অনন্য স্বাদের কুমিল্লার রসমালাই
খাদ্য তালিকায় মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশ জমিয়ে খেতে পছন্দ করে সবাই। আর সেই মিষ্টিজাতীয় খাবার যদি হয় কুমিল্লার রসমালাই, তাহলে তো কথাই নেই। কুমিল্লার রসমালাইয়ের কথা শুনে জিভে জল আসে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কথিত আছে বঙ্গেই এ রসমালাইয়ের জন্ম। ১৯০০ সালের দিকে রসগোল্লার পরিবর্তে রসমালাই নামটির প্রচলন শুরু হয়। ছোট ছোট মিষ্টি বানিয়ে তা চিনির সিরায় ভেজে জ্বাল দেওয়া ঘন দুধে ডুবিয়ে তৈরি করা হয় রসমালাই।
বঙ্গে রসমালাইয়ের জন্ম হলেও কালের পরিক্রমায় কুমিল্লা হয়ে ওঠে রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত। বর্তমানে রসমালাইয়ের নাম শুনলেই সবার আগে মাথায় আসে কুমিল্লার রসমালাইয়ের কথা, যা কুমিল্লার রসমালাই নামে খ্যাত। দেশ-বিদেশের যেখান থেকেই মানুষ কুমিল্লায় আসুক না কেন, রসমালাইয়ের স্বাদ না নিয়ে যান না কেউই।
বাঙালি ময়রা কৃষ্ণ চন্দ্র দাস প্রথম রসমালাই তৈরি করেন। বাংলাদেশে কুমিল্লার রসমালাই বিখ্যাত। ১৯৩০ সালে ত্রিপুরার ঘোষ সম্প্রদায়ের হাত ধরে কুমিল্লায় রসমালাইয়ের প্রচলন শুরু হয়। সে সময় ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিল্লার ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানিয়ে তাতে ছোট আকারের শুকনো রসগোল্লা ভিজিয়ে যে মিষ্টান্ন তৈরি করে, তা ‘ক্ষীরভোগ’ নামে পরিচিতি পায়। ক্রমান্বয়ে এই ক্ষীরভোগ ‘রসমালাই’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই থেকে দিন দিন এর চাহিদা ও সুখ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। ঈদ, পূজা, বিয়ে বা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, অতিথি আপ্যায়ন, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার এক প্রথাগত রেওয়াজ সৃষ্টি হওয়া ছাড়াও ভোজনবিলাসী মানুষের কাছে রসমালাই এক প্রিয় নাম হয়ে ওঠে।
মাতৃভাণ্ডারের ইতিকথা
কুমিল্লা অঞ্চলে রসমালাই তৈরি শুরু হয় ১৯০০ সালের দিকে। তবে আজকের কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৩০ সালের দিকে। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা শংকর সেনগুপ্তের হাত ধরে এটির বিকাশ হয়। বর্তমানে তাঁর ছেলে অনির্বাণ সেনগুপ্ত ব্যবসা পরিচালনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ওই শিক্ষার্থী কোনো চাকরিতে না গিয়ে বংশপরম্পরায় পরিবারের এই ব্যবসায় নামেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই রসমালাইয়ের চাহিদা থাকে বেশি। কিন্তু দুধের জোগান কম হলে রসমালাইও কম তৈরি হয়। বেশি হলে বেশি পরিমাণে বানানো যায়। মান ও গুণ ধরে রাখার জন্য আমরা সব সময় চেষ্টা করি। আমার বাবার ব্যবসায়ের মূল পুঁজি ছিল সুনাম। সেই সুনামকে অক্ষুণ্ণ রাখাই আমার মূল লক্ষ্য।’
কোথায় অবস্থিত কুমিলার মাতৃভাণ্ডার
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার ময়নামতি থেকেই দেখা মিলে মাতৃভাণ্ডার সাইনবোর্ডধারী মিষ্টি দোকানের। এখানে প্রায় অর্ধশত মাতৃভাণ্ডারের সাইনবোর্ডধারী দোকান রয়েছে, যাদের কারও সাথেই কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের কোনো দূরতম সম্পর্ক নেই। আসল মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের স্বাদ পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে কুমিল্লা শহরে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের মনোহরপুর এলাকায় একটি টিনের চালা দেওয়া দোকানটি হলো কুমিল্লার প্রকৃত মাতৃভাণ্ডার। শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ২০০ গজ পূর্বদিকে চকবাজার রোডে রাজেশ্বরী কালী মন্দিরের বিপরীত দিকে অবস্থিত কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডার। পাশাপাশি তিনটি মিষ্টি দোকানের মাঝখানের চাকচিক্যহীন সাদামাদা দোকানটিই হলো কুমিল্লার বিখ্যাত মাতৃভাণ্ডার।
মাতৃভাণ্ডার রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত হলেও রসমালাইয়ের পাশাপাশি এখানে মিষ্টি, ক্ষীর, ছানা মুড়কি, পেড়া ও দধি পাওয়া যায়। প্রতি কেজি রসমালাই ২৮০ টাকা, মিষ্টি ২৬০ টাকা, ক্ষীর ৩৮০ টাকা, ছানা মুড়কি ৬৪০ টাকা, স্পেশাল পেড়া ৪৪০ টাকা ও দধি ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়।
প্রতিদিন কুমিল্লার রসমালাইয়ের স্বাদ নিতে শত শত মানুষ আসেন এই কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত স্কুল শিক্ষক সফিকুল ইসলাম পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসেন কুমিল্লায়। তিনি জানান, কুমিল্লায় এসে কুমিল্লার রসমালাই না খেলে তো হয় না। দোকান চিনে আসতে একটু কষ্ট হলেও প্রকৃত রসমালাই নিতে পেরে খুশি তিনি।
প্রায় ২৫ জন কারিগর কাজ করেন কুমিল্লায় মাতৃভাণ্ডারের এই সুস্বাদু রসমালাই তৈরির জন্য। খাবারের মান ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে নিরলস কাজ করেন বলে এনটিভি অনলাইনকে জানান তাঁরা।
প্রায় ৯০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষকে প্রকৃত রসমালাইয়ের স্বাদ দিয়ে আসছে কুমিল্লার মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভাণ্ডার। তবে কুমিল্লা শহর ও মহাসড়ক ঘিরে নকল রসমালাইয়ের অগণিত দোকান গড়ে ওঠায় আসল রসমালাইয়ের স্বাদ অনেকেই পান না। সত্যিকারের তৃপ্তির ঢেঁকুর তখনই দিতে পারবেন, যখন চিনে নিয়ে সঠিক জায়গা থেকে আসল রসমালাই কিনতে পারবেন। কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই পেতে হলে যেতে হবে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে। এখান থেকেই প্রায় ৯০ বছর আগে অমৃত স্বাদের এই রসমালাই যাত্রা শুরু করে।