
৩. পেট ব্যথা বা বমি আছে কিনা
৪. শরীরের কোন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিনা।
সতর্কতা
মনে রাখবেন ডেঙ্গু জ্বর হলে সব প্রকার জটিলতাসমূহ শুরু হয় জ্বরের শেষের ভাগে অথবা জ্বর ভালো হওয়ার পরে। এসময় হঠাৎ করে ব্লাড প্রেসার কমে রোগী শকে চলে যেতে পারে। তাই জ্বরের শেষ অংশে অথবা জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার পরবর্তী ২-৩ দিন রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখতে হবে।
মনে রাখতে হবে প্লাটিলেট কাউন্ট ভাল আছে অথবা জ্বর নাই আর কোনো সমস্যা হবে না, এটা ভাববেন না।
যদিও ডেঙ্গু জ্বর হলে অধিকাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। শুধু নিম্নলিখিত কারণে রোগীর ভর্তির প্রয়োজন হয়-
১. বাচ্চা অস্থির হলে।
২. ব্লাড প্রেসার কমে গেলে।
৩. প্রচণ্ড পেট ব্যাথা / বমি হলে।
৪. পেটে বা বুকে পানি আসলে।
৫. প্লাটিলেটস কাউন্ট দ্রুত কমে গেলে।
৬. রক্তক্ষরণ হলে।
হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে যে চিকিৎসা দেওয়া হয়
ভর্তিকৃত সব রোগীকে শিরায় স্যালাইন দেওয়ার মাধ্যমে ব্লাড প্রেসার মেইনটেইন করা এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা মূল চিকিৎসা। তাই শিশুদের ডেঙ্গু জ্বর হলেই আতঙ্কিত না হয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে রেখে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
শিশুদের ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে করণীয়
শিশুদের ডেঙ্গু রোগ হওয়া থেকে বাঁচাতে শুরুতেই এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
১. প্রথম পরামর্শ হলো, এডিস মশার উৎস ধ্বংস করতে হবে। এডিস মশা সাধারণত গৃহস্থালির পরিষ্কার স্থির পানিতে জন্মে থাকে। যেমন ফুলের টব, গাড়ির টায়ার বা ডাবের খোলে বৃষ্টির জমা পানি ইত্যাদি। তাই এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিতে পারে এমন স্থানগুলো চিহ্নিত করে নষ্ট করে ফেলতে হবে। বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
২. শিশুদের দিনে ও রাতে মশারির ভেতরে রাখতে হবে। বিশেষ করে নবজাতক শিশুকে সার্বক্ষণিক মশারির ভেতরে রাখা জরুরি। এছাড়া হাসপাতালে কোনো শিশু যদি অন্য রোগের চিকিৎসাও নিতে আসে, তাহলে তাকেও মশারির ভেতরে রাখতে হবে। কেননা ডেঙ্গু আক্রান্ত কাউকে এডিস মশা কামড়ে পরে অন্য শিশুকে কামড়ালে তার শরীরেও ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৩. শিশুরা যে সময়টায় বাইরে ছুটোছুটি বা খেলাধুলা করে, সে সময়টায় তাদের শরীরে মসকুইটো রেপেলেন্ট অর্থাৎ মশা নিরোধীকরণ স্প্রে, ক্রিম বা জেল ব্যবহার করা যেতে পারে। কয়েক ঘণ্টা অন্তর পুনরায় এই রেপেলেন্ট প্রয়োগ করতে হবে।
৪. শিশু যদি অনেক ছোট হয় বা তাদের শরীরে ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে তাদের হাতে মসকুইটো রেপেলেন্ট বেল্ট বা পোশাকে প্যাচ ব্যবহার করা যেতে পারে।
৫. মশার কামড় প্রতিরোধে আরেকটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হতে পারে শিশুদের ফুল হাতা ও ফুল প্যান্ট পরিয়ে রাখা।
৬. তবে মশা প্রতিরোধ অ্যারোসল, মশার কয়েল বা ফাস্ট কার্ড শিশু থেকে শুরু করে সবার জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। এর পরিবর্তে মসকুইটো কিলার বাল্ব, ইলেকট্রিক কিলার ল্যাম্প, ইলেকট্রিক কয়েল, মসকুইটো কিলার ব্যাট, মসকুইটো রেপেলার মেশিন, মসকুইটো কিলার ট্র্যাপ ইত্যাদির সাহায্যে নিরাপদে মশা ঠেকানো যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে এ সরঞ্জামগুলো যেন শিশুর নাগালের বাইরে থাকে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন মিস্টার তালহা।
৭. যদি শিশুর মা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হন, তাহলে সেই ভাইরাসের কোনো প্রভাব মায়ের বুকের দুধে পড়ে না। কাজেই আক্রান্ত অবস্থায় মা তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন।
* বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়ান।
* পূর্ণ বিশ্রামে রাখুন।
* চিকিৎসক ভর্তি হতে পরামর্শ দিলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হবেন।
লেখক : ডা. মো কামরুজ্জামান কামরুল, সহযোগী অধ্যাপক পালমনোলজী বিভাগ, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউট।